বহু ধুরন্ধর ইঁদুরও কুপোকাত করেছেন কারি ফজলুল হক আকন্দ। গেল বছর ইঁদুর মেরেছেন প্রায় ২০ হাজার। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। লিখেছেন নিয়ামুল কবীর সজল
বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার রূপসীতে। ফজলুল হকের বয়স এখন ৫৫ বছর। ইঁদুর মেরেই জয় করেছেন এলাকাবাসীর মন। সমাদর পেয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের। প্রায় ১০ বছর ধরে ইঁদুর নিধনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে আসছেন তিনি। সারা দেশে তাঁর মতো সাফল্য বেশি চোখে পড়ে না।
শুরুর দিনগুলোর কথা
১৯৮৫ সালের দিকে ফজলুল হক ময়মনসিংহ শহরে যান ইমামতি প্রশিক্ষণ নিতে। তবে বাড়ি ফেরার আগে কৃষি, বনায়ন, পশুপালন, মত্স্য চাষ, প্রাথমিক চিকিৎসাসহ মোট ১০টি বিষয়ে তাঁর প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে গ্রামের ২০ জন লোক নিয়ে একটি সমবায় সমিতি গঠন করেন। প্রথমে তাঁরা একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করেন। তারপর উঁচু-নিচু চাষের জমি সমান করেন। এর পরও যেসব উঁচু জায়গা বাকি ছিল, সেগুলোতে ১০০ তালগাছ লাগান। তিন বছর পর গাছগুলো কিছুটা বড় হয়। কিন্তু ইঁদুরের জ্বালায় টিকতে পারছিল না। গাছগুলোর শিকড় কেটে দিচ্ছিল ইঁদুরগুলো। প্রায় অর্ধেক গাছ মারা পড়ে। ফজলুল হক বলেন, ‘আমি ভাবতে থাকি কিভাবে ইঁদুর থেকে গাছগুলো বাঁচানো যায়। একসময় মনে হলো বাবার কথা। নদীতে বাঁশের চোঙা দিয়ে বাইন মাছ ধরেন। আমি ভাবলাম বাঁশের চোঙা দিয়ে ইঁদুর ধরব। মাথায় চিন্তাটা ঘুরতে থাকল। ’
একপর্যায়ে জুতমতো চোঙা তৈরি করেন। চোঙার ভেতরে দেন কিছু শুকনো ধান। রেখে দেন তালগাছের গোড়ায়। প্রথম দিন দুটি ইঁদুর মারা পড়ে। পরের সাত দিনে ৮৪টি। কৌশলটি জানান গ্রামবাসীদের। ওই বছরই মানে ১৯৮৮ সালে সারা দেশে বন্যা হয়। তখন অবাক হয়ে ফজলুল হক দেখেন ‘পাইন্যা ইঁদুর’। তাঁর আখগাছ খেয়ে সাবাড় করছে। একেকটা বিড়ালের মতো বড়। সুযোগ পেলে মানুষকেও তাড়া করে। তখন তিনি কাঠ দিয়ে চোঙা বানান এবং ইঁদুর নিধনে সাফল্য পান। পরের বছর নিজের ঘরে দেখতে পান বাতারি (বাইট্যা বলেও ডাকে অনেকে) ইঁদুর। ছোট ছোট ইঁদুর বাক্সে রাখা সার্টিফিকেট খেয়ে ফেলে। ফজলুল হকের টার্গেট তখন বাতারির দল। এগুলো বেশ চালাক ইঁদুর। তিনি এবার বরই বাঁশের চোঙা বানালেন। ধরা খেয়ে গেল বাতারির দল।
এরপর গাছুয়া ইঁদুর
এগুলো স্রেফ ধুরন্ধর। লড়বেন কিভাবে ভাবছিলেন ফজলুল হক। বাড়ির ফলমূল কিছুই রেহাই পাচ্ছিল না। এগুলো উৎপাত করে রাতের বেলায়। এবার বুদ্ধি দিলেন ফজলুল হকের বাবা। গাছের ডালে ছোট ছোট মাচা বাঁধলেন। রাখলেন আধা পোড়া হিদল (চ্যাপা শুঁটকি)। গন্ধে ইঁদুর পাগলের মতো ছুটে এলো। ছয় টাকা দিয়ে কিনে এনেছিলেন আয়না কল। আর তাতেই ধরা পড়ল গাছুয়া ইঁদুর। সেটি ১৯৯৯ সাল।
নামডাক ছড়িয়ে পড়ল
২০০০ সাল। ইঁদুর নিধন এক্সপার্ট হিসেবে নাম হলো ফজলুল হকের। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা। কৃষিতে প্রতিবছরই ঘটা করে ইঁদুর নিধনকারী ব্যক্তিদের পুরস্কার দেওয়া হয়। ইঁদুর যেহেতু কৃষকের ক্ষতি করে, তাই ইঁদুর নিধনকারীরা কৃষকবন্ধু। কৃষি কর্মকর্তারা ফজলুল হককে লেজ সংগ্রহে রাখার পরামর্শ দিলেন। ২০০১ সালে ফজলুল হক ৪০০ ইঁদুরের লেজ জমা দেন। তারপর বছর বছর বাড়তে থাকে সংখ্যা। ২০০৬ সালে সাত হাজার ৭৫০টি লেজ জমা দেন ফজলুল হক। জেলায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।
২০০৭-০৮ অর্থবছরে তিনি নিধন করেন ১৩ হাজার ৫০০ ইঁদুর। ২০০৮ সালে ৩৭ হাজার ৪০৫টি ইঁদুর মেরে জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ২০১১ সালে ২৫ হাজার ৫২০টি ইঁদুর নিধন করে আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রথম হন। গেল বছর ১৮ হাজার ৫০০ ইঁদুর মেরে আবারও আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রথম হন। ফজলুল হক বলেন, তিনি চোঙা, কল, ফাঁদ ইত্যাদি ১০টি কৌশলে ইঁদুর মারতে পারেন। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রাজশাহী, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তিনি ইঁদুর নিধনের ওপর কৃষকদের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। তাঁর নিজ এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন ইঁদুর মারার ওস্তাদ হয়ে উঠেছে।
সূত্র: অবসরে
পদক-পুরষ্কার নিয়ে আক্ষেপ নেই, আমি নাম যশ খ্যাতির জন্য লিখিনি’
ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরাই জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে