মাহফুয আহমদ
অতিথি লেখক, আওয়ার ইসলাম
ইবনে বতুতা বিশ্ববিখ্যাত একজন মুসলিম পর্যটক। তাঁর পূর্ণ নাম মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহিম। মরক্কোর তাঞ্জিয়া এলাকায় ৭০৩ হিজরি মোতাবেক ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্ম লাভ করেন।
তাঁর পিতা একজন ফকিহ ও বিচারক ছিলেন। তিনি নিজের ছেলেকেও এভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বস্তুত ইবনে বতুতা দ্বীনি শিক্ষায় আত্মনিয়োগও করেছিলেন। কিন্তু অত্যধিক ভ্রমণ সখ্যতা লেখাপড়ার শেষ পর্যন্ত তাঁকে পৌঁছতে দেয়নি।
২২ বছর বয়সে ৭২৫ হিজরি মোতাবেক ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি হজের উদ্দেশে বের হন। হজ শেষ করে বিশ্ব ভ্রমণের মিশন শুরু করে দেন। একাধারে ২৪ বছর দুনিয়ার বহু অংশ ভ্রমণ করে ৭৪৯ হিজরি মোতাবেক ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। এ দীর্ঘ সময়ে মরক্কো, আল জাজিরা, তিউনিসিয়া, তারাবলুস, মিসর অতপর ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, হিজায, তারপর ইরাক, ইরান, ইয়েমেন, আফ্রিকা, ওমান, বাহরাইন, হিন্দুস্তান, খুরাসান, তুরস্ক, আফগানিস্তান, চীন প্রভৃতি দেশ তিনি সফর করেন।
ইতোমধ্যে চারবার দীদারে বাইতুল্লাহ ও জিয়ারতে মদিনারও সৌভাগ্য অর্জন করেন। সে অনেক দীর্ঘ ইতিহাস। অবশেষে ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
ইবনে বতুতা রহ. তাঁর এ দীর্ঘ বিশ্ব ভ্রমণের কাহিনী লিপিবদ্ধ করে আমাদের জন্যে শিক্ষার অনেক উপাদান রেখে গেছেন। এটিকে ১৪শ শতকের পূর্ব, মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর সে ভ্রমণকাহিনী সম্বলিত গ্রন্থটির নাম হচ্ছে: ‘তুহফাতুন নুযযার ফি গারায়িবিল আমসার ও আজায়িবিল আসফার।’ তবে এটি ‘আর রিহলা’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ।
সুলতান আবু ইনান আল মারিনির আদেশে ৭৫৬ হিজরিতে মরক্কোর ফেজ নগরীতে ইবনু জুযাঈ আল কালবির হাতে তিনি এটি লেখান। গ্রন্থটি বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক লেখক, চিন্তক ও গবেষক প্রাচ্যের ধর্মীয়, ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি উৎস হিসেবে বইটি থেকে উপকৃত হন।
ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডেও (তখনকার বাঙ্গাল) ভ্রমণ করতে আসেন।
প্রথমে তিনি চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজার মেহমান হন। সেখানে রাজপ্রসাদে তাঁর মেহমানদারি করা হয়। একপর্যায় তাঁর সামনে পানসুপারি পেশ করা হয়। তৎকালীন সেখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন যে, পান দেওয়ার অর্থ হচ্ছে এখন বিদায়ের সময়। ইবনে বতুতা বলেন, ‘তারা আমার কাছে পানসুপারি নিয়ে এলো; বস্তুত এটা বিদায়ের আলামত।’ আর রিহলা, পৃ. ২২৫
যাইহোক, তিনি সেখান থেকে হযরত শাহ জালাল মুজাররাদে ইয়ামনি রাহ.'র সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে সিলেটের দিকে রওয়ানা হন।
হযরত শাহ জালাল রহ.কে তিনি কেমন দেখলেন- সেটার বৃত্তান্তও ‘আর রিহলা’ গ্রন্থে পেশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘শাহজালাল একজন বড় মাপের ওলি এবং অনুপম ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর অনেক প্রসিদ্ধ কারামাত এবং বড় বড় কীর্তি রয়েছে। তা ছাড়া তিনি অনেক দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন। শাহ জালাল নিজে আমাকে বলেছেন, বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা মুসতা'সিম বিল্লাহকে তিনি দেখেছেন এবং তার হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে শাহ জালালের শিষ্যগণ আমাকে অবহিত করেছেন, শায়খ একশত পঞ্চাশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রায় চল্লিশ বছরের মতো তিনি একাধারে রোজা রেখেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি প্রতি দশ দিন পরপর ইফতার করতেন; তাও আবার নিজের পোষা একটি গাভীর দুধ দিয়ে। সারারাত নফল নামাজ পড়তেন। হালকা-পাতলা শরীর আর দীর্ঘকায়ের লোক ছিলেন তিনি। এতদঞ্চলের লোকেরা তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এ জন্যে তিনি এখানেই অবস্থান করেন।’
লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে শাহ জালালের অবস্থানস্থল সিলেটের লোকদের প্রশংসা করেছেন। তাদের সেবা ও আচার ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। এদেশে সবকিছু সস্তায় পাওয়া যায়- এমন মন্তব্যও করেছেন। অনেক বস্তুর তৎকালীন বাজারমূল্যও তিনি উল্লেখ করেছেন ।
বিস্তারিত দেখুন: আর রিহলা; ইবনে বতুতা, পৃ. ২২১, ২২২, ২২৩ এবং অন্যান্য পৃষ্ঠা
আবদুল কাদের জিলানি রহ. এর মাজারে তাকি উসমানি
ইংরেজি শিক্ষকদের চেয়ে মাদরাসা শিক্ষকরা মেধাবী