রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ইফার উলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলন: আমাদের কয়েকটি কথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদ লুতফেরাব্বী

গত বৃহস্পতিবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঢাকার সোহরাওয়ার্দীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল উলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলন। মক্কা–মদীনার সম্মানিত মেহমান ও দেশের লক্ষাধিক ইমাম–আলেমের অংশগ্রহণে একটি যুগান্তকারী অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্টরা ধন্যবাদ পেতেই পারে। তবে মহাসম্মেলনের পূর্বাপর পর্যালোচনা করলে কয়েকটি কথা না বললেই নয়, তেমনি কিছু কথা বলার জন্যই এ লেখা।

১. ৯০ ভাগ মুসলিমের এই দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে রয়েছে ইসলামের সুবাস। শহর–গ্রাম প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র মসজিদ–মাদরাসা ও আলেম–উলামা। সম্মেলনে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তালিকাভুক্ত যে ১ লাখ ৬ হাজার আলেম অংশগ্রহণ করেছেন এর বাইরেও দেশে অসংখ্য ইমাম–আলেম রয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকে এই জনপদের মুসলমানদের ইমান–আমল সংরক্ষণ ও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যাদের অবদান উপস্থিত কারো থেকেই কম নয়। যারা সরকারি সুবিধা বঞ্চিত হওয়া সত্যেও নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাই উলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলনের মত একটি অনুষ্ঠানে দেশের প্রতিনিধিত্বশীল শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামকে আমন্ত্রণ না করা নিঃসন্দেহে দায়িত্বশীলদের সংকীর্ণতার পরিচায়ক। দেশের প্রধান ধর্মীয় সংস্থা হিসাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জন্য এধরনের বিভাজনমূলক আচরণের পরিবর্তে ঐক্যের সেতুবন্ধনে এগিয়ে আসাই কল্যাণকর মনে করি।

২. বিশ্বজুড়ে ইসলামের উপর যে নানামুখী আগ্রাসন চলছে সে মুহূর্তে এমন একটি সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে সরকার দেশ–বিদেশের কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে চেয়েছে বলে মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তার বক্তব্যে ইসলামের পক্ষে অনেক কথা বলেছেন। আমরা চাই সরকারের এই বার্তা যেন শুধু মুখে নয়; কাজেও বাস্তবায়িত হয়। ইদানিং প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে যেভাবে ইমাম–খতিবদের নিয়ন্ত্রণ ও নযরদারির কথা শোনা যাচ্ছে ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগও নেয়া হয়েছে তা রীতিমত উদ্বেগের বিষয়।

দেশের অন্য পেশার কোনব্যক্তি অন্যায়ভাবে মারা গেলে সর্বমহলে হইচই পড়ে যায়। অথচ এই সরকারের আমলে অব্যাহতভাবে ইমাম-মুয়াযযিন হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলেও সরকার বা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

৩. সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, এ দুটি শব্দই ছিল সম্মেলনে সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সকল অতিথিরাই এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। মক্কা–মদীনার মেহমানগণ অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও যুক্তিনির্ভর ভাষায় ইসলামের শান্তি-সাম্যের শিক্ষা ও সন্ত্রাস বিষয়ে ইসলামের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। বৈশ্বিক পরিস্থিতির দাবীতে এই আলোচনা খুবই প্রয়োজনীয় ও অর্থবহ।

কিন্তু এখানে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, বাংলাদেশ সরকার ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা আলেম–উলামা ও মসজিদ–মাদরাসা কেন্দ্রিক যেকোন আয়োজনে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের উপর যে পরিমাণ কথা বলেন দেশের অন্যকোন অনুষ্ঠানে কেন বলেন না? স্কুল–কলেজ–ভার্সিটির অনুষ্ঠানসমূহে কেন একই গুরুত্বের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করা হয় না? মসজিদের ইমামের আলোচনা শুনে যদি কেউ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে ঘরে ২৪ ঘণ্টা টেলিভিশনের পর্দায় একশন-হরর মুভি দেখে উগ্র হওয়ার আশংকা কেন করা হয় না? ইসলামের শাশ্বত বিধানসমূহের ভুল ব্যাখ্যা উগ্রতার জন্ম দেয় বলে যদি তা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে, তাহলে একশন-হরর মুভির প্রদর্শন কেন বন্ধ হবে না?

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া জঙ্গি ঘটনায় জড়িতদের পরিচয় অনেক সত্যের পর্দা উন্মোচন করেছে। তারপরও মসজিদ–মাদরাসাকেই টার্গেট বানিয়ে একপেশে নীতি অবলম্বন কারো জন্যই সুফল বয়ে আনবেনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তার বক্তব্যে ইসলামের পক্ষে অনেক কথা বলেছেন। আমরা চাই সরকারের এই বার্তা যেন শুধু মুখে নয়; কাজেও বাস্তবায়িত হয়। ইদানিং প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে যেভাবে ইমাম–খতিবদের নিয়ন্ত্রণ ও নযরদারির কথা শোনা যাচ্ছে ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগও নেয়া হয়েছে তা রীতিমত উদ্বেগের বিষয়

৪, দেশের সরকারি মসজিদ–মাদরাসা পরিচালনা ও উন্নয়ন করা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রধান কাজ। এজন্য দেশব্যাপী সাড়ম্বরে ইমাম প্রশিক্ষণের আয়োজন করে তারা।  মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, হাফেজ-ক্বারীগণকে উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষার পাশা-পাশি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক বিষয়ে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দেয় বলে উল্লেখ করা আছে তাদের ওয়েবসাইটে। কিন্তু এই 'উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষা'র অবস্থা যে কতটা করুণ তার একটি নমুনা দেখা গেছে সম্মেলনে আরব মেহমানদের বক্তব্য অনুবাদের সময়। একজন উচ্চপদস্থ 'সরকারি' আলেমের ভাষাজ্ঞানের চিত্র যদি এই হয় তাহলে বাকিদের অবস্থা কি তা সহজেই অনুমেয়।

একজন ইমামের প্রধান শর্ত হলো বিশুদ্ধ তেলাওয়াত ও প্রয়োজনীয় আরবী ভাষাজ্ঞান থাকা। এই ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের বদলে কৃষি ও বনায়ন, প্রাণী সম্পদ পালন ও মৎস্য চাষ, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি, আদর্শ পরিবার গঠন, প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, নারী অধিকার, নারী-পুরুষের সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ, নারী ও শিশু পাচাররোধ, এইচআইভি এইডস ইত্যাদি বিষয়ে ইমামদের ব্যস্ত করা তাদের মূল দায়িত্বে অবহেলাই তৈরি করবে। তাই মানুষের কাছে সঠিক ইসলামের বার্তার ধারক ইমামদের কুরআন–সুন্নাহর জ্ঞানে পারদর্শী করা আবশ্যক।

শেষকথা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এই 'আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক বিষয়ে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ' ছাড়াও এদেশের লক্ষ লক্ষ ইমাম নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এদের অধিকাংশই কওমী মাদরাসার সন্তান। মহাসম্মেলনে তারা অমূল্যায়িত হলেও দেশের আপামর জনসাধারণের অন্তরে তাদের প্রতি রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন বা বিরূপ মনোভাব তাদের অবস্থান কখনোই ছোট করতে পারবেনা। উলামায়ে কেরামের রক্তঘামের বিনিময়ে ইসলামের যে বৃক্ষ বাংলার জমীনে সজীব তা সংরক্ষণে তারা সর্বদা সজাগ সচেষ্ট থাকবেন ইনশাআল্লাহ।

লেখক: এমফিল গবেষক, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর

মক্কা-মদিনার অতিথি : হাতে ফুল, চোখে কালো মেঘ

বাংলাদেশকে শান্তির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ কর: জুমার খুতবায় মদিনার ইমাম

ধর্ষিতা মেম্বারকে ঘরে নেবে না স্বামী!


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ