জাহিদুল হক মনিরঃ এক যুগ পেরিয়ে গেলেও আজো সোয়া দু’শ বছরের পুরনো মুসলিম স্থাপত্যের ঐতিহাসিক প্রাচীন নিদর্শন শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ঘাঘড়া ‘লস্কর খানবাড়ী’ জামে মসজিদটির সংস্কার হয়নি। মসজিদটির তত্ত্বাবধানে আছে জাতীয় প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ। এ দিকে অনুমতি না থাকায় এলাকাবাসী মসজিদটি সংস্কার করতে পারছে না।
মুসলিম স্থাপত্যের ঐতিহাসিক নিদর্শন মসিজদটি অক্ষত অবস্থায় কালের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকলেও জাতীয় যাদুঘর প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের সঠিক পরিচর্যার অভাবে তা ভংগুর দশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে এলাকাবসী অভিযোগ করেন।
স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন ঐতিহাসিক ‘খানবাড়ী’র মসজিদটি উপজেলার হাতিবান্দা ইউনিয়নের ঘাগড়া লস্কর গ্রামে অবস্থিত। কালের আবর্তে এ মসজিদের নাম ঘাগড়া লস্কর খান মসজিদ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। উপজেলা সদর থেকে এর দূরত প্রায় ৮ কিলোমিটার। মসজিদের গায়ে বর্তমানে যেসব নির্দশন পাওয়া গেছে সে অনুসারে ধারনা করা হয়, বক্সার বিদ্রোহীদের নেতা হিরোঙ্গি খাঁর বিদ্রোহের সময় মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। আজিমোল্লাহ খান মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটির দরজার উপর মূল্যবান কষ্টি পাথরের উপর খোদাই করে আরবি ভাষায় এর প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ করা হয়েছে হিজরি ১২২৮ বা ইংরেজী ১৮০৮ সাল। মসজিদটির গঠন পদ্ধতি ও স্থাপত্য কৌশল শিল্পসমৃদ্ধ ও সুদৃশ্য। এর ভিতরে রয়েছে দুটো সুদৃঢ় খিলান। এক গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদটি বর্গাকার। যার দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট প্রস্থও ২৭ ফুট উভয়দিকই সমান। মসজিদের মাঝখানে বড় গম্বুজের চারপাশ ঘিরে ছোট-বড় বারটি মিনার। এর মধ্যে চারকোণায় রয়েছে চারটি। মসজিদে দরজা রয়েছে মাত্র একটি। ভিতরে মেহরাব ও দেয়াল অঙ্কিত রয়েছে বিভিন্ন কারু কাজের ফুলদানী ও ফুল। মসজিদের দেয়ালের গাথুনী ৪ ফুট পাশ, যা চুন ও সুরকি দিয়ে গাথা। তৎকালীন খান বাড়ীর লোকজনসহ গ্রামের অনেকে ৫৮ শতক জায়গার উপর মসজিদটি ওয়াকফ করে দেয়। এর মধ্যে মসজিদটির মূলভবন ও চেহান রয়েছে ১৭ শতকের উপর এবং ৪১ শতকের উপর জমিতে রয়েছে কবরস্থান।
এই মসজিদটি’র বাইরে থেকে বিশাল আকার দেখা গেলেও ভিতরে খুব বেশী বড় নয়। এক গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের উত্তর এবং দক্ষিন পাশে রয়েছে দুটি জানালা। মসজিদের ভিতর ইমাম বাদে তিনটি কাতারে ১২ জন করে মোট ৩৬ জন মুসল্লি এক সাথে নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে মসজিদের বাইরের অংশে অর্থাৎ চেহানে আরো প্রায় অর্ধশত মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। মসজিদের আকার বা পরিধি যাই হোক না কেন মসজিদে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করার সময় নিজেকে মনে হয় দু’শ বছর পেছনে চলে গেছি। কেমন জানি এক অদ্ভুত অনুভূতি। নিজে উপস্থিত হয়ে নামাজ না পড়লে বিশ্বাস করানো বা বোঝানো সম্ভব নয়।
গত প্রায় ১৬ বছর আগে জাতীয় যাদুঘর এর প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু একজন কেয়ারটেকার নিয়োগ, একটি সতর্কবাণী লাগানো ও দায় সারাভাবে একবার রং করা এবং মসজিদটির বাউন্ডারী দেয়াল ছাড়া আর কোন ভূমিকা পালন করেনি। মসজিদটির মেঝে ডেবে যাচ্ছে, দেয়ালে ফাটল ধরছে। দ্রুত সংস্কারের ব্যবস্থা না নিলে কালের এ নীরব সাক্ষী হয়তো নীরবেই হারিয়ে যাবে বলে স্থানীয়রা আশংকা প্রকাশ করছেন। সেই সাথে তারা মসজিদটি সংরক্ষনের দাবি জানান। জাতীয় প্রত্নতত্ত বিভাগ হতে নিয়োগপ্রাপ্ত সাইট পরিচারক (খাদেম) মো. সাইফুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শন করে মসজিদটির সংস্কারের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছিলেন কিন্তু এই আশ্বাসের কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। এর পরে আর কারও দেখা মিলেনি। খান পরিবারের সদস্য কামরুজ্জামান খান, আফজাল হোসেন খানসহ এলাকাবাসী এ ঐতিহ্যবাহী খান মসজিদটি সংরক্ষণ ও এর সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য সরকারের দৃষ্টি কামনা করেন।
মসজিদের বর্তমান ইমাম মুফতি রফিকুল ইসলাম ও খান পরিবারের সদস্য দুলাল খান জানান, ২০০৪ সালের পর থেকে মসজিদটিতে কোনো চুনকাম করা হয়নি। মসজিদের ভিতরে ও বাইরের বিভিন্ন অংশে শেওলা ধরে কালো হয়ে গেছে। দেয়ালের বিভিন্ন অংশে ফাটল ও আস্তর খসে পড়ছে। মসজিদের চেহানের বিভিন্ন অংশে ফাটলের দেখা দিয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এজেডএম শরীফ হোসেন বলেন, যেহেতু মসজিদটি প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে। আমি পরিদর্শন করে জাতীয় জাদুঘর প্রত্মতত্ত্ব কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করব।
মসজিদটি দেখার জন্য এখনে অসংখ্য দর্শনার্থী ভিড় করেন। এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীরা মসজিদটির সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
ভাগ্যরজনীতে উদ্বোধন হলো ইতালির সবচেয়ে বড় মসজিদ