এ এস এম মাহমুদ হাসান
প্রতিবেদক
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণের বৈজ্ঞানিক সূত্র সর্বজন স্বীকৃত। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ইংরেজ বেনিয়াগোষ্ঠির দখলে যায় পুরো ভারতবর্ষ। এই ভারতবর্ষ ইংরেজমুক্ত করতেই ভারতের দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাধারণ ইতিহাস আমাদের সকলেরই কম বেশি জানা।
১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই দেওবন্দী সেলসেলার কর্ম পরিকল্পনায় আজ অবধি তেমন নতুনত্ব লক্ষ করা যায়নি। মূলত সাম্রাজ্যবাদী চেতনা ও সরকারি পর্যায়ে উপনেশবাদী শাসনের প্রতিরোধেই মাদরাসার সৃষ্টি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ইসলামপন্থীরা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইসলাম বিদ্বেষীদের প্রপাগাণ্ড রুখতে বৈজ্ঞানিক যুগের সঠিক পন্থা অবলম্বন করছেন কি? হোমওয়ার্ক কষে তারা তাদের কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ করছেন কি?
গত ১১ এপ্রিল রাষ্ট্রদরবার থেকে কওমি সনদের এম.এর মান প্রদান ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্কর্য সরানোর অভিপ্রায়ের বিরোধিতাকারীদের জবাবে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম নেই বললেই চলে। জনমত তৈরিতে বিপুল কার্যকরী এই মিডিয়ার অভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে ধার্মিক মহলে।
সাম্প্রতিক সময়ে অধিকাংশ ইলেক্ট্রিক মিডিয়ার টকশোতে ইসলামি গবেষকদের আলাপ আলোচনা সবার নজর কেড়েছে। ইউটিউবে আপলোড হওয়া মুফতি ফয়জুল্লাহর আলোচিত টকশো সপ্তাহান্তে দেখা হয়েছে দশ লক্ষাধিকবার। এছাড়া আলেমদের পক্ষে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবি ও শ্রেণি পেশার মানুষের তর্কের ইউটিউবের ভিডিও রেকর্ড পরিমাণ প্রদর্শিত হয়েছে। এরপর থেকেই মানুষের মাঝে ইসলামের চাহিদা পূরণে স্বতন্ত্র ইলেক্ট্রিক মিডিয়ার অভাব ফুটে উঠছে সবার আলোচনায়। অতুষ্টির আত্মসমালোচনায় নিজেদের ভবিষ্যৎ মিডিয়ার কল্পনা করছে ধার্মিক শ্রেণি।
বিজ্ঞানময় এই যুগে মিডিয়া পারে সত্যকে মিথ্যা, আর মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তর করতে। অপর দিকে সত্যকেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নিখাঁদ ভাবে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ, গেল বছর পুরো তুরষ্ককে কাঁপিয়ে তোলা সেনা অভ্যুত্থান ঠেকাতে জনপ্রিয় এরদোগান ব্যবহার করেছিলেন ইলেকট্রিক মিডিয়াকে। সিএনএন তুর্ক নামে একটি টিভি চ্যানেলে অভ্যুত্থান বিরোধী আহবান জানালে সাড়া দেয় তুরষ্কের জনগন। তাতেই সে যাত্রায় রক্ষা পান এরদোগান।
বর্তমান যুগে সমাজে মিডিয়ার ব্যপক চাহিদা ও প্রভাবের কথা স্পষ্ট। তারপরও বিভিন্ন মতবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এই যুগে কেন ধার্মিক জনগণের মাঝে প্রভাববিস্তারকারী প্রভাবশালী এই মিডিয়া কেন সৃষ্টি হচ্ছে না, সে প্রশ্নই খুঁজে বেড়িয়েছে আওয়ার ইসলাম।
ঢাকার একাধিক মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ও চিন্তক মুফতি মামুনুর রশীদ বলেন, ইসলামি শরিয়াহর মধ্যে থেকে একটি নিউজ চ্যানেল সৃষ্টি করা আলেম সমাজের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। বিতর্ক, প্রচারণা, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের এই যুগে মিডিয়া তৈরি ছাড়া আলেমদের জন্য লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব প্রায়।
প্রশ্ন করা হয়েছিল, মিডিয়া তৈরিতে বিপুল অর্থের যোগান কিভাবে হতে পারে? মুফতি মামুনুর রশীদের মতে, এটি যেহেতু আলেমদের নিরপেক্ষ মুখপাত্র হিসেবে কাজ করবে, সেহেতু কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড উদ্যোগ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে কওমি অঙ্গনের শিক্ষক ও ছাত্রদের মাঝে শেয়ার হোল্ডার তৈরি করলে খুব সহজেই একটি শক্তিশালী মিডিয়া তৈরি করা অসম্ভব কিছুই নয়। এটা শুধুমাত্র একটু সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও আন্তরিকতা থাকলেই সম্ভব।
তরুণ আলেম, গবেষক ও খতীব মুফতি সাঈদ আহমাদের মতে, নিজস্ব মিডিয়া তৈরির চেয়ে দক্ষ মিডিয়াকর্মী তৈরি করা জরুরি। তিনি বলেন, কওমি অঙ্গনের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত,মাদরাসার ছাত্ররা মুখোমুখি বিতর্ক, আলোচনা, দর্শক-শ্রোতা আকৃষ্টপূর্ণ সাবলীল উপস্থাপনা কিংবা তুলনামূলক কন্টক পন্থায় ইসলাম ও দ্বীন প্রচারে অভ্যস্ত নয়। সে কারণে স্বতন্ত্র মিডিয়া তৈরির আগে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।
তাছাড়া বর্তমানে মাদরাসার যে সকল ছাত্র বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করছেন, তাদেরকে বাধ্য হতে হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের মহিমান্বিত রূপ আলোচনার চেয়ে নাস্তিক, বামদের প্রচারে। ফলে আমাদের জনবল দ্বারা বাম লোকদের উত্থান ও প্রচারের কাজেই ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের এ ভুল পদক্ষেপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তিনি মনে করেন, বিতর্ক, প্রচারণা, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের এই যুগে মিডিয়া তৈরি ছাড়া আলেমদের জন্য লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব প্রায়।
মুফতি সাঈদ আহমাদ বলেন, যদি দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল ছাড়া মিডিয়া তৈরি করা হয়, তাহলে আমাদের সেই মিডিয়াও বামদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। একটি স্বতন্ত্র মিডিয়া পরিচালনা করার দক্ষশক্তি এখনো আমাদের মাঝে গড়ে ওঠেনি।
ইসলামী লেখক ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সৃজন-এর সম্পাদক আমিন ইকবাল বলেন, আল্লামা শামী রহ. বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের যুগ সম্পর্কে জানে না, সে মূর্খ। বর্তমান যুগে সর্ব দিক থেকে মিডিয়ার চাহিদা ব্যাপক। আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজ, দেশ ও পৃথিবী সম্পর্কে জানতে পারি। সুতরাং সঠিকভাবে পৃথিবীকে জানার জন্য, সমাজে ভালোটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিষ্ঠাবান মিডিয়ার প্রয়োজন আছে। আমরা মিডিয়াতে আমাদের সাজানো কোনো লেখা বা প্রতিবেদন পাঠালে সেটাকে কাঁটছাঁট করে তাদের মত করে প্রকাশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক মিডিয়ার নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতি বা মালিক পক্ষের চাহিদা থাকে। ফলে আমরা ইসলামি ঘরানার লেখকগণ মিডিয়া কর্তৃপক্ষের অযাচিত নীতির কারণে সঠিক তথ্যগুলো প্রকাশে বাঁধার সম্মুখিন হচ্ছি।
এখন সবাই চিন্তা করে নিজের গণ্ডিকেন্দ্রিক। ইসলামি ঘরানার মিডিয়া থাকলে আমরা আমাদের কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে আমাদের মত করে প্রকাশ করার স্কোপ পেতাম। মিডিয়া কারা তৈরি করবে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ইসলামি ঘরানার মিডিয়া তৈরি করতে সমাজের আলেম বিত্তবানদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
‘এক্ষেত্রে বড় যে বিষয় তা হলো সহযোগিতা। অতীতে দেখা গেছে এমন অনেক উদ্যোগ হয়েছে কিন্তু সবার সহযোগিতার অভাবে সেটি সামনে এগুতে পারেনি। আওয়ার ইসলামও সুন্দর স্বপ্ন দেখছে এবং সামর্থের সবকিছুই দেখাচ্ছে। সহযোগিতা পেলে এর মাধ্যমেও বড় কিছু হওয়া সম্ভব বলে মনে করি। সে ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা একান্তভাবে প্রয়োজন।’
সবার চাহিদাতেই যখন রয়েছে একটি নিজস্ব মিডিয়া তখন সেটি তৈরিতে এত বাধা কেন? অর্থের অভাব না জনবলের? সাধারণভাবে তো দেখা যায় দুটিরই অভাব নেই। কারণ মানুষ এখনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি যথেষ্ট আস্থাশীল। জনবলও রয়েছে। অভাব কি তাহলে সমন্বয়ের? প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে সবাইকে।
কওমি স্বীকৃতি ও মিডিয়ার বিমাতাসুলভ আচরণ