ইলিয়াস মশহুদ
মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা’আলা। মহিয়ান-গরিয়ান খোদা তা'আলা। খালিক-মালিক রাহমান মাওলা। মহান আল্লাহ; যিনি দু’জাহানের সৃষ্টিকর্তা। তিনি আদি, তিনি অন্ত। তিনি ক্বাদির, সর্বজ্ঞ। তিনি সামী’, সর্বস্রোতা। তিনি রাযিক, তিনিই বাদশাহ।
আমরা গোলাম, তিনি মনিব। আমরা মুহতাজ, তিনি অমুখাপেক্ষি। আকাশ-যমীন তাঁরই সৃষ্টি। অসংখ্য, অগণিত মাখলুকাত তাঁরই করুণা দৃষ্টি। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তাঁরই অপার দয়া।
আমরা তাঁর বান্দা। শ্রেষ্ঠ জাতি। শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মত। সুতরাং সব তা’রীফ তোমারই খোদা।
আশরাফুল মাখলুকাতের জন্য তিনি আকাশ সৃষ্টি করেছেন ছাদ হিশেবে। জমিন ফেরাশ হিশেবে। গাছপালা, তরুলতাকে ছায়া দানকারি হিশেবে। ফলমূলসবজি ক্ষুধা নিবারণের জন্যে। সাগর-নদী বহমান করেছেন মানবের কল্যাণের জন্যে। তিনিই দিয়েছেন সূর্যের তাপ। চাঁদের জোসনা আলো। শীত-গরম। সুতরাং তিনিই করেছেন সব। সব কিছু।
শাহানশাহ খোদা তা’আলা তাঁর শাহী দরবারে বসে চালনা করছেন আমাদের। মুহূর্তের জন্যও বিরতি নেই তাঁর। ঘুম নেই, খাওয়া-দাওয়া নেই। জনম মৃত্যু কোনো কিছুর বালাই নেই তাঁর। স্ত্রী নেই, সন্তানও নেই। জনমদাতাও কেউ নেই তাঁর। আমাদের মতো তাঁর কোনো জিসিমও নেই। তিনি বেনিয়াজ, বেমুহতাজ, বেক্বারার। কারণ, তিনি তিনিই। তিনি সব। যখন যা ইরাদা করেন, ইচ্ছে করেন- ‘কুন’ বলতে দেরি হতে পারে, হয়ে যেতে দেরি নেই। হতে বাধ্য। কারণ, তিনিই তো সব। সর্বজ্ঞানী। স-ব বিষয়ের একক ক্ষমতাবান।
বাদশাহদেরও বাদশাহ, মহিয়ান-গরিয়ান খালিক-মালিক মাওলা আরশে আযীমে বসে পৃথিবী সৃষ্টির মনস্থ করলেন। এলাহী কালাম- মা খালাক্বনাস সামা-ওয়াতি ওয়াল আরয্বা ফী সিত্তাতি আইয়্যাম...। সর্ব ক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও মানবকে শিক্ষাদানের মানসে ছয়দিনে সৃষ্টি করলেন এ ধরা। বিস্তৃত, বিশাল এই রঙিন দুনিয়া। সবুজ আকাশ। পাখপাখালি, গাছগাছালি আর বাহারী সব লতাগুল্মে ভরপুর বেহদ এই যমীন। পরীক্ষার হল। যমীনের অধিবাসি নানান কিসিমের বস্তু। প্রাণহীন জিনিস। নানান ধর্মের মানুষ। নানান রকমের প্রাণজ জাতি। নাম না জানা কতো শতো সৃষ্টিরাজি।
আদি পিতা আদম আ.কে দিয়ে মানবধারা, আদি মাতা হাওয়া আ.কে দিয়ে মানবীধারা আর দু’জনকে দিয়ে যুগলধারার সূচনা করলেন। আরো সৃষ্টি করলেন জিন জাতি। পবিত্র কুরআনে জিন-ইনসানকে বিশেষভাবে সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে- ওয়ামা খালাক্বতুল জিন্নাঁ ওয়াল ইঁনসা ইল্লা লিআ’বুদূন... অর্থাৎ মালিকের গোলামির জন্যে, মা’বুদের ইবাদিতর জন্যে জিন আর ইনসানকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা উৎসর্গিত হও আপন পরওয়ার দেগারের জন্যে। কেননা তোমাদের সৃষ্টির কারণ এটাই। যদি করো তাঁর গোলামি, খালিকের সৃষ্টির সব নেয়ামতরাজি তবেই তোমাদের জন্যে।
পৃথিবী সৃষ্টির যুগ-যুগান্তর, কাল-কালান্তর, হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। লক্ষাধিক নবী-রাসূল এ ধরায় দ্বীনের আলো বিতরণ করে চলে গেছেন আপন প্রেমাষ্পদ, মাহবুবে হাক্বীক্বির সান্নিধ্যে। তাদের সবাই একবাক্যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর বাণী শুনিয়েছেন প্রাপকের কাছে। আপন কওমের কাছে। তাদের আহবানে কেউ বলেছে কবুল, কেউ হয়েছে মকবুল আর কেউ বনেছে আবুল!
সবারই মিশন ছিলো এক। ভিশনও এক। রাব্বে কারীমের দূত হিশেবে নিজ নিজ দায়িত্ব শতভাগ পালন করে গেছেন তাঁরা। মাওলাপাকের অপার নুসরাতে। সুতরাং তাঁরা সফল। চূড়ান্ত, পূর্ণ সফল। লা-ইলাহা’র আহবানের আবাহনে যারাই সাড়া দিয়েছেন, গা ভাসিয়েছেন, তারাও সফল। নবীদের সহযোগি তারা। মহান রবের বন্ধু তারা।
আখেরি নবী, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, তাজদারে মাদিনা জনাবে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালেন মধ্য দিয়ে নবিচারণ বন্ধ হয়ে যায় এই পৃথিবীর বুকে। আনুষ্ঠানিকভাবে। কারণ, তিনি শেষ নবী। তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না।
সময়ের বিয়োগান্তে একসময় নবিওয়ালা সেই কাজ নবীদের ছাড়াই শুরু হয়। শুরু করতে হয়। নবী-রাসূলদের আগমনধারা বন্ধ হয়ে গেলেও তাঁদের মিশন থামবেনা। স্তিমিত হবেনা। চলমান, বহমান থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া বা নবীদের উত্তরাধিকারী হিশেবে একদল মানুষে মাধ্যমে।
আল কুরআনের ঘোষণা- আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম ও আতমামতু আলাইকুম নি’মাতী... যখন নাযিল হল, পরিস্কার হয়ে গেলো তখন- দ্বীনের কাজ সমাপ্ত। যেগুলো বলে দেয়ার, বাতলে দেয়ার, সব বলে দেয়া হয়েছে। রূহ জগত থেক জনম, জনম থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আশা-ভরসা, কর্ম-প্রতিদান, পাপ-পূণ্য; সবকিছু বলে দেয়া হয়েছে। জীবন চালনায় অদ্বিতীয় গাইড হিশেবে আরো দেয়া হয়েছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। এখন শুধু বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে। ফিট করতে হবে নিজেদের জীবনে। খুব সহজে।
পার্থিব কোনো স্বার্থ ছাড়া, পরকালের লালসে, মানসে ভোগ-মোহ ত্যাগ করে যারা সে পথে চলেন, চালান; সেইসব উলামায়ে কেরাম, দ্বীনের দাঈরাই হলেন ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া বা নবীদের উত্তরসূরি। নবীওয়ালা কাজ কিয়ামত পর্যন্ত এঁদের মেহনতেই জারি থাকবে
শরঈ হুকুম-আহকাম, বিধিনিষেধ সব কিছুর বিস্তারিত এবং পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেয়া হয়েছে নবীজির ২৩ সালের নববী যিন্দেগীতে। কওলান, ফে’লান সবভাবেই। শুধু বাস্তবায়ন। জীবনঘরে ফিটিং করা। খানা রেডি, শুধু গলাধঃকরণ করতে বাকি!
আল্লাহপাক নবী-রাসূলদের যে মিশন দিয়ে পাঠিয়েছিলেন পৃথিবীতে, তাঁরা তাদের দায়িত্ব-কাজ যথাযথভাবে পালন-আদায় করে গেছেন। এখন যে কেউ চাইবে, নবী উপস্থিতি ছাড়াও সে চলতে পারবে। উপকরণ আছে। খোরাক আছে। ডাইভার্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, সিগন্যাল লাগানো আছে।
এতোসবের পরও যারা বুুঝেনা, রবকে পাওয়ার, দ্বীনকে চেনার কুশিশ করেনা, কুরআন-সুন্নাহ মুতাবিক্ব নিজে চলেনা, পরিবার-পরিজন, খেশ-কুটুম চালনা করেনা, হাশর-নশর, কবর-পুলসিরাত নিয়ে ফিকিরমন্দ হয়না; বেপথে, বিপথে চলে, দিন গুজরান করে, এই তাদেরকে এবং দ্বীনকে জীবন্ত, সতেজ রাখতে, শরঈ আহকামাত বাস্তবায়নে কিছু মানুষ অবিরত মেহনত-মুশক্কত করে থাকেন। পার্থিব কোনো স্বার্থ ছাড়া, পরকালের লালসে, মানসে ভোগ-মোহ ত্যাগ করে যারা সে পথে চলেন, চালান; সেইসব উলামায়ে কেরাম, দ্বীনের দাঈরাই হলেন ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া বা নবীদের উত্তরসূরি। নবীওয়ালা কাজ কিয়ামত পর্যন্ত এঁদের মেহনতেই জারি থাকবে। দুনিয়াও ঠিকে থাকবে। যেদিন মেহনত বন্ধ হয়ে যাবে, দুনিয়াও উল্টে যাবে।
আমাদের দাবি- আমরা নবীদের উত্তরসূরি! কথায় কাজে তা দেখাতে হবে আমাদের। কোনো মানুষকে নয়, দেখাতে হবে মহান রবকে। শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, ভাবতে হবে সমাজ, দেশ, দশকে নিয়ে। ভাবতে হবে আল্লাহভোলা, পথভোলা, দ্বীনের ব্যাপারে দীনহীনদের নিয়ে। ধ্বংসোন্মুুখ জাতিকে নিয়ে। নেফাকওয়ালাদের নিয়ে। মেহনত করতে হবে তাদের পিছনে, যারা দ্বীনের ব্যাপারে পিছুটান দেয়। তবে সবার আগে দরকার নিজেকে, দাঈদেরকে পরিশুদ্ধ করা। অন্তরে খুলুসিয়াত কায়েম করা। অহমিকা, আত্মগরিমা বিসর্জন দেয়া। লৌকিকতা ত্যাগ করা। যারা পারেন, তারা অন্যদের নিয়ে কাজ করবেন। আমরা যাদের হয়নি, মেহনত করে আগে নিজেকে ইসলাহ করি। অতঃপর নববী মিশনে ঝাপিয়ে পড়ি।
মালিকের গোলামির জন্যে, মা’বুদের ইবাদিতর জন্যে জিন আর ইনসানকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা উৎসর্গিত হও আপন পরওয়ার দেগারের জন্যে। কেননা তোমাদের সৃষ্টির কারণ এটাই।
এই যে মেহনত-মুশক্কত, নবীওয়ালা দায়িত্ব; এটা কারা, কীভাবে করবেন? এক কথায়, আল্লাহ রাসূলের মুহব্বাতে মাশগুল যারা, দ্বীনের তড়প যাদের ভেতর সদা বিরাজমান, শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবেন না যারা; তারা। কবির ভাষায়-
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনি পরে”। যারা নিজের পাশাপাশি আহল-ইয়াল, মিল্লাতকে নিয়ে চিন্তা করেন, মুক্তির পথ খুঁজেন, তারাই করবেন এ কাজ। কারণ, তারা হলেন ওয়ারিসে নবী।
এই কাজ হয়ে থাকে দ’ভাবে- এক উসূলে কয়েক সিস্টেম। দ্বারে এনে বা দ্বারে যেয়ে। ইলমে দ্বীন শিক্ষার মাধ্যমে অথবা তাবলিগের মাধ্যমে। দ্বীন এক, উসূলও এক, তবে কাজের তরিকা কিছুটা ভিন্ন। উভয় তরিকাওয়ালাদেরই ভাবনা এক- দ্বীনে ইসলাম। মুসলিম মিল্লাত। এতে নেই কোনো ইখতিলাফ।
যদি করতে পারি কাজ ঠিক মতো। হক আদায় করে। যদি পারি, তবেই সফল...। কারণ, রেজায়ে মাওলাই হল আসল।
তাবলিগের ইজতেমা সফল হোক। মনের কলুষতা, গোঁড়ামী, একঘেয়ে, অতিণ্ডিতি, অতিভক্তি দূর হোক। মনের আন্ধার ঘর আলোকিত হোক।
লেখক: সাংবাদিক। কলামিস্ট।