মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
‘আখতার! তোমার কাছে সাহাবায়ে কেরামের সুবাস পাই।’ হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী রহ. (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রি.) কে ডেকে তাঁর নানী আমাতুস সালাম উম্মিবী এই কথাটি বলেছিলেন। (দীনী দাওয়াত, আবুল হাসান আলী নদভী) কোন ইশারায় তিনি এই উক্তি করেছিলেন মহান রব্বুল আলামীনই ভালো জানেন। তবে সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে যেমন সারা বিশ্বে দীনের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিলো তার নমুনা হযরতজী ইলিয়াস শাহ আখতার রহ. এর দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে পরিলক্ষিত হয়।
আজ থেকে প্রায় ৬ দশক আগে ভারতের এক জনবিরল অঞ্চল মেওয়াত থেকে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ নিয়ে দাওয়াত ও তাবলীগের এই মেহনতের ধারা শুরু হয়। হযরতজী ইলিয়াস রহ. বুঝতে পেরেছিলেন, গরিব মেওয়াতী কৃষকদের পক্ষে দ্বীন শেখার জন্য স্বাভাবিকভাবে সময় বের করা বেশ কষ্টকর। ঘর-সংসার ছেড়ে মাদরাসায় দীন শেখাও অসম্ভব। ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে সামগ্রিক জীবন পাল্টে দেয়া বা জাহেলী বিশ্বাসে পরিবর্তন আনাও সর্বাংশে সম্ভব নয়। তাই একমাত্র উপায় হিসেবে তিনি তাদের ছোট ছোট জামায়াত আকারে ইলমী ও দীনী মারকাজগুলোতে গিয়ে সময় কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে তালিম দিতে আরম্ভ করলেন। সেই ধর্মীয় মজলিসে উলামা-মাশায়েখদের ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি তাদেরকে দৈনন্দিন জীবনের দীনের উপর চলার নিয়ম-নীতি বাতলে দেওয়া হতো।
দীনদার পরহেজগার লোকদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেত তারা। ধর্মীয় মৌলিক বিশ্বাস ও ইবাদতের অনুশীলনের পাশাপাশি তিনি মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের প্রয়োজনীয় কিছু সূরা-ক্বেরাত শিক্ষাদান, দোয়া-দরুদ, জরুরি মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে অবহিত করে তাবলিগী জামায়াতকে একটি ভ্রাম্যমাণ মাদরাসাতে রূপান্তরিত করেন তিনি। এ কাজকে আরও বেগবান ও গতিশীল করার জন্য উপমহাদেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও বুজর্গদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন এবং মেওয়াতে সর্বস্তরের মুসলমানদের জন্য ইজতেমা বা সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। এরপর ক্রমেই তাবলীগের কার্যক্রম বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিশ্বের সর্বত্র।
হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর ন্যায়নিষ্ঠা, ধৈর্য, পরিশ্রম, পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দাওয়াত তাবলীগের এই ধারাকে বর্তমান রূপে স্থান দিতে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ. সারাজীবন পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে এই দাওয়াত ও তাবলীগ জামায়াত তথা বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ঐক্যের প্রতীক বিশ্বইজতেমাকে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক সুদৃঢ় মজবুত ও শক্তিশালী অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী রহ. ১৯৪৪ সালের ১৩ জুলাই ৫৯ বছর বয়সে ইহকাল ত্যাগ করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর বিশ্ব মুসলিম ঐক্য ভ্রাতৃত্বের প্রতীক দাওয়াত ও তাবলীগের দ্বিতীয় প্রধান মুবাল্লিগ নিযুক্ত হন তাঁর সুযোগ্য পুত্র হজরত মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী রহ.। তিনি তাবলীগের দাওয়াতী জামায়াতকে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছিয়ে দিতে থাকেন। দাওয়াত ও তাবলীগের সূত্র ধরেই মুসলিম ঐতিহ্যের স্পেনের মাটিতে ৫০০ বছর পর মসজিদের মিনারে ধ্বনিত হয় আজানের সুমধুর আওয়াজ ।
১৯৪১ সালে দিল্লীর নিযামউদ্দীন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়ার নূহ মাদরাসায় প্রথম ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তাতে প্রায় ২৫০০০ দ্বীনদার মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। এভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে মেওয়াতের বিভিন্ন শ্রেণির কিছু মানুষের কাছে দ্বীনের কথা প্রচারের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামায়াতের যাত্রা শুরু হয়। মাওলানা ইলিয়াছ কান্ধলভীর রহ. নির্দেশে হজরত মাওলানা আব্দুল আযীযের রহ. মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে তাবলীগ জামায়াতের মেহনত শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগী জামায়াতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে ততকালীন হাজী ক্যাম্পে ইজতেমা হয়। ১৯৫৮ সালে বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন এটা কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু প্রতি বছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আশাতীতভাবে বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে ইজতেমা টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ওই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান অংশগ্রহণ করায় তা ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগ নদীর উত্তর-পূর্ব তীর সংলগ্ন ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
রাজধানীর উত্তর উপকণ্ঠে ‘কহর দরিয়া’র কথা শুনলে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন। ঢাকা ও গাজীপুরকে বিভাজক প্রমত্তা নদীটি আজ ইতিহাস। এক সময়ের ¯স্রোতস্বিনী নদীটির নাম পাল্টে গেছে বহু আগেই। কালক্রমে ভরাট হতে হতে তুরাগ নামে এখন ছোট্ট খালের রূপ ধারণ করে বয়ে চলেছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। কিন্তু ‘কহর দরিয়া’ নিজেকে ইতিহাসের গর্ভে বিলিন করেও যেন রচনা করেছে একটি নতুন ইতিহাস। কুদরত যেন প্রমত্তা কহর দরিয়াকে শাসন করে করে দীনে ইলাহির জোয়ারকে বিজয়ী করেছেন ওখানে। দরিয়ার স্রোত নয় এখন সেখানে তৌহিদী মনুষের জনসমুদ্র। কহর দরিয়া নিজেকে উজাড় করেও যেন নীরবে নিভৃতে বেঁচে রইলো লক্ষ কোটি প্রাণের স্পন্দনে হেদায়েতের দীপ্ত প্রদীপ হয়ে
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, নরাইবাগ ইসলামিয়া মাদরাসা, ঢাকা।
পেশ ইমাম, ডেমরা জামে মসজিদ, ঢাকা
আরআর