যুবায়ের আহমাদ
কওমি মাদরাসার জন্য স্বীকৃতি একটা অতিরিক্ত বিষয়। স্বীকৃতি না হলে যে কওমি মাদরাসা মূল লক্ষ্য একেবারে ব্যহত হবে তা কিন্তু নয়। কিন্তু এমন এক সময়ে আবারো স্বীকৃতির বিষয়টা ‘টক অব দ্য টাইমে’ পরিণত, যখন এদেশের কোটি তওহিদী জনতার হৃদয়ে রাষ্ট্রের নেতিবাচক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে মারাত্মক রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। যেগুলোর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তওহিদী জনতা আন্দোলনও শুরু করেছে।
শুনছি ১১ তারিখ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কওমি স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নিয়ে জাতির সামনে হাজির হচ্ছেন। এ সুযোগে পাঠ্যপুস্তকে ইতিবাচক সংযোজন, শর্তসাপেক্ষে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬-এর পক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থান, প্রতি উপজেলায় ১টি করে মডেল মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের মতো বর্তমান সরকারের ইতিবাচক কাজগুলোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মোবারকবাদ জানানোর পাশাপাশি ইসলামের দৃষ্টিতে নেতিবাচক সিদ্ধান্তগুলো প্রত্যাহারের দাবিতে মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি ওলামায়ে কেরামের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল দরদ ও আন্তরিকতা নিয়ে সরাসরি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বললে আশা করি কিছুটা হলেও কাজ হবে।
সমস্যাগুলো
১. জনস্বার্থে ধর্মীয় উপাসনালয় অধিগ্রহণের বিধান রেখে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন-২০১৭ এর খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। ০৩ এপ্রিল, ২০১৭ সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। আগের আইন অনুযায়ী উন্নয়ন কাজের জন্য কোনও মসজিদ/মন্দির অধিগ্রহণ করা যেতো না। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী জনস্বার্থের দোহাই দিয়ে মসজিদও অধিগ্রহণ করা যাবে। ভাবখানা এমন যে মসজিদ কোনো জনস্বার্থ নয়। অথচ জনস্বার্থেও মসজিদ স্থানান্তর জায়েজ নয়। স্থানান্তর করার অর্থ দাঁড়াবে নতুন মসজিদ নির্মাণ এবং পুরোনোটি আপন স্থানে রেখে দেওয়া।
২. মঙ্গল শোভাযাত্রা বাধ্যতামূলক করা। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর গত ১৬ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এর সহকারী পরিচালক আশেকুল হক স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাধ্যতামূলক করা হয়।
বাংলাদেশের প্রায় ৯৩% মানুষ মুসলমান। মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্পূর্ণ ইসলামী চেতনা বিরোধী। বাংলা নববর্ষের সঙ্গেও এর কোনো সম্পর্ক নেই। হিজরি সালকে মূল ধরে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে ফসল রোপন, খাজনা প্রদান ইত্যাদির সুবিধার্থে এর সৌর রূপ হিসেবে সম্রাট আকবর চালু করেন বাংলা সাল। ৪৩৩ বছর আগে চালু হওয়া বাংলা সালের সঙ্গে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও মঙ্গল শোভাযাত্রার কোনো দৃশ্যের সম্পৃক্ততা ছিল না। ১৯৮৯ সালে ঢাবির চারুকলা ইন্সটিটিউট প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা চালু করে। বিষয়টি স্পষ্ট যে, মঙ্গল শোভাযাত্রা যেমন ইসলামী ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক, তেমনি হাজার বছেরর বাঙ্গালী ঐতিহ্যের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক নেই। তবু এদেশের ৭% হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান চাইলে মঙ্গল শোভাযাত্রা করতেই পারে। তাদের সঙ্গে নিজেদের ধর্মকে অবহেলাকারী ২-৩ ভাগ বিকৃত মস্তিস্কের অধিকারী ‘প্রগতিশীল’ ও নামধারী মুসলমানও চাইলে যোগ দিতে পারে সেই শোভাযাত্রায়। কিন্তু এই ১০% (৭+৩) মানুষের চিন্তাকে বাকি ৯০% ইসলামপ্রিয় মুসলমান নাগরিকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের সন্তানদের জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বাধ্যতামূলক করা কি নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন নয়? নাকি এই ৯০% মুসলমানের মতামতের কোনো দাম নেই এ রাষ্ট্রে!
স্বীকৃতি বিষয়ে কোনো কোনো আলেমের অবস্থান বিপক্ষে হলেও উল্লিখিত বিষয়গুলোতে নিশ্চই সবাই মনোক্ষুণ্ন। স্বীকৃতি কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা শীর্ষ আলেমদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম থেকে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবেন সেই দাবি রাখছি।
পাশাপাশি কওমির একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে একটি প্রস্তাবনাও পেশ করছি। তা হলো, শুধু তাকমিলের না হয়ে স্বীকৃতি হোক স্তরভিত্তিক। কারণ স্তর ভিত্তিক না হলে যে ছাত্রটি মিশকাত জামাত পড়ার পর কোনো কারণে লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে পারল না, মাত্র একটি বছরের কারণে তার দ্বীর্ঘ ১৫-১৬ বছরের ছাত্রজীবন কোনো স্বীকৃতিই পাবে না। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার এ সময়েও এ ছাত্রটি ১৬ বছর লেখাপড়া করেও প্রাথমিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত নয় বলে বিবেচিত হবে।
৫টি স্তরে বিন্যসিত হবে এ শিক্ষাধারা। ৫ বছরের ইবতেদাইয়্যাহ (প্রাথমিক), ৫ বছরের মুতাওয়াসসিতা (মাধ্যমিক), ২ বছরের সানাবিয়্যাহ উলইয়া (উচ্চ মাধ্যমিক), ৪ বছরের ফজিলত (স্নাতক) এবং ১ বছরের তাকমিল (স্নাতকোত্তর)। এ স্তরগুলোর মধ্যে শুধু ইবতেদাইয়্যাহ (প্রাথমিক) স্তর উত্তীর্ণরা আলিয়া মাদরাসা/স্কুল-কলেজে ৬ষ্ঠ শেণিতে ভর্তি হতে পারবে। কিন্তু মুতাওয়াসসিতাহ (মাধ্যমিক) পাশ করে কোনো ছাত্র আলিয়া মাদরাসা/কলেজে আলিম বা উচ্চমাধ্যমিক (ইন্টারমেডিয়েট)-এ ভর্তি হতে পারবে না এবং সানাবিয়্যাহ উলইয়া (উচ্চ মাধ্যমিক) পাশ করেও কোনো ছাত্র আলিয়া মাদরাসা/কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাজিল অথবা ডিগ্রি/অনার্সে ভর্তির সুযোগ পাবে না।
কওমি স্বীকৃতির ঘোষণা অনুষ্ঠানে যারা থাকছেন
তবে ধর্মীয় যেসব চাকরির ক্ষেত্রে আলিম বা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ লোকেরা চাকরির আবেদন করার সুযোগ পান সানাবিয়্যাহ উলইয়া পাশকৃতরাও সেসব চাকরিতে আবেদনের সুযোগ পাবেন এবং যেসব চাকরির ক্ষেত্রে ফাজিল/অনার্স (ইসলামিক স্টাডিজ) পাশ হতে হয় সেসব ক্ষেত্রে ফজিলত (মিশকাত) পাশ করে আবেদন করতে পারবেন। অর্থাৎ কওমি মাদরাসার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতকের সনদ চাকরির ক্ষেত্রে সমমান হবে কিন্তু ভর্তির ক্ষেত্রে সমমান হবে না। কেননা যদি তাদেরকে আলিয়া/কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয় তাহলে ছাত্ররা ইলমের একনিষ্ঠ চর্চা ছেড়ে দিয়ে আলিয়া/বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচেষ্টায় লিপ্ত হবে। মাহরূম হবে ইলমে নববী থেকে। আর এভাবে দলে দলে ছাত্ররা আলিয়া মাদরাসা/কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে কওমি ধারার ইমেজ নষ্ট হবে। ফজিলত ও তাকমিলের ক্লাসগুলোর ছাত্র কমে যাবে। যেমনটি বর্তমানে আলিয়া মাদরাসার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ছাত্ররা আলিম পাশ করে আর মাদরাসায় থাকছে না। চলে যাচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে ফাজিল ও কামিলে ছাত্র সংখ্যা একেবারেই কম। তবে কওমির প্রাথমিক স্তর থেকে পাশ করা ছাত্রদেরকে স্কুল-কলেজে ভর্তির সুযোগ দেয়া হবে এজন্যই যেন কোনো এলাকার প্রতিটি শিশুই চাইলে তার প্রাথমিক শিক্ষার চাহিদা কওমি থেকে পূরণ করতে পারে। তাহলে গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক কওমি মাদরাসা চালু হবে। প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি বাধ্যতামূলক দ্বীনি শিক্ষাটাও নিশ্চিত হবে। তাছাড়া স্তরভিত্তিক স্বীকৃতি হলে কোনো ছাত্র মুতাওয়াসসিতাহ (মাধ্যমিক) পাশ না করে সানাবিয়্যাহ উলইয়া মারহালাতে (উচ্চ মাধ্যমিক) যেমন ভর্তি হতে পারবে না তেমনি ফজিলত পাশ না করেও তাকমিলে ভর্তি হতে পারবে না। ফলে মাধ্যমিক স্তর থেকে (মাঝখানের ক্লাসগুলো না পড়েই) লাফ দিয়ে তাকমিলে (স্নাতকোত্তর) ভর্তির প্রবণতা বন্ধ হবে। এতে শিক্ষার মানটাও ভালো হবে।
কওমি মাদরাসায় শিক্ষিত আদর্শ ও মেধাবী জনশক্তিকে গণমানুষের কল্যাণে আরো কাজে লাগাতে সরকার একান্তই তাদেরকে জেনারেল শিক্ষার সুযোগ দিতে চাইলে তাকমিল (দাওরায়ে হাদিস) সনদকে ভর্তির ক্ষেত্রে মাধ্যমিকের মান দিতে পারে। অর্থাৎ কোনো ছাত্র তাকমিল (দাওরায়ে হাদিস) পাশ করার পর জেনারেল (স্কুল-কলেজের সাধারণ) শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত হতে চায় তাহলে যেন উচ্চ মাধ্যমিকে (ইন্টারমেডিয়েটে) ভর্তি হতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়; কন্ট্রিবিউটর, ডেইলি সান
শায়খ খুযাইম ও বৃত্তবন্দি আমাদের কওমিয়ান!