মুহাম্মদ আবদুর রহীম সাঈদ। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের সভাপতি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি চলতি শেসনের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্র মজলিসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে মানুষকে শুদ্ধতায় আনার প্রচেষ্টায় বিশ্বাস করেন। কওমি মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) শেষ করার পাশাপাশি কামিলও সম্পন্ন করেছেন। যুক্ত রয়েছেন অন্যান্য সামাজিক সাংগঠনিক কাজেও। মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তৃপ্তি পান। ভালো লাগে অন্যের জন্য কিছু করতে। বর্তমান ইসলামি রাজনীতি, নিজের চলার পথ এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন। পল্টনের এক রেস্তোরায় ঘরোয়া আলাপের সঙ্গে তার এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের নির্বাহী সম্পাদক রোকন রাইয়ান
ইসলামি রাজনীতির হাল হাকিকত কেমন যাচ্ছে এখন?
বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকালে শুধু ইসলামি কেন পুরো রাজনীতির অবস্থায়ই এখন বাজে। রাজনীতির মূল তো হলে ইসলামি রাজনীতি। পরে এর বিভিন্ন শ্রেণি বিন্যাস হয়েছে। গণতন্ত্র এসেছে। এখন যেটি বিশ্বে চলছে। কিন্তু এই গণতন্ত্র পরাশক্তি আমেরিকা থেকে শুরু করে কোনো দেশেই ভালো অবস্থায় নেই। আমাদের দেশে তো আরও খারাপ। সেটা সবার কাছেই পরিস্কার।
ইসলামি রাজনীতির বাংলাদেশে একটা উজ্জ্বল সময় অতিক্রম করার কথা ছিল এখন। কিন্তু তা নেই। এটিও নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে কিছুটা খারাপ সময় অতিক্রম করছে।
ছাত্র রাজনীতির প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলুন, এর কী অবস্থা?
ছাত্র রাজনীতির মূল কথাতো হলো ছাত্রদের দেখাশোনা তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলা ইত্যাদি। কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতিও খারাপ পথে হাঁটছে। দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি আর একে অপরের প্রাধান্য নিয়ে তোলকালাম অবস্থায়।
আমরা যারা ইসলামি ছাত্র রাজনীতি করি তারা প্রাণপণে চেষ্টা করছি সেই পরিস্থিতি থেকে ছাত্রদের ফিরিয়ে আনতে। ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করতে। ছাত্রদের মূল কাজ হলো শিক্ষা। শিক্ষায় সমস্যা হলে সবখানেই সমস্যা তৈরি হবে। বাংলাদেশে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম তাই এখানে মূল শিক্ষা থাকবে ইসলামি শিক্ষা। এখানে ইসলামি শিক্ষা বাদ রেখে অন্যকিছু চিন্তা করা যায় না। কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি ও সিলেবাসের মাধ্যমে ইসলামকে কোণঠাসা করার একটা চেষ্টা আগে থেকেই হচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে কাগজে কলমে এসেছে। আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করছি যেন এটিতে পরিবর্তন আসে। যদিও চলতি বছরের পাঠ্যসূচিতে আংশিক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পুরোপুরি হয়নি। এটি আবার আইওয়াশও হতে পারে। সেজন্য আমরা সচেতন। চেষ্টা করে যাচ্ছি পাঠ্যসূচিতে ইসলামিক বিষয় প্রাধান্য দিতে।
দেশের কয়টি জেলায় ছাত্র মজলিসের কার্যক্রম আছে?
সারাদেশে আমাদের সাংগঠনিক জেলা আছে ৭০টি। এর সবগুলোতেই কাজ রয়েছে। আমাদের বর্তমান শেসন শুরু হয়েছে ২০১৬’র ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে। আমরা শাখা পুনর্গঠন শুরু করেছি অক্টোবর থেকে। অনেক শাখাই এখন নতুন কমিটি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দেশের সর্বত্র কাজ করার।
কওমি মাদরাসাগুলোতে ছাত্র রাজনীতির কার্যক্রম করতে গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না?
না কোনো সমস্যা নেই। আমরা নির্দ্বিধায় কাজ করে যাচ্ছি।
সব মাদরাসায় কি কমিটি দিতে পারছেন যেখানে চাচ্ছেন?
হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ দিতে পারছি, কোনো সমস্যা নেই।
সাধারণত কওমি মাদরাসাগুলোতে এ ধরনের সমস্যা থাকে। সংগঠন বা অন্যান্য কার্যক্রম চালানো নিষিদ্ধ রাখা হয়।
হ্যাঁ এ সমস্যা আছে। এটা অনেক আগেও ছিল এখনো আছে। কিন্তু আমরা এ সমস্যাকে কাজের অগ্রগতির প্রক্রিয়া বলে মনে করি। যেখানে সমস্যা আছে সেখানে আরো কাজ ভালো হয়। যেখানে অপেন কাজের সুযোগ সেখানে কাজ আদায় করা যায় না। যেখানে ঘোষণা দেয়া আছে রাজনীতি হারাম সেখানেও আমরা কাজ উঠিয়ে এনেছি।
স্কুল কলেজগুলোতে কাজের কিছুটা সমস্যা ফিল করছি। জঙ্গিবাদ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে সমস্যা চলছে সবখানে। এগুলো কাজের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কওমি মাদরাসা ছাড়া আলিয়া ও স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পরিমাণ কাজ আছে আপনাদের?
কওমি মাদরায় আমাদের কাজ বেশি। দ্বিতীয়তে আছে আলিয়া। স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যাতো একটু আগে বললাম। তবু আমরা সমস্যার মধ্যেও কাজ উঠিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
সেটা কী রকম? উল্লেখ করার মতো কোনো কাজ কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হচ্ছে?
স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের প্রচুর জনশক্তি রয়েছে। সমর্থনও রয়েছে। কিন্তু নতুন শেসনে আমরা এখনো কমিটি পুনর্গঠনে যেতে পারিনি। তবে আশা করছি খুব শিগগির ঢাবি, জগন্নাথ, শাবিপ্রবি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করতে পারবো।
বিভিন্ন দল উপদলে আমাদের বিভক্তি এটা কি আমাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে? যেমন আমি একটা ইসলামি দল করি আরেকটা ইসলামি দলের কর্মী আহত হলে আমি চিন্তিত হই না।
এটা তো খুবই দুঃখজনক। মুসলমান সবাই এক দেহের মতো। এখানে কোনো সীমানাপ্রাচীর থাকবে না। বিশ্বের কোথাও একজন মুসলিম আঘাতপ্রাপ্ত হলে তার হৃদয় কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক। আপনি যে প্রশ্ন করেছেন সেই সমস্যা আমরা ফিল করি। একজন আরেকজনের জন্য ব্যথিত নই আমরা। এর জন্য আমাদের অনেক পিছিয়েও যেতে হচ্ছে। ভালো কোনো রেজাল্ট নিয়ে আসতে পারছি না। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।
তবে আলহামদুলিল্লাহ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসে এটা কম। ব্যক্তি যে দলই করুক সবার প্রতি সহমর্মিতা কর্মীদের রয়েছে এবং আমরা তার জন্য কথা বলার চেষ্টা করি। এমনকি মানবিক কারণে অমুসলিমদেরও সাহায্য করার চেষ্টা করি।
গত শেসনে একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য হয়েছে। অনেকগুলো প্রোগ্রাম সেমিনারও হয়েছে। মূলত আমাদের উদ্যোগেই এটি হয়েছিল।
এখন সেটা নেই কেন?
এখনো রয়েছে। তবে সবার একটু ব্যস্ততার জন্য যোগযোগটা কমে এসেছে। আমরা পুনরায় এটি বাড়ানোর চেষ্টা করছি।
একটা বিষয় আপনাদের মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই। মুসলিমের প্রতি, মুসলিমের সহমর্মিতা, সমর্থন ও ত্যাগ ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। এটি ছাড়া ইসলাম আগাবে না ব্যক্তিও আগাবে না। তাই সবাইকে অন্যের প্রতি আরো বেশি সহমর্মী ও শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি।
আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলুন
আমাদের মূল পরিকল্পনা তো আল্লাহর জমিনে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য ভূমিকাস্বরূপ কিছু কাজ করতে হয়। প্রথম হলো নেতৃত্ব তৈরি করা। আপনি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন কিন্তু তার আগে সেটি পরিচালনার জন্য মানসম্পন্ন লোক তৈরি হওয়া লাগবে। আমাদের সংগঠনের মূল কাজ হলো, একজন ব্যক্তি কিভাবে নিজেকে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে সেজন্য যা যা প্রয়োজন তার সবগুলোই আমাদের কর্মসূচিতে রয়েছে।
একজন ব্যক্তিকে এভাবে গড়ে তুলতে হলে প্রথম যে কাজ সেটি হলো শিক্ষা। প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভারসাম্য নিয়ে গড়ে উঠতে পারে এটি আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। আরেকটা বিষয় হলো মুসলিম দেশে হিসেবে এখানে ইসলামি শিক্ষাকে সার্বজনীন করতে যে ধরনের চেষ্টা দরকার তা আঞ্জাম দেয়া।
সার্বজনীন বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছেন?
এখন তো কওমি মাদরাসায় ১০০% ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক, আলিয়াতে ১০০% নয়, সংকোচন রয়েছে। স্কুল কলেজে সংকোচনটা আরো বেশি। এই সংকোচটা দূর করাটা জরুরি। একজন শিক্ষার্থী প্লে থেকে নিয়ে যেন ইসলামি শিক্ষা পায় সেটা নিশ্চিত করা এবং তার মন মানসিকতা ইসলামিক ভাবাপন্ন করে তোলা।
এই সার্বজনীন প্রশ্নে কওমিতে জাগতিক শিক্ষা প্রয়োজন কি না?
হ্যাঁ, কওমিতেও জাগতিক শিক্ষা জরুরি।
এখানে তাহলে একটি প্রশ্ন আসে, কওমি মাদরাসায় মুরুব্বি উস্তাদগণ জাগতিক শিক্ষা চান না, তারা মনে করেন কওমির ছাত্ররা মসজিদ মাদরাসা নিয়ে থাকতে তাদের তো জাগতিক শিক্ষা প্রয়োজন নেই। সেখানে আপনারা ব্যতিক্রম চিন্তা করছেন, একটা দ্বান্দ্বিক অবস্থা তৈরি হলো, এটা দূর করবেন কিভাবে?
বিষয়টা হলো, আমরা যেরকমটা পেয়েছি- মুরব্বি উস্তাদগণ বলতেন, ইংরেজি হলো ব্রিটিশদের প্রণীত। আমাদের দেশ শাসন করার সময় তাদের ভেতর ইসলামবিদ্বেষটা প্রকট ছিল। এ জন্য মুরুব্বিগণ ইংরেজি বা জাগতিক শিক্ষাকে ভিন্ন চোখে দেখেছেন।
কিন্তু ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছাড়ার পর আলেমরা উপলব্ধি করেন তাদের প্রণীত বিচার, শিক্ষা, আইন অবিকল রয়েছে। এগুলো পুরোপুরি দূর করার জন্য তাদের অনেকে জাগতিক শিক্ষাকে দূরে রাখতে বলেন। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। আমি কওমি মাদরাসা থেকে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল দিয়েছি। কিন্তু আমাদের উস্তাদদের যতবার এটা বলেছি তারা কখনো নিরুৎসাহিত করেননি। তারা বরং উপদেশ দিয়েছেন যেন আমল আখলাক ঠিক রাখি।
সুতরাং এর ভিত্তিতে বলতে পারি একটা সমন্বয় গোপনে গোপনে হয়ে গেছে অলরেডি। এখনকার আলেমদের ভেতর তো এটা দেখিই না যে বলছেন এ শিক্ষার প্রয়োজন নেই, কারা যাবে না। বরং তারা বলেন যেখানে সমস্যা সেখানে হাত দিতে হবে।
কওমি শিক্ষা ও সিলেবাস সংস্কারের যে আন্দোলন বা চর্চা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন যাবত আপনারা এটা কিভাবে দেখেন?
কওমি মাদরাসার যে শিক্ষা ও সিলেবাস সেখানে ১০০% উপযোগী শিক্ষা কঠিন। কারণ এখানে সিস্টেমের একটু গাদাগাদি রয়েছে। দেখা যাচ্ছে একবছরে যে সিলেবাস পড়ানো হচ্ছে সেটা থেকে একজন ছাত্র কোনো উপকৃত হচ্ছে না। যেমন দাওরায়ে হাদিস এটিকে আরো বিন্যস্ত করা জরুরি।
আর সংস্কার বলতে এটিকে আরো যুগোপযোগী করা। আরো কিছু আধুনিক বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা। আর ক্লাস পরিচালনায় এলোমেলো রয়েছে এগুলোকে বিন্যস্ত করে সেমিস্টার সিস্টেমে আনলে ছাত্ররা বেশি উপকৃত হবে।
এআর