রোকন রাইয়ান: আমির ও মহাসচিব দ্বন্দ্বে আবারো ভাঙলো প্রাচীন ইসলামি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। গত বৃহস্পতিবার মাওলানা জাফরুল্লাহ খানকে আমির ও মুহিব্বুল্লাহ আশরাফকে মহাসচিব করে দলের একাংশ ৪০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করে।
পুরানা পল্টনে এক রেস্তোরাঁয় খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি পরিষদের সম্মেলনে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়। আবু জাফর কাসেমীর সভাপতিত্বে সম্মেলনে মুফতি শামসুল হক, মধুপুরের পীর মাওলানা আবদুল হামিদ, মুহাম্মদ আজম খান, মুহাম্মদ হোসাইন আকন্দ, নুরুল ইসলাম খান, কাজী মাসুদ আহমেদ, আবুল কাশেম কাশেমী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
এখন উভয়পক্ষ দাবি করছেন তাদের দলই সঠিক এবং উসুলে রয়েছে। মাওলানা জাফরুল্লাহ খান দাবি করছেন, যেহেতু তারা কাউন্সিল করেনি, বৈঠকে কমিটি হয়েছে তাই সেটি বৈধতা পাবে না। এদিকে মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী বলেছেন, দলে এমন সিনিয়র সদস্য অনেক আছেন, তারাও তো বের হয়ে গিয়ে আলাদা কমিটির ঘোষণা দিতে পারেন, তাই বলে কি সেগুলো ধর্তব্য হবে?
এদিকে সাধারণ মানুষ বিষয়গুলো নিয়ে ঠাট্টা করে বলছেন, যখন রাজধানী থেকে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর নামে রাস্তা উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে তখন দলটি আন্দোলন না করে পদপদবী নিয়ে দ্বন্দ্বে ব্যস্ত।
মাওলানা জাফরুল্লাহ খান দীর্ঘ দিন ধরে খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তবে গত জানুয়ারির নতুন কমিটিতে তাকে মহাসচিবের পদে দেখা যায়নি। নতুন করে মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী মহাসচিব নির্বাচিত হন। সেখান থেকেই দ্বন্দ্বের সূচনা বলে জানা যায়।
খেলাফত আন্দোলনের সবচেয়ে পুরনো ও পরিচিত মুখ হিসেবে মাওলানা জাফরুল্লাহ খানের নাম ডাক ছিল দল ও দলের বাইরে। কিন্তু হঠাৎ করে তাকেই মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেয়ায় বিস্মিত হন অনেকে। বিষয়টি দলের সদস্যদের বেশির ভাগই মানতে পারেনি।
তবে আলোচনা আছে, ২০১২ সালে সমমনা ১২টি ইসলামি দল নিয়ে একটি জোট গঠিত হয় যার সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন মাওলানা জাফরুল্লাহ খান। সে সময় ১২ দলের পেছনে জামায়াতের ইন্ধন এবং মাওলানা খান এর বিরুদ্ধে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠে। তখন থেকেই তিনি খেলাফত আন্দোলনে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। সেই থেকে গত দুই বছর তাকে রাজনীতিতে খুব একটা দেখা যায়নি। অথচ একসময় তিনি ইসলামপন্থী রাজনীতিতে বেশ আলোচনায় ছিলেন এবং রাজপথে তার সক্রিয় ভূমিকা মানুষকে নাড়া দিত।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মাওলানা জাফরুল্লাহ খান আওয়ার ইসলামকে বলেন, সমমনা ১২ দলের জামায়াত সংশ্লিষ্টতার কথা ভুল। আমরা ঈমানি দাবিতেই সে আন্দোলন করেছিলাম। মূলত আমার নিস্কৃয়তার মূলে রয়েছে মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী ও মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী।
তিনি বলেন, মাওলানা আতাউল্লাহ কোনো সাংগঠনিক ব্যক্তি নন। রাজনীতির সঙ্গেও তিনি খুব একটা জড়িত ছিলেন না। তাকে আমরাই গত দুই বছর আগে দলে এনেছি এবং এটাই আমরা চরম ভুল করেছি। তিনি দলে এসেই সবকিছু উলট পালট করতে থাকেন।
মাওলানা খান বলেন, দুই বছর আগে যখন খেলাফত আন্দোলনের কমিটি গঠন হবে তখন মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী মহাসচিব হওয়ার জন্য বিধি ভেঙে পোস্টার হ্যান্ডবিলসহ নানা প্রচারণা চালান। কিন্তু এত কিছু করেও তিনি মাত্র ১ ভোট পান। সেখান থেকেই তিনি ক্ষেপে যান এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, আমাকে মহাসচিব হতেই হবে। সে ধারাবাহিকতায় এ বছরের শুরুর কমিটিতে কোনো রকম ভোটের তোয়াক্কা না করেই আমির মাওলানা আতাউল্লাহ ঘোষণা দেন হাবিবুল্লাহ মিয়াজীই মহাসচিব।
মক্কা-মদিনার অতিথি : হাতে ফুল, চোখে কালো মেঘ
খেলাফত আন্দোলন থেকে বহিস্কারের বিষয়ে মাওলানা জাফরুল্লাহ খান বলেন, তারা তো আমাকে বহিষ্কারের কেউ না। আমি দলে ১৯৮১ সাল থেকে দলে যুক্ত। আমার সদস্য ফরম ৩৩। সদস্য ফরম অনুযায়ী আমার উপরে মাত্র একজন ব্যক্তি এখন জীবিত আছেন। তিনি চুয়াডাঙ্গার এলাহি বক্স। আমার কাছে হাফেজ্জি হুজুর স্বাক্ষরিত সদস্য ফরমও রয়েছে। সুতরাং আমাকে তো বহিষ্কার করতে পারেন না তারা। কেউ যদি স্বজনপ্রীতি বা স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে কমিটি করে, ভোট ছাড়াই মহাসচিব নির্বাচিত করে তাহলে তো নীতি থাকলো না।
নিজের দলের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা আমাদের সঙ্গে রয়েছে এবং থাকবে।
এদিকে খেলাফত আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে গণমাধ্যমকে জানানো হয় মাওলানা জাফরুল্লাহ খান ও মুহিব্বুল্লাহ আশরাফকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
তারা কী ধরনের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় খেলাফত আন্দোলন ঢাকা মহা নগরীর আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদীর কাছে। তবে তিনি বিষয়টি জানার জন্য মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। ফোন করা হয় মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজীর কাছে।
তিনি বলেন, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান দলের সিনিয়র সদস্য। তাকে আমরা যথাযথ সম্মান রেখে আমিরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদে রেখেছিলাম। কিন্তু তিনি এতে খুশি হননি। মূলত তিনি দীর্ঘ দিন ধরেই দলের ভেতর নানারকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছিলেন। আমাদের কর্মীদের মধ্যে নানাভাবে বিভাজন তৈরি করছিলেন। এ কারণে দলের সবাই তার ব্যাপারে নাখোশ ছিল।
মহাসচিব নির্বাচনে মাওলানা জাফরুল্লাহ খান স্বজনপ্রীতির যে অভিযোগ করেছেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী বলেন, গত কিমিটির আগে জনমত চাওয়া হলে তাকে কেউ মহাসচিব পদে চাননি। সেখানে আমার নাম একজন প্রস্তাব করেছেন। আমি প্রথমে রাজি ছিলাম না। কিন্তু আমির আমাকে নির্বাচিত করেছেন। আর তিনি তো দলে ২৮ বছর ধরে মহাসচিব আছেন। দলের কাজের অগ্রগতির জন্য তো এমন পরিবর্তন আসতেই পারে।
তিনি আরও বলেন, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান এত দীর্ঘ বছরে দলে ছিলেন, এতদিন দলের কোনো উন্নতি অগ্রগতি আসেনি। বরং তিনি হাফেজ্জী হুজুরের পরিবার নিয়ে নানারকম সম্মানহানীর কাজ করেছেন। এ কারণেই তার প্রতি দলের লোকজন আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।
খেলাফত আন্দোরন এর আগে একবার হাফেজ্জী হুজুরের দুই ছেলে শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ ও হামিদুল্লার দ্বন্দ্বে দুই ভাগ হয়েছিল। এবারের ভাঙ্গনকে মিডিয়াগুলো উল্লেখ করছে দুই নাতির দ্বন্দ্ব হিসেবে।
ইসলামী হুকুমত কায়েমের লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর দলটি গঠন করেন মরহুম মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.। খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাওয়াতে শরীক হতে দলমত নির্বিশেষে দলটিতে সবাইকে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। দ্বীনি দাওয়াতের পাশাপাশি রাজনৈতিক ময়দানেও অবদান রেখে গেছেন হাফেজ্জী হুজুর। বর্তমানে দলটি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল।
হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর দলের আমির নির্বাচিত হন মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে দলটির নেতৃত্বে আসেন মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী। বর্তমানে তিনিই আমিরের দায়িত্বে আছেন।
তবে বিশ্লেষকরা এও মনে করেন, মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফের নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন যতটা উর্ধ্বমুখী ছিল মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর নেতৃত্বে আসার পর সেটি ধীরে ধীরে নিন্মমুখী হচ্ছে। আর এর জন্য মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর সাংগঠনিক দক্ষতার কমতিকে দায়ি মনে করছেন তারা।
এসএস
খেলাফত আন্দোলনের আমীর মাওলানা আতাউল্লাহ মহাসচিব মাওলানা হাবীবুল্লাহ নির্বাচিত
তুরস্ক : উসমানী খেলাফতের সমাধি থেকে আজ [৩]