মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
দুনিয়ার সকল ধর্মমতেই বিশেষত গ্রিক দর্শনেও ফিরিস্তাদের অস্তিত্ব স্বীকৃত। সাবিয়ি ধর্মমতে এ শ্রেণির মাখলূককে তারকাপূঞ্জ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। তারা ফিরিশতাদের উদ্দেশ্যে কুরবানিও দিত। তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করত। তাদের মনে করত দৃশ্যমান প্রভু বা ‘খোদার প্রকাশ’। ইউনানি মিশরি (ইসকান্দরি) দর্শনে তাদের নাম ‘উকূলে আশারা’ (দশ বুদ্ধি)। আর পার্শিয়ানরা ফিরিশতাদেরকে বলত ‘ইমশাস পান্দ’।
তাদের ধারণামতে ফিরিশতাদের সংখ্যা অগণিত। পার্শিয়ানরা ফিরিশতাদেরকে পূজা-অর্চনার যোগ্য বলে মনে করত। তাদের ধর্মমতে সর্বাধিক মর্যাদাবান ফিরিশতা হলেন ছয়জন। তাদের প্রত্যেকের অধীনে রয়েছে তেত্রিশজন করে ফিরিশতা। পার্শিয়ানদের ধর্মমতে ভালো-মন্দের প্রভু একজন নয়; দুজন। তাদের প্রত্যেকের অধীনে রয়েছে অসংখ্য ফিরিশতা। এ দু’শ্রেণির প্রভু নিজ নিজ সৈন্য-সামন্তসহ সর্বদাই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। এমনিভাবে তারা ফিরিশতাদের মধ্যে নর-নারীর অস্তিত্বও স্বীকার করে। বলে, নারী ফিরিশতা নর ফিরিশতার স্ত্রী।
ইহুদি জাতি ফিরিশতাদের করভীম বলে। বিশিষ্ট ফিরিশতাদেরকে জিব্রাঈল, মীকাঈল ইত্যাদি নামে অভিহিত করে। তারা সম্মান-মর্যাদায় মস্তক অবনত করে তাদেরকে এমনভাবে আহ্বান করে যেমনটি করা কর্তব্য কেবল আল্লাহর শানে। খ্রিষ্টান জাতিও ফিরিশতাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে। বিশেষ বিশেষ ফিরিশতাকে জিব্রাঈল রূহুলকুদ্স ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে।
হিন্দু ধর্মে ফিরিশতাদের সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভট ধারণা রয়েছে। জাহিলি যুগের পূর্বে আরবরা ফিরিশতাদের আল্লাহর কন্যা বলত। তাদের পূজা-অর্চনা করত। আরো মনে করত, তারা আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য সুপারিশ করবে।
ইসলাম ফিরিশতাদের সম্বন্ধে এ সকল মতাদর্শকে ভ্রান্ত ধারণা ও অসার ঘোষণা করেছে। এসবের মূলোচ্ছেদনে কুরআন মাজিদের বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। প্রমাণ করা হয়েছে, প্রভুত্বের কোনো গুণ ফিরিশতাদের মধ্যে নেই। তারা আল্লাহ তায়ালার বান্দা। আল্লাহর নির্দেশ পালনই তাদের একমাত্র কাজ। তার নির্দেশের বাইরে পৃথিবীতে কোনো রূপ হস্তক্ষেপের অধিকার তাদের নেই। সুতরাং তাদের উদ্দেশ্যে ইবাদত-বন্দেগি ও পূজা-অর্চনা করা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়েয।
ফিরিশতা শব্দের আরবি প্রতিশব্দ ‘মালায়িকা’ (مَلَآئِكَةٌ)। শব্দটি বহুবচন। একবচন ‘মাকাক’ (مَلَكٌ)। অর্থ, বার্তাবাহক। পরিভাষায় ফিরিশতা বলা হয়,
جِسْمٌ نُوْرَانِىٌّ مُتَشَكِّلٌ بِاَشْكَالٍ مُخْتَلِفَةٍ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ.
ফিরিশতা নূরের তৈরি মাখ্লূক। তারা বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে থাকেন। আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করেন না। সদা সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ পালনে রত থাকেন।
ফিরিশতাদের প্রতি ঈমানের মৌলিক বিষয়
১. ফিরিশতাগণ আল্লাহ্ তায়ালার এক সম্মানিত সৃষ্টি। তারা নূরের তৈরি।
২. তারা পুরুষও নন, নারীও নন। তারা কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি রিপু থেকে মুক্ত। তাদেরকে নারী বা পুরুষ বলা যায় না। এ বিষয়ে কুরআন-হাদিছের কোনো ভাষ্য উল্লেখ নেই।
৩. তারা বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারেন। হযরত জিব্রাঈল আ. বিভিন্ন রূপে রাসূলুল্লাহ-এর দরবারে হাজির হতেন। অধিকাংশ সময় তিনি হযরত দেহ্ইয়া কাল্বি রাযি.-এর রূপে আসতেন। হাদিছে জিবরাঈল নামে প্রসিদ্ধ হাদিছে তার জনৈক বেদুঈনের বেশে আসার কথা বর্ণিত আছে।
৪. তাদের কোনো সন্তানসন্ততি নেই।
৫. তারা সংখ্যায় অনেক। হাদিছে বর্ণিত আছে, সাত আসমানের সর্বত্র অসংখ্য ফিরিশতা ইবাদতে রত আছেন। সামান্য অর্ধহাত স্থানও খালি নেই। তাদের প্রকৃত সংখ্যা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,
وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ
‘তিনি (আল্লাহ্) ছাড়া তোমার প্রতিপালকের সৈন্যবাহিনী [ফিরিশতা] সম্পর্কে কেউ অবগত নয়।’ (সূরা মুদ্দাছছির : ৩১)
৬. আল্লাহ্ তায়ালা তাদের বিপুল শক্তির অধিকারী বানিয়েছেন।
৭. আল্লাহ্ তায়ালা তাদের সৃষ্টি করে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করেছেন। কতিপয় নিযুক্ত আছেন আযাবের কাজে ও কতিপয় রহ্মতের কাজে। কতিপয় নিযুক্ত আমলনামা লেখার কাজে। বলা হয় তাদেরকে ‘কিরামান কাতিবীন’। কতিপয় নিয়োজিত আল্লাহর আরশ বহনের দায়িত্বে। মোটকথা, এভাবে সৃষ্টির বিভিন্ন কাজে আল্লাহ্ তায়ালা ফিরিশতাদের নিযুক্ত করে রেখেছেন।
৮. ফিরিশতাগণ নিষ্পাপ। সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ মতো কার্য সম্পাদন করেন। তারা আল্লাহর আদেশের বিন্দুমাত্র অন্যথা করেন না। আল্লাহ অবাধ্যতাও করেন না কখনো। প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। এ ব্যাপারে কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে,
لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ.
তারা আগে বেড়ে কথা বলে না। তারা তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করেন।
(সূরা আম্বিয়া : ২৭)
لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَلَا يَسْتَحْسِرُونَ.
‘তারা ইবাদত করা থেকে বিমুখ হন না; ক্লান্তিও বোধ করে না। (সূরা আম্বিয়া : ১৯)
ইবলিস আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করেছিল বলে ফিরিশতা হতে অবাধ্যতা প্রকাশ পাওয়া প্রমাণিত হয় না। কেননা বিজ্ঞ আলেমদের মতে ইবলিস ফিরিশতা নয়। সে ছিল জিনদের অন্তর্ভুক্ত। এক আয়াতে বলা হয়েছে,
كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّه.
‘সে ছিল জিনদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর সে তার প্রতিপালকের নির্দেশের অবাধ্যতা করল।’ (সূরা কাহফ : ৫০)
তদুপরি কুরআন মাজিদে ইবলিসের সন্তান আছে বলেও উল্লেখ রয়েছে। এটাও তার ফিরিশতা না হওয়ার দলিল। কেননা ফিরিশতাদের সন্তান হয় না। উপর্যুক্ত আয়াতেই আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন,
أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ.
“তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্র“।” (সূরা কাহ্ফ : ৫০)
এ ছাড়া ইবলিসের দ্বারা অবাধ্যতা হওয়াও তার ফিরিশতা না হওয়ার প্রমাণ। কেননা ইতোপূর্বে বলা হয়েছে, ফিরিশতাগণ আল্লাহর অবাধ্যতা করেন না।
হযরত হারূত ও মা’রূত বিশুদ্ধ মতানুসারে দুজন ফিরিশতা ছিলেন। তাদের দ্বারা কোনো কুফ্রি বা কবিরা গুনাহ সংঘটিত হয়নি। তাদের শাস্তি গোনাহের কারণে নয়, বরং সেটা তিরস্কার স্বরূপ হয়েছে। যেমনি নবীদের বিচ্যুতির ফলে তিরস্কার হয়ে থাকে। তদুপরি উক্ত ফিরিশতাদ্বয়ের সাথে জোহরা নাম্নী নারীর প্ররোচনার সংক্রান্ত হাদিছটি ইমাম বায়যাবি রহ. প্রমুখ বিশুদ্ধ নয় বলে মন্তব্য করেছেন।
সবচেয়ে বড় ফিরিশতা
১) হযরত জিবরাঈল আ.। তিনি ওয়াহি ও আল্লাহর আদেশ বহন করে নবীদের নিকট নিয়ে আসতেন। এ ছাড়া আল্লাহ্ যখন যে নির্দেশ প্রদান করেন, তা দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিরিশতাদের নিকট পৌঁছে দেন।
২) হযরত মিকাঈল আ.। তিনি মেঘ প্রস্তুত করা, বৃষ্টি বর্ষাণো এবং আল্লাহর নির্দেশে মাখ্লূকের জীবিকা সরবরাহের দায়িত্বে নিযুক্ত।
৩) হযরত ইসরাফীল আ.। তিনি রূহ সংরক্ষণ ও শিঙ্গায় ফুঁক দিয়ে দুনিয়াকে ভাঙা-গড়ার দায়িত্বে নিযুক্ত।
৪) হযরত আযরাঈল আ.। তিনি জীবের প্রাণ হরণের কাজে নিযুক্ত। হাদিছে তাকে ‘মালাকূল মউত’ বলা হয়েছে। আছারে সাহাবায় আযরাঈল নামটি পাওয়া যায়। হযরত ইব্নে আব্বাস রাযি.-এর বর্ণনা মতে রূহ কবজ করার সময় হযরত আযরাঈল আ.-কে কারো কাছে আসতে হয় না; সারা পৃথিবী একটি গ্লোবের মতো তার সামনে অবস্থিত। যার জীবনায়ু ফুরিয়ে যায়, নিজ স্থানে হতেই তিনি তার রূহ কবজ করে নেন। তবে মৃতব্যক্তি নেককার হলে রহ্মতের ফিরিশতা আর বদকার হলে আযাবের ফিরিশতা মৃতের নিকট এসে থাকেন এবং মৃতব্যক্তির রূহ নিয়ে যান।
লেখক: মুহাদ্দিস, ইমাম ও প্রাবন্ধিক