‘আমার দুই ছেলে সেলিম ও ফরিদ, বাবা মো. উসমান, মা ফাতেমা বেগম ও স্ত্রী হাসিনাকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল সেনারা। সবাই পুড়ে মারা গেল। খালাতো বোন সাজেদা বেগমকে (১৫) চারজন সেনাসদস্য ধর্ষণ করার পর দুটি গুলি করে হত্যা করল। গ্রামের ১১৫ জনের মধ্যে বেছে বেছে ২৬ জন ধনী লোককে রেখে অন্যদের গলা কেটে গর্তে ফেলে দিল।’
এই পৈশাচিকতার বর্ণনা যখন দিচ্ছিলেন, তখন রফিকের দুচোখ বেয়ে ঝরছে পানি। কণ্ঠ কাঁপছিল তাঁর। বলছিলেন, ‘আমরা যেন মানুষ নই। রোহিঙ্গা হয়ে জন্ম নেওয়াটাই কি অপরাধ?’
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থানার গজরবিল গ্রামে বাড়ি ছিল রফিকের। গত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেই গ্রামে হামলে পড়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হামলার পরপরই বাড়ি থেকে কাছের পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন রফিকসহ কয়েকজন। পালাতে পারেনি যেসব ভাগ্যহীনেরা, বর্বরতার শিকার হয়ে মৃত্যুকে বরণ করতে হয়েছে তাদের।
বনজঙ্গল ও পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে কোনোমতে ১২ দিন পর রফিক এবং গ্রামের কয়েকজন গত শনিবার টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে পৌঁছান। গত সোমবার এই ক্যাম্পের সি ব্লকের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় রফিকসহ কয়েকজনের সঙ্গে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নতুন করে নিপীড়ন শুরু হয় গত ৯ অক্টোবর। রাখাইনে তিনটি পুলিশচৌকিতে হামলার ঘটনার পর সেনা ও পুলিশ মংডু ও বুচিডংয়ের অন্তত ২৩টি গ্রামে হামলা করেছে। এরপরই ধন-সম্পদ, জমিজমা-পোড়া বসতভিটা ফেলে প্রাণ রক্ষার্থে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয় নিরুপায় এসব মানুষ। জাতিসংঘ গত সোমবার বলেছে, এ যাবৎ বাংলাদেশে এসেছে অন্তত ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা।
রফিকের গ্রাম গজরবিলের আরেক বাসিন্দা শাহ আলমের স্ত্রী নুর হাবা (২৬)। তিনি বললেন, ‘সকাল ছয়টার দিকে হঠাৎ করে গুলির শব্দ শুনি। তখন আমি রান্নাঘরে গরুর মাংস রান্না করছিলাম। ওই সময় একটি হেলিকপ্টার এসে গুলি ও আগুন নিক্ষেপ করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ওই সময় দুই ছেলে এনামুল হাসান, মোহাম্মদ আলম ও মেয়ে নুর সেহেরাকে নিয়ে কোনো রকমে পালিয়ে আসি। পালানোর সময় আমার স্বামী শাহ আলমসহ কয়েকজন গুলি খেয়ে মারা যান।’
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারে সেনা, পুলিশ ও নাডালা বাহিনী এ পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত বড় গজরবিল, ছোট গজরবিল, রাঙ্গাবাইল্যা, ছালিপাড়া, জামবনিয়া, খেয়ারিপ্রাংসহ অন্তত ২৩টি গ্রামে গণহত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে।
সুখের সংসারটি ভেঙে গেল: লেদা শিবিরের সি ব্লকের আবদুল জব্বারের বাড়িতে অবস্থান করছেন ২৫ ডিসেম্বর রাখাইনের পোয়াখালী থেকে পালিয়ে আসা কবির আহমদের পরিবারের পাঁচজন সদস্য। কবিরের সঙ্গে স্ত্রী তসলিমা বিবি, তিন মেয়ে দিলশান, আফসান ও নুর শাহও আছে। গত ৬ জানুয়ারি শুক্রবার বিকেলে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। রাখাইন রাজ্যের মংডু পোয়াখালী গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি।
স্বামী ও স্ত্রী বললেন, এত দিন মুদির দোকানের আয়ে সুখেই চলছিল তাঁদের সংসার। গ্রামের মানুষের সঙ্গেও ছিল সুসম্পর্ক। বিপদে একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ করেই দুর্যোগ নেমে আসে তাঁদের জীবনে। ঘটনার দিন সেনা পোশাকে অস্ত্রধারীরা পোয়াখালী গ্রাম ঘেরাও করে। এ সময় অন্যদের মতো কবির আহমদের বাড়িও আক্রান্ত হয়। অস্ত্রধারীরা কবির আহমদের হাত-মুখ বেঁধে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।
তসলিমা বলেন, ‘আমার চোখের সামনে গ্রামের অন্য পুরুষের সঙ্গে আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় সেনারা। এ সময় তারা আমার স্বামীর চোখ বেঁধে ফেলে, স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে দেয়। আমি তাদের অনেক অনুনয় করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আমি তাদের হাতে-পায়ে ধরেছি কিন্তু কেউ ছেড়ে দেয়নি।’
বর্বরতার বর্ণনা আরও দীর্ঘ হচ্ছিল। তসলিমা বলছিলেন, ‘আমার ওপর যা হয়েছে, তা-ই শেষ নয়। ঘর থেকে বের করে দিয়ে চোখের সামনে আমার বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। দাউ দাউ করে যখন আগুন জ্বলছিল, ওই সময় কোনো রকমে তিন সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে আসি। পাঁচ বছরের দিলশান, তিন বছরের আফসান ও ১০ মাস বয়সের নুর শাহকে নিয়ে রাতের আঁধারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে টেকনাফে চলে আসি।’
তসলিমা জানান, এখানে আসার পর তিনি আশ্রয়শিবিরের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু এখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি। এরপর জীবনে কী ঘটবে, তা জানা নেই। কত দিন তিনি এ দেশে আশ্রয় পাবেন, তা-ও অনিশ্চিত।
কবির আহমদ বলেন, ‘সেনাদের নির্যাতনে আমার মৃত্যু হয়েছে মনে করে অচেতন অবস্থায় ফেলে দেয় নদীর পাড়ে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছি। ধরে নেওয়ার পর প্রচুর মারধর করা হয়। আমি অপারেশনের রোগী, সেটা সেনাদের বড় কর্মকর্তাকে জানালে পেটে না মেরে পিঠে, কান ও গলায় বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালায়।’
নির্যাতনের পাশাপাশি একপর্যায়ে সেনারা অর্থ দাবি করে বলে জানান কবির। বলেন, ‘আমার কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। ধরে নেওয়ার সময় আমার পকেটে ৫০ হাজার টাকা ছিল। এরপর তারা ৪০, ৩০, ২০, ১৫, ১০ ও ৫ লাখ টাকা দাবি করলেও আমি দুই লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলি। তাতেও তাদের পেট ভরেনি। টাকা পেতে আমার কান, গলায় ছাতার শিক ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পরে মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়লে নদীর পাড়ে ফেলে দেয়। কার দোয়ায় বেঁচে আছি জানি না। কিন্তু ওই সব নির্যাতনের কথা মনে পড়লে ঘুমাতে পারি না।’
অন্তঃসত্ত্বা রোহিঙ্গা নারীর আর্তনাদ: রাখাইন রাজ্যের ওযাবপ্রাং গ্রামের নুর কবিরের স্ত্রী রহিমা খাতুন স্বামী হারিয়ে গত শুক্রবার ভোররাতে (৬ জানুয়ারি) দেড় বছর বয়সী এক সন্তান জসিমকে কোলে নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা তিনি। রহিমা বলেন, প্রথমে সেনা এলাকায় এসে গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর ঘরবাড়ি থেকে নারী, পুরুষ ও শিশুদের বাইরে নিয়ে এসে রাস্তার ওপর বসিয়ে রাখে। চোখের সমানে সেনারা তাঁর স্বামীসহ আরও কয়েকজন পুরুষকে ধরে হাত ও চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাঁদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। যারা নির্যাতন চালিয়েছে, তারা সবাই সেনাবাহিনীর পোশাক পরা অস্ত্রধারী ছিল। রহিমা বলেন, ‘স্বামী হারিয়েছি, কোলে আছে এক সন্তান। তার ওপর আট মাসে অন্তঃসত্ত্বা। এ দুজনকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব কিছু ভেবে পাচ্ছি না। তার ওপর অন্যের ঘরে আশ্রয়ে কত দিন থাকা যায়?’
রাখাইন রাজ্যের মংডু থানার নাইসাপ্রুং গ্রামের জমির হোসেনের স্ত্রী নুর বেগম স্বামী হারিয়ে গত শুক্রবার সকালে বৃদ্ধা মা ও দুই সন্তান নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে। তিনি বলেন, সেনারা তাঁর স্বামীকে ছয়-সাত দিন আগে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, তাঁর তিন মামাতো ভাইয়ের স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। এর আগে তাঁর মামাতো ভাইদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন ভাবি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, জানেন না নুর বেগম।
অনুপ্রবেশকারীদের ভাষ্যমতে, সেনারা ধরে নেওয়া রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করে মাটিচাপা দেয়, আবার অনেককে পুড়িয়েও ফেলতে পারে। এত দিন ধরে তাঁদের আটকে রাখার কথা নয়। আর যেসব নারীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাদেরও ধর্ষণ করার পর হত্যা করা হচ্ছে। এ রকম অনেক রোহিঙ্গা নারীর বেওয়ারিশ লাশ মংডু শহরের বিভিন্ন খালপাড় ও জঙ্গলের কাছে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আর যেসব পুরুষ সেনাদের হাত থেকে বাঁচতে উপকূলীয় প্যারাবন, পাহাড় ও জঙ্গলগুলোতে পালিয়ে আছেন, তাঁরাও খাবারের অভাবে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। আবার হত্যার বিষয়টি যাতে ইন্টারনেট-ফেসবুকে না ছড়ায়, সে বিষয়েও সেনারা এখন অনেক বেশি সচেতন হয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গা স্বীকৃতি চাই: লেদা এলাকার অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দুদু মিয়া বলেন, ‘বহির্বিশ্বের নেতারা উদ্যোগ নিলে আমরা ফিরে যাব। তবে শর্ত একটাই, রোহিঙ্গা মর্যাদা চাই। রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি পেলে প্রায় ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিরা (আশ্রয়ের থাকা রোহিঙ্গারা) ফিরে যাবে। রাখাইনে ১৪১ জাতি। সেনাবাহিনী শুধু রোহিঙ্গাদের দমনে নেমেছে। দুদু মিয়া বলেন, সেনা, পুলিশ ও নাডালা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যেসব নির্যাতন করছে, তা গণহত্যাকে হার মানিয়েছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে এখন মিথ্যাচার করছে।’
সূত্র: প্রথম আলো