রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে খুলনায় গেলো পরীক্ষামূলক ট্রেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা: প্রেস উইং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের নতুন নির্বাচন কমিশন প্রত্যাখ্যান জাতীয় নাগরিক কমিটির

ভুল চিকিৎসা : দায়ী কে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মুতিউর রাহমান

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে মাঝে মধ্যেই চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন ছাঁপা ও প্রকাশিত হয়। যা রীতিমত শিউরে উঠার মতো। একের পর এক ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, অঙ্গহানী, চিকিৎসা খরচের নামে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়া, লাশ আটকে রেখে টাকা আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে দেশের তথাকথিত অভিজাত হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধেও। কিন্তু সব অভিযোগই ধামাচাপা পড়ে যায়। তথাকথিত অভিজাত হাসপাতালগুলোর নির্দয় চিকিৎসা-বাণিজ্যের কাছে মানুষ নিরীহ যিম্মী। চিকিৎসকের ভুলে রোগী মারা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পঙ্গু হয় তবু দোষী চিকিৎসকের কিছুই হয় না। চিকিৎসকরা সেবা নয় রোগীর কাছ থেকে কত টাকা নিতে পারেন সেটাই মুখ্য। কত ওষুধ দিতে পারেন তার প্রতিযোগিতা।

মৃত মানুষকে লাইফ সাপোর্টে রেখে মৃতের স্বজনকে কত বড় বিল ধরিয়ে দিতে পারেন তারই যেন সাধনা চলছে। হাসপাতালে রোগী পাঠানো থেকে শুরু করে লাশ হয়ে বের হওয়া পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই চলে বেপরোয়া কমিশন বাণিজ্য। মৃত রোগীর লাশটিই বেমালুম লাইফ সাপোর্টে রেখে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা বিল হাতিয়ে নেওয়া হয়। ফুসফুস, হৃদযন্ত্র বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ না করলে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। আর অপারেশনের রোগী হলে তো কথাই নেই। রোগীদের যিম্মি রেখে মুক্তিপণ আদায়ের অভিনব কৌশল লাইফ সাপের্ট।
অপরদিকে দেশজুড়ে ওষুধ বাণিজ্যেও চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। ভেজাল ওষুধে সয়লাব বাজার। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ এবং ওষুধ কোম্পানীর দৌরাত্মে যিম্মি হয়ে পড়ছেন রোগীরা। রোগীরা জানতেও পারছেন না টাকা দিয়ে আসলে তারা কী কিনছেন? কমিশন প্রলুব্ধ অনেক ডাক্তার অপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ ও টেস্ট লিখে দেন রোগীকে। ফলে অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও কাঙ্খিত সুফল পাচ্ছেন না রোগীরা। সব মিলিয়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চলছে চরম নৈরাজ্য। সীমাহীন দৌরাত্ম। এহেন অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় তাহলে কী?
জবাবদিহিতার চিন্তা মানুষকে সৎ-নিষ্ঠাবান থাকতে সহায়তা করে। অন্যায় অপরাধ ও দুর্নীতি থেকে বিরত রাখে। মানুষের মধ্যে যদি এই চিন্তা জাগরুক থাকে যে কিয়ামতের দিন আমার প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে তাহলে সে স্বেচ্ছায়ই অপরাধ থেকে বিরত থাকবে। অন্যথায় শত আইন করে নজরদারী করেও অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য দেশের মানুষের মধ্যে যদি পরকাল ভাবনা সৃষ্টি হয়, তাকওয়া অর্জন হয় তাহলে প্রাতিটি ক্ষেত্রেই অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে
‘তোমরা সেদিনকে ভয় কর যেদিন তোমরা আল্লাহর কাছে ফিরে আসবে। অতঃপর প্রত্যেককে তার কর্মফল পুরোপুরী দেয়া হবে। আর তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে। [সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮১]
এ আয়াতটি সর্বশেষ অবতীর্ণ হয়েছে। এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার অল্প কয়েক দিনের মাথায়ই নবী মুহাম্মদ সা. এর ওফাত হয়। সবশেষে কুরআনের এ আয়াতটি অবতীর্ণ করে আল্লাহ তা‘আলা যেনো ইঙ্গিত করলেন গোটা কুরআনের সারকথাই যেনো এই আয়াত।

পরকাল ভাবনা সৃষ্টি হলে গোটা কুরআন বা গোটা ইসলাম মানা সম্ভব ও সহজ হবে। এ জন্য পবিত্র কুরআনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জুড়ে বিভিন্নভাবে বার বার আখেরাত, কিয়ামত দিবসের জবাবদিহিতা ও হিসাব-নিকাশ ইত্যাদির আলোচনা এসেছে। অন্য ক্ষেত্রের মতোই চিকিৎসক সমাজ, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিক ও কর্মকর্তা ব্যক্তিদের মধ্যেও যদি পরকাল ভাবনা সৃষ্টি হয় তাহলে নৈরাজ্য ও দৌরাত্ম বন্ধ হবে।

চিকিৎসকরা যদি বিশ্বাস করেন মানুষকে প্রতারিত করা যায় কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে প্রতারণা চলে না। পরকালে তিনি প্রতারণার বিচার করবেন তাহলে এই বিশ্বাসই তাদেরকে নৈরাজ্য থেকে বিরত রাখবে। এ কারণেই পবিত্র কুরআনে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে ‘মানুষ প্রকাশ্যে বা গোপনে যাই করে সবই আল্লাহ তা‘আলা জানেন।’ চিকিৎসা ক্ষেত্রে অসাধুতা, অনৈতিকতা বন্ধের জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করার কোন বিকল্প নেই।
ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু বা অঙ্গহানী হলে দোষী ডাক্তারদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার মতো সুনির্দিষ্ট আইন দেশে নেই। কিন্তু ইসলামে এর স্পষ্ট বিধান রয়েছে। ইচ্ছাকৃত হত্যা, ভুলবশত হত্যা, ইচ্ছাকৃত অঙ্গহানী ও ভুলবশত অঙ্গহানী উভয়ের দণ্ডবিধি পবিত্র কুরআনে রয়েছে। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু বা অঙ্গহানীর বিষয়টিও তারই আওতাভুক্ত। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘কোন মুমিনকে হত্যা করা কোন মুমিনের কাজ নয়। তবে ভুলবশত হলে তা স্বতন্ত্র এবং কেউ কোন মুমিনকে ভুলবশত হত্যা করলে একজন মুমিন দাস মুক্ত করা এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ করা বিধেয়। যদি না তারা ক্ষমা করে।’ [সুরা নিসা, আয়াত : ৯২]
এ আয়াতে ভুলবশত হত্যার বিধান বর্ণিত হয়েছে। তা হচ্ছে একটি দাস মুক্ত করা এবং মৃতের পরিবার পরিজনকে দিয়াত-রক্তপণ পরিশোধ করা। রাসুল সা. বলেন যে চিকিৎসক হিসাবে সুপরিচিত নয় এমন কেউ যদি চিকিৎসা করে রোগীর ক্ষতি করে ফেলে তাহলে তার উপর জরিমানা আরোপ হবে। হাদীসের বর্ণনাকারী আবদুল আজীজ বলেনএটা কেবল ব্যবস্থাপত্র দেয়ার ক্ষেত্রে নয়; বরং এটা হচ্ছে শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে। [আবু দাউদ, হাদীস নং : ৩৩০]
হাদীসের অর্থ হচ্ছে চিকিৎসক যদি কোন অস্ত্রপাচার করতে গিয়ে রোগীর ক্ষতি করে ফেলেন তাহলে তাকে জরিমানা দিতে হবে।
মুফতী রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. আহসানুল ফাতাওয়ায় বিষয়টির বিষদ বিশ্লেষণ এভাবে করেছেন ডাক্তার দু ধরনের।

এক. বিজ্ঞ ডাক্তার। দুই. অনভিজ্ঞ ডাক্তার।
কোন বিজ্ঞ ডাক্তার যদি রোগীর সম্মতিতে চিকিৎসার সকল নিয়ম মেনে চিকিৎসা করেন, অস্ত্রপাচার করেন তদুপরি দুর্ঘটনাক্রমে রোগীর মৃত্যু, অঙ্গহানী বা অন্য কোন ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে তাতে ডাক্তার দায়ী হবেন না। তার উপর কোন জরিমানা বর্তাবে না। বিজ্ঞ ডাক্তার যদি রোগীর অনুমতি ছাড়াই চিকিৎসা বা অস্ত্রপাচার করেন এবং চিকিৎসা শাস্ত্রীয় নিয়ম-নীতি বহির্ভুত হয় আর তাতে রোগী মারা যান তাহলে চিকিৎসকের উপর দিয়াত-রক্তপণ আরোপিত হবে। কোন অঙ্গহানী হলে শরীয়ত নির্ধারিত জরিমানা (আরশ-অঙ্গের পণ) বর্তাবে।
অনভিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তারের সঠিক বা ভুল চিকিৎসায় যে কোনোভাবেই রোগীর মৃত্যু হলে ডাক্তারে উপর পূর্ণ দিয়াত (রক্তপণ) বর্তাবে। অঙ্গহানী হলে অঙ্গের পূর্ণ জরিমানা বর্তাবে। ডাক্তার যদি নিজ হাতে অস্ত্রপাচার করেন ইনজেকশন বা স্যালাইন পুশ করেন বা ওষুধ নিজ হাতে খাইয়ে দেন তাহলে সে ক্ষেত্রেই কেবল উপরোক্ত বিধান প্রযোজ্য। চিকিৎসক যদি কেবলই ওষুধ লিখে দেন বা বলে দেন অর্থাৎ ব্যবস্থাপত্র দেন এর বেশি কিছু না করেন আর ওষুধ সেবন বা ব্যবহার করে রোগী মারা যায় বা অঙ্গহানী হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিধান প্রযোজ্য নয়। তবে বিচারক সে ক্ষেত্রে চিকিৎসককে কোন যৌক্তিক শাস্তি দিতে পারেন।
[আহসানুল ফাতাওয়া, খ : ৮, পৃষ্ঠা : ৫১৭-৫১৮। রাদ্দুল মুহতার (শামী), খণ্ড : ৯, পৃষ্ঠা : ২১৪। ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৫৪। মাজমাউল আনহুর, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৫৬]
এবার আসা যাক দিয়াত প্রসঙ্গে। দিয়াত বা রক্তপণ হচ্ছে প্রায় উনিশ ভরি স্বর্ণ বা দুই হাজার ছয়শত পঁচিশ (২৬২৫) ভরি রূপা বা একশ উট (নির্দিষ্ট বয়সের)। এটা হচ্ছে পূর্ণ দিয়াত। যা নিহত ব্যক্তি পুরুষ হলে ওয়াজিব হয়। নারীর দিয়াত সর্বক্ষেত্রে পুরুষের অর্ধেক। [হেদায়া, খণ্ড : ৪]
অঙ্গহানীর জরিমানা বা পণ অত্যন্ত ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বিষয়। এ ছোট নিবন্ধে তার পূর্ণ আলোচনা করা সম্ভব নয়।
চিকিৎসার ভুলে রোগীর মৃত্যু, অঙ্গহানী বা অন্য কোন ক্ষতি হলে শরীয়তের দৃষ্টিতে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সে আলোচনা অনেক দীর্ঘ। ফিকহের কিতাবাদিতে তার বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এখানে সামান্যই আলোকপাত করা হলো। মূলকথা হচ্ছে দেশের প্রচলিত আইনে এ সংক্রান্ত কোন আইন না থাকলেও ইসলামে কিন্তু এর খুটিনাটি সব কিছুরই বিধান রয়েছে। চিকিৎসকদের ভুলে বা হেলাফেলার কারণে রোগীর মৃত্যু ও অঙ্গহানী বা অন্য কোন ক্ষতির ঘটনা যে হারে বাড়ছে তা উদ্বেগজনক। সত্তর এর একটা বিহীত না করলে মানুষ চিকিৎসকদের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে।

লেখক : প্রধান মুফতি ও শায়েখে সানী, ঢাকার চৌধুরীপাড়া  শেখ জনুরুদ্দিন রহ. দারুল কুরআন মাদরাসা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ