আলমগীর নিষাদ : ‘শহিদ’ একটা ইসলামি মরতবা। ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জীবনদানকারীকে এই বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। ইসলামে শহিদের মর্যাদা সুমহান। গোর সওয়াল মাফ, তারা বিনা বিচারে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের মর্যাদায় ইসলামের এই ভাবাদর্শ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিহাসে এ ধরণের রূপান্তর ঘটে থাকে। এখন, বিশ্বের প্রায় সব ধর্ম-মতবাদের মানুষই ন্যায়যুদ্ধে নিহত সৈনিককে ‘শহিদ’ নামে অভিহিত করে। এই বিনির্মাণ মোটেও নিরীহ উপাখ্যান নয়।
নিহতের ক্ষেত্রে কেবল নয়, জীবিত মুক্তিযোদ্ধাকেও ‘গাজি’ হিসেবে গ্রহণ করেছে ‘বাঙালি মুসলমান’। ‘মরলে শহিদ বাঁচলে গাজি’- এই ছিল মুক্তিযুদ্ধে সৈনিকের আহবানমন্ত্র। নিহত মুক্তিযোদ্ধাকে শহিদদের রীতিতে কবর দেয়া হতো, বিনা গোসলে রক্তাক্ত পরিধানসহ। মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি- (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১০ এপ্রিল ১৯৭১) ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ধারণা ইসলাম থেকে পাওয়া। স্বাধীনতার আগ থেকেই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী সব আন্দোলনে শহিদের ‘লাশ’ বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে আনা হতো মাতমের জন্য। অর্থাৎ, বাঙালি মুসলমানের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের একটা ইসলামি বয়ান হাজির দেখা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্যুলার বয়ান এবং ইসলামপন্থার সাথে এর এখনকার যে দূরত্ব- তার নির্মিতি ঘটেছে স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক অভিঘাত বা মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে। বাঙালি মুসলমানের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ছিল ‘ন্যায়যুদ্ধ’ (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১০ এপ্রিল ১৯৭১) এবং এই ন্যায়যুদ্ধের ধারণা সে পেয়েছে ইসলাম থেকে। ইসলামি ভাবাদর্শ থেকে বাঙালি মুসলমান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি-কল্পে পাকিস্তানকে ‘জালিম সরকার’ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে সে নিজেকে আবিষ্কার করে নিপীড়িত ‘মজলুম’ হিসেবে। দেশপ্রেম তার কাছে হয়ে ওঠে ইমানের অঙ্গ।
[caption id="attachment_33254" align="aligncenter" width="500"] গণহত্যা’৭১[/caption]
মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামের ন্যায়যুদ্ধ
জামায়াতে ইসলামী এদেশের ইসলামপন্থীদের অন্যতম রাজনৈতিক দল। তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল। ‘বিপন্ন ইসলাম’ রক্ষার জন্য পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধকে ‘হিন্দুদের ষড়যন্ত্র’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুস্কৃতিকারী-কাফের-বেদ্বিন-দুর্বল মুসলমান’ আখ্যা দিয়ে ইসলামিবিশ্ব ও ইসলামপন্থীদের সমর্থন আদায় করে।
কওমি স্বীকৃতিকে কোনো সংকীর্ণ জায়গা থেকে দেখা উচিৎ হবে না: মিজানুর রহমান খান
স্বতন্ত্র কওমি ইউনিভার্সিটি হতে কোনো আইনি বাধা আছে বলে মনে করি না: অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান
পাকিস্তান ইসলামের পতাকা তুলে বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য-অধিকার অস্বীকার করেছে। সম্ভাবনা থাকলেও বাঙালি মুসলমান সমাজ এই অভিঘাতে ইসলাম-বিরূপের পথ বেছে নেয়নি। তারা নিজেদের মতো মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামি ভাবাদর্শে নির্মাণ করেছে। তবে বাঙালি মুসলমানের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ছিল সেক্যুলার মুসলমানদের হাতেই। এখানে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে যে ‘অমুসলিম-হিন্দু’ জনগোষ্ঠীকে সে তার মিত্র আকারে পায়। ১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলমান যেমন বাঙালি হিন্দুর কাছ থেকে আলাদা হতে চেয়েছে, ১৯৭১ সালে এসে সেই বাঙালি হিন্দুকে সে আপন হিসেবে গ্রহণ করে।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামী ন্যায়যুদ্ধের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকার ব্যাখ্যা দেয়নি। জামায়াত কখনো স্বজ্ঞানে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায়নি। মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়েই তারা ‘ইসলামি’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চেয়েছে! বাঙালি মুসলমান সমাজ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর এ ভূমিকায় সন্তুষ্ট ছিল না। আবার মুক্তিযুদ্ধও সমাজকাঠামোর পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। দেওবন্দি আলেমরাও জামায়াতের সঙ্গে তাদের ব্যবধান স্পষ্ট করতে সচেষ্ট হয়নি। ফলে আশাহত বাঙালি মুসলমানের কাছ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নিরঙ্কুশভাবে চলে যায় সেক্যুলারদের হাতে। বাড়তে থাকে ইসলামের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দূরত্ব। গত পয়তাল্লিশ বছরে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা এককভাবে মুক্তিযুদ্ধের সেক্যুলার বয়ান তৈরি করেছে। আর ইসলামপন্থীরা তৈরি করেছে ‘মুক্তিযুদ্ধহীন’ ইসলামি আন্দোলনের ধারা।
পয়তাল্লিশ বছর ধরে আমাদের ইসলামি নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ইসলামের এই দূরত্বকে উৎসাহিত করে গেছে। এটা হলো বাংলাদেশে ইসলামপন্থী আন্দোলনের ঐতিহাসিক সংকট। ইংরেজ আমলে বাঙালি মুসলমান ঔপনিবেশিক শিক্ষা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে ইসলাম এখানে জিহাদি কৃষকের সংস্কৃতি (লিবারেশন থিওলজি) নির্মাণ করে (এটা বাঙালি মুসলমানের প্রকৃত ‘রেনেসাঁ’কাল)। ‘তমদ্দুন মজলিস ‘সূচনা’ করেছে ভাষা আন্দোলন। অর্থনৈতিক-সামাজিক ন্যায়বিচার বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন করতে ‘মুসলিম লীগ’ পাকিস্তান আন্দোলন সংগঠিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক ভাবাদর্শ নির্মাণ করেছে ইসলাম।
আধুনিক ভারতের কৃষকবিদ্রোহ সমূহ- ফকির ও সন্ন্যাসী আন্দোলন (মজনু শাহ, ১৭৭০), ওহাবী আন্দোলন (তীতুমীর, ১৮৩১), ফরায়েজী আন্দোলনে (হাজি শরিয়তুল্লাহ, ১৮১৮/ দুদু মিয়া, ১৮৪০) ইসলামের উপস্থিতিসুস্পষ্ট।ক্ষমতারনৈতিকতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো ইসলামি লড়াই ও ভাবাদর্শ দ্বারাই উজ্জীবিত ছিল।
ইসলাম কখনো অন্যায়-যুদ্ধ সমর্থন করে না। সত্তরের ভোটে বিপুল বিজয় লাভের পরেও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ, ধর্ষণ- ইসলামরক্ষার নিমিত্ত হতে পারে না। ফলে, মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতার প্রশ্ন মীমাংসা না করায় এদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতি মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ইসলামপন্থী রাজনীতির এই ‘ব্যর্থতা’র কারণে পয়তাল্লিশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের সেক্যুলারায়ন ঘটা সম্ভব হয়েছে।
[caption id="attachment_33255" align="aligncenter" width="500"] ঢাকায় শান্তি কমিটির মিছিল[/caption]
যুদ্ধাপরাধের দায় নিয়েও জামায়াতের উল্লম্ফন আসলে এদেশে দেওবন্দিদের রাজনীতিবিমুখতার শূন্যস্থান পূরণ। দেওবন্দিরা বাঙালি মুসলমান সমাজের সবচেয়ে বড় ইসলামি ধারা। ব্রিটিশ-বিরোধী ও উদার ইসলামের দেওবন্দ আলেম মুক্তিযোদ্ধারা এখন ধর্মকর্ম নিয়ে কওমি মাদরাসায় ‘দন কিহোটে’র জীবন কাটান। ফলে তার মনে আছে ‘ইমান-আকিদাসর্বস্ব’ খণ্ডিত ইসলামের ঝোঁক।
বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার উদ্যোগ এসেছে ইসলামি সমাজ থেকেও, তমদ্দুন মজলিস পালন করেছে অগ্রণী ভূমিকা। জামায়াত নেতা গোলাম আযমও এই সামাজিক বিকাশের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। ১৯৭১ সালে দেওবন্দিরা (আজকের হেফাজতে ইসলাম) ঘোষণা করেছিল- এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা হলো জালিম আর মজলুমের যুদ্ধ। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ছোট ছোট ইসলামপন্থী দল এবং মুসলিম লীগের কিছু নেতা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করলেও দেওবন্দসহ আলিয়া মাদরাসার অনেক আলেম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ফতোয়া দেন, অংশ নেন সম্মুখসমরে। কিন্তু দেওবন্দিদের ‘লোকাল’ রাষ্ট্রপ্রকল্পহীন ইসলাম পালনের অভ্যাস ও ঔপনিবেশিক শিক্ষা, রোজগার ওরফে মডার্ন স্টেটের অর্থ ব্যবস্থা থেকে দূরে থাকার ইচ্ছার কারণে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ‘ভূমিকা’কেই এদেশের ইসলামি সমাজের রাজনৈতিক অভিমত হিসেবে ধরা হয়।
একাত্তরে এদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতি দারুণভাবে নৈতিক বৈধতা হারায়। যে কারণে, ১৯৭৩ সালে হযরত মুহম্মদকে (সা.) অবমাননা করে দাউদ হায়দারের একটা কবিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নিয়ে এদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির নবসূচনা করতে হয়। ২০১৩ সালেও ইমান-আকিদার দাবিতে জন অরণ্যে পরিণত মতিঝিল শাপলা চত্বর।
ইমান-আকিদার লড়াই্কে যারা ‘রাজনৈতিক’ লড়াই আকারে দেখার পক্ষে, তাদের অনুমান ভুল নয়; তবে ‘রাজনৈতিক ইসলামে’র অনুসন্ধানের চেয়ে তারা আসলে ইসলাম-তোষণের পথই বেছে নিয়েছেন। আবার, জামায়াতের ওপর আওয়ামী লীগের বৈরি আচরণকে ইসলামের ওপর পীড়ন আকারে দেখার প্রকল্প দ্বারাও কমবেশি প্রভাবিত হয় কেউ কেউ।
ইসলামে ন্যায়যুদ্ধের গুরুত্ব বুঝতে না পারার কারণে এদেশে মওদুদিবাদীরা একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে। ‘রাষ্ট্রপ্রকল্প’ ছাড়াই দেওবন্দবাদিরা কিন্তু রাজনৈতিক পরিপক্কতার সাক্ষ্য রাখে। জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক ভ্রান্তি পর্যালোচনার বদলে, নিপীড়িতের উসিলায় ইসলামিপন্থী রাজনীতির ‘প্রতিনিধি’ হয়ে ওঠার নৈতিক প্রশান্তি খুঁজছে।
একাত্তরে জামায়াতের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে মওদুদীবাদ মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় না। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ও পাকিস্তান আন্দোলনের ন্যায্যতাকে নাকচ করে না। কিন্তু নিজ জাতির বিরুদ্ধে অন্যায়যুদ্ধে অংশ নিয়ে জামায়াত ভয়ঙ্কর গুনাহ করেছে। এতে ইসলামি রাজনীতিতে তার নেতৃত্বের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়েছে। রাজনীতি ও অর্থ-সম্পদ পরিচালনায় নেতাদের ন্যায়পরায়নতার উদাহরণ- জামায়াতের রাজনৈতিক উপযোগিতা প্রমাণ করে না। জামায়াত কী তওবা পড়েছে? গৃহপালিত ঘোড়ার সঙ্গে প্রতারণা করার অপরাধে সাহাবীর বংশধরের কাছ থেকেও হাদিস গ্রহণ করেননি আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস ইমাম বুখারি।
চলবে...। আগামী পর্বে সমাপ্ত।
লেখক : কবি ও সংবাদমাধ্যমকর্মী