আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
এই যে সভ্যার চরম বিকাশে পৃথিবীর পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠেছে অনবদ্ধ তিলোত্তমা নগরী। গড়ে ওঠেছে আকাশচুম্বী প্রাসাদ। ক্রমাগত ঘুরছে উন্নয়নের চাকা। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শতবছরের দূরত্ব পরিনত হয়েছে চোখের পলকের মতো। মানুষ নামের পৃথিবীর অধিবাসীরা ছুঁয়ে এসেছে ভীনগ্রহের মাটি। জয় করেছে চাঁদের পাহাড়। এর পেছনে রয়েছে একটি মহাশক্তি। যার নাম শ্রম। যাকে আমরা সৌভাগ্যের প্রসৃতিও বলে থাকি। এই শ্রমই হচ্ছে কাঙ্খিত মাঞ্জিলের স্বপ্নশিড়ি। সাফল্যের রফরফ। এর বিরতিহীন শুভ যাত্রা শুরু হয়েছে সৃষ্টির সূচনালগ্নেই। আর বর্তমান শতাব্দীর উন্নতির মূলেও এই শ্রমের রয়েছে অনস্বীকার্য অবদান। তাই এই শ্রমকে বলা হয় নবসভ্যতার হাতিয়ার।
এছাড়াও পৃথিবীকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার পেছনে শ্রমের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। তাই একে পাশকাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই কারোরই। তাইতো পৃথিবীর প্রায় সকল মনীষী, সুশীল জনগোষ্ঠী শ্রমের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন একবাক্যে। আর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও এপ্রসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে নানান নীতিমালা। দেয়া হয়েছে উৎসাহ উদ্দীপনাও। এই যেমন- মানবতার পরম ধর্ম ইসলামে বলা হয়েছে- 'তোমাদের কারোর নিজ পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করা, কারো কাছে হাত পাতার ( ভিক্ষা করা) চেয়ে উত্তম। তাকে ( ভিক্ষা প্রার্থীকে) সে কিছু দিক বা না দিক।' (বুখারি : ২/৭৩০)
ইসলাম কিন্তু স্রেফ শ্রমকেই গুরুত্ব দেয়নি, গুরুত্ব দিয়েছে এর কারিগর অর্থাৎ যাদেরকে আমরা শ্রমীক নামে অবহিত করি তাদেরকেও। ইসলামে তাদেরকে দেয়া হয়েছে সর্বোত্তম মর্যাদা। কেন না এই পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতার চাদরে, প্রতিটি নগরীর সুউচ্চ প্রসাদের দেয়ালে দেয়ালে মিশে আছে তাদেরই রক্ত-ঘাম। তাদের তৈরি কাপড় পরিধানেই অামরা হয়েছি ভদ্র। তারাই দিনরাত হাতুরি দিয়ে পাথর ভেঙে তৈরি করছে বহুতল ইমারত। যে লোহার স্বভাবধর্ম জলে ভাসতে না পারা, সে লোহার তৈরি জলযান তারা ভাসাচ্ছেন অকুল সাগরে। আবার তাদের তৈরি মহাশূন্যযানেই অামরা পাড়ি দিচ্ছি পৃথিবীর সীমারেখা, ছুঁয়ে আসছি সপ্তম আসমান।
তাই রাসূল রাসূল সা. তাদের প্রাপ্যতা দ্রুত পরিশোধ করার জন্য বলেছেন, 'শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও।' (ইবনে মাজাহ : ২/৮১৭)
এই নবসভ্যতার পয়গাম্বর তথা শ্রমীকদের প্রচেষ্টাতেই বদল হয় পৃথিবীর প্রচ্ছদ। আমাদের জীবনের প্রতিটি সেক্টরেই আছে এদের রক্তমাখা অবদান। কিন্তু অাফসোসের কথা হচ্ছে, এতো কিছুর পরও এই শ্রমীক শ্রেণিটি আমাদের কাছে নিগ্রহ ছাড়া আর কিছুই পায় না। যুগযুগান্তরে পৃথিবীর কতো কিছুর বদল হলেও বদল হয়নি তাদের বৈষম্যের অবিধান। কবির ভাষায়- 'ওরা রক্তকে করে ঘাম তবু পায়না তার দাম।'
ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবার কাছেই অবহেলিত এই দেশ গড়ার কারিগররা। কিন্তু কেন? কেন এই হীনমন্যতা?
যে গৃহপরিচারিকা তার মালিকের শিশুটিকে এতোটুকুন বয়স থেকে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করছে, সেই শিশুই তাকে 'বুয়া' বলে সম্বোধন করছে। 'বুয়া' বলে তাকে মানুষ থেকে আলাদা করা হচ্ছে। আর এতে যেন দোষেরও কিছু নেই। বরং সভ্যতার সংবিধানে এই সম্ভোদনই যেন তাদের অপরিবর্তিত তাকদির। কারণ এরা শ্রমিক। টাকার বিনিময়ে শ্রম বিকায়। সুতরাং এদের সম্মানের প্রশ্নই উঠে না।
আচ্ছা! তাদের এই স্নেহ ভালোবাসার মূল্য কি স্রেফ অর্থের মাপকাঠিতেই মাপতে হবে? মানুষ হিসেবেও কি তারা এতটুকুন সম্মান পেতে পারে না? নাকি তারা কাজের লোক বলে মানুষ হিসেবেই গণ্য নয়? অথচ-
ওরাও মানুষ আমাদের মতো
ওদেরও রক্ত লাল
ওরা আছে বলেই আমরা
সুখি এতটা কাল।
ভেবে দেখুনতো, যদি এই কাজের লোকগুলো না থাকতো, তাহলে আপনার অবস্থা কেমন সূচনীয় হতো! অাপনার পরিবারের রান্নাবান্না, কাপড়কাচা, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন রাখা থেকে শুরু করে আপনার অফিস পর্যন্ত যেসব কাজগুলো এরা আপন মমতায় নিবিড়ভাবে সম্পাদন করে থাকে তার কী হতো?
এই যে সে আপনার এই কাজগুলোকে আপন মমতায় সুচারুভাবে করে রাখছে এর বিনিময়ে সেকি আপনার কাছে মাইনে ছাড়াও আর কিছু পেতে পারে না? অন্ততপক্ষে একটি ধন্যবাদ। অথচ আপনারই কাজ করতে গিয়ে এই লোকটির যদি সামান্য ত্রুটি হয়ে যায়, তখন আপনি তার জন্য হয়ে যান সাক্ষাৎ অগ্নিমূর্তি। তার দেহ হয়ে যায় আপনার রণক্ষেত্র। আপনি ভুলে যান রাসূল সা. এ ব্যাপারে কঠিনভাবে হুশিয়ার করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন- 'সাবধান থাকবে নামাজ ও তোমাদের অধীনস্থদের বিষয়ে।' (ইবনে মাজাহ : ১/৫১৯)
ভুলে যাবেন না, ভুল মানুষেরই হয়। আপনারও হয়। তাই ভুলকে ক্ষমা করে দেওয়াই প্রকৃত মানবতা। মানবতার এই জয়োল্লাসেরর জন্যই নবীজী বলেছেন- 'তোমাদের কারো অধীনে যদি কেউ থাকে, তাহলে সে যেন নিজে যা খায় তাকেও তা থেকে খাওয়ায়। নিজে যা পরিধান করে তাকেও তা থেকে পরিধান করায়। এবং তোমরা তাদের ওপর সাধ্যের বেশি কাজ চাপিয়ে দিও না। যদি দাও তাহলে নিজেও সে কাজে তাকে সহযোগিতা করো।' (সহিহ বোখারি : ২৫৪৫)
অপর এক হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি নবী কারীম সা.কে জিজ্ঞেস করল- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার খাদেমের ভুলত্রুটি কতবার ক্ষমা করব? নবী কারীম সা. চুপ রইলেন। ঐ ব্যক্তি আবার জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার খাদেমকে কতবার ক্ষমা করব। নবীজী চুপ থাকলেন। তৃতীয়বার নবী কারীম সা. বললেন, 'দৈনিক সত্তরবার।' (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১২১, ৫১৬৪)
বলা বাহুল্য, অন্যান্য ধর্মপ্রবক্তাদের মতো নবী মুহাম্মাদ সা. স্রেফ নীতিকথা বলেই দায় মুক্ত হননি। বরং নিজজীবনে তা বাস্তবায়িত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ নবীজীর খাদেম হজরত আনাস রা. এর এই অমূল্য উক্তি। হজরত আনাস রা. বলেন, আমি মদীনায় দশ বছর নবী কারীম সা. এর খেদমতে ছিলাম। আমি কম বয়সের বালক ছিলাম। এজন্য আমার সমস্ত কাজ রাসূলের মন মতো হতো না। (অর্থাৎ বয়স কম হওয়ার কারণে অনেক সময় ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যেত) কিন্তু দশ বছরের এই সময়ের মধ্যে কখনও তিনি আমাকে 'উফ' পর্যন্ত বলেননি এবং কখনও বলেননি যে, এই কাজ কেন করলে বা কেন করলে না।' (সুনানে আবু দাউদ : ৪৭৪১ সহীহ বুখারী : ৬০৩৮)
তাই আসুন! শ্রমিক নামের এই মানুষগুলোকে সম্মানের সাথে দেখি। নিজ স্বার্থে শ্রেণীবিভাজন না করি। তাদের প্রতিও ভালোবাসাতবাসার হাত বাড়িয়ে দেই। হোক তারা যতোই নিম্নস্তরের শ্রমীক। তাদের সম্পর্কে কোনোপ্রকার হীনমন্যতা না পোষে, বরং তাদের অধিকার ও মর্যাদার প্রসঙ্গে সচেতন হই। ফলে তারাও তাদের সর্বোচ্চ শ্রম দিতে পিছপা হবে না। এতে করে 'মালিক-শ্রমীক' যে ঐক্যের সৃজন হবে, তাতে ভর করে এগিয়ে যাবে দেশ। গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন সমাজ। আমরা হয়ে উঠব সমৃদ্ধশালী জাতি। আর এটাই হোক অামাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক
[email protected]
সৌদি থেকে ফিরছে ১২ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক