আবু তাহের
গত ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া ২৩৩৪ নম্বর প্রস্তাবে ইসরায়েলকে পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের সব স্থানে বসতি স্থাপন কার্যক্রম অবিলম্বে সম্পূর্ণ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদের ওই বৈঠকে ১৪ ভোটে প্রস্তাবটি পাস হয়।
ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবে ভোট না দিলেও প্রস্তাবে ভেটো দেয়নি। বিষয়টি ইসরায়েলের গলায় কাটা হয়ে বিধছে। বিষয়টিকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না তারা। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই প্রস্তাব সমর্থনকারী ১০ টি দেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এর আগে ২০১১ সালে এ ধরনের একটি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ঘনিষ্ট বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্র তখন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলকে যৌথভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির একটি সমাধান খুঁজে বের করতে বলেছিল। ব্যাস সেই সুযোগে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বসতি ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অথচ ইসরায়েলসহ পুরো বিশ্ব ভালো করেই জানে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কারো দখল করা ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন সম্পূর্ণ বেআইনি।
কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাব কতটুকু কার্যকর হবে সেটা এখন দেখার বিষয়। আর এ বিষয়ে জাতিসংঘের কার্যকলাপ কিরূপ হবে ও তারা কতটুকু সফল হবে সেটাও বিবেচ্য। কারণ প্রস্তাবটি পাশ হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার দাম্ভিকতা প্রদর্শন শুরু করেছে। ইহুদি বসতির নির্মাণ বন্ধের প্রস্তাবটিকে তেল আবিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে মন্তব্য করেছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। প্রস্তাবটি উত্থাপনের আগে নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপচারিতায় এমনটাই বলেছিলেন তিনি। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে দ্য গার্ডিয়ান এ তথ্য জানিয়েছে।
শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি উত্থাপনের আগে নেতানিয়াহু নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারি ম্যাককালির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এসময় তিনি বলেন, ‘এটা জঘন্য সিদ্ধান্ত। আমি আপনাকে এটি সমর্থন না দেয়ার জন্য এবং এটি নিয়ে আর অগ্রসর না হওয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছি। যদি আপনারা এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন, তাহলে আমাদের দৃষ্টিতে তা হবে যুদ্ধ ঘোষণা। এতে আমাদের সম্পর্কের ইতি ঘটবে এবং এর প্রভাব পড়বে। আমরা নিউজিল্যান্ড থেকে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে জেরুজালেমে ডেকে নেব।’
পুরো বিষয়টিকে কতটা গুরুত্বের সাথে নিয়েছে ইসরায়েল তা নেতানিয়াহুর আলাপচারিতায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। রীতিমত হুমকি। যদিও নেতানিয়াহুর এই হুমকির পরও পিছু না হটার কথা জানিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ম্যককালি বলেন, ‘এই প্রস্তাব আমাদের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আমরা একে সামনে নিয়ে এগিয়ে যাব।’
জাতিসংঘ, তার প্রস্তাব কিংবা নিন্দা কোনটাই ইসায়েলের কিছু যায় আসে না। কারণ গত ৩৭ বছরের মধ্যে এই প্রথম জাতিসংঘে এ ধরনের (ইসরায়েলবিরোধী) কোনো প্রস্তাব পাস হলো। তাই সংগত কারণেও জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এছাড়াও নেতানিয়াহুর উপর তার দেশ থেকে চাপ বাড়ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দ্বৈত রূপ আর দেখতে চাচ্ছে না ইসরায়েলিরা। তাদের মতে, নেতানিয়াহু একই সঙ্গে ইহুদি বসতি স্থাপন এবং দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানে সমর্থন দিতে পারেন না। বিষয়টি দিন দিন আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। মূলত জটিল করে তোলা হচ্ছে। বাহ্যিকভাবে এই প্রস্তাব ইতিবাচক হলেও এটি অন্তঃসারশূন্য।
আরব বিশ্বের নিরবতা বিষয়টি আরও প্রকট করে তুলছে। দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যাকে জিইয়ে রেখে সমাধান তো করা সম্ভই হয়নি বরং তাদের এই নিরবতা ইসরায়েলকে ইন্ধন যুগিয়েছে কয়েকগুণ। যুক্তরাষ্ট্রের ভোট দানে বিরতী ইসরায়েলের জন্য তেমন সমস্যা নয়। কারণ হবু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের ইসরায়েলের ব্যাপারে রয়েছে সবুজ সংকেত। আগামী জানুয়ারিতে দায়িত্ব না নেয়ার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলকে ইহুদি বসতি স্থাপনের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান ধরে রাখার আহবান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এক টুইটার বার্তায় তিনি এ আহবান জানিয়েছেন। ট্রাম্প আরও লিখেছেন, ‘আমরা এভাবে আর ইসরায়েলের অমর্যাদা ও অশ্রদ্ধা হতে দিতে পারি না।’
কোন রাখঢাক না রেখেই প্রকাশ্যে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা, তাদের আগ্রাসী ভূমিকাকে প্রাধান্য দেয়া এবং আন্তর্জাতিক আইন লংঘনের বিষয়কে সমর্থন করাকেও পরোয়া করেনি ট্রাম্প। কারণ অপর একটি টুইটার বার্তায় ট্রাম্প বলেন, ‘তারা যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক ভাল বন্ধু হিসেবে পেয়েছিল। কিন্তু আর নয়। শুরু হয়েছিল ভয়ংকর ইরান চুক্তির শেষ দিয়ে। আর এখন এই (জাতিসংঘ)! শক্ত থাক ইসরায়েল। ২০ জানুয়ারি দ্রুত আসছে।’ প্রসঙ্গত, ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হবু প্রেসিডেন্টের প্রকাশ্য সমর্থন ইসরায়েলকে আরও বেপরোয়া করে তুলবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ক্ষমতায় গেলে ইসরায়েলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার ইঙ্গিত ট্রাম্প আগেই দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি বলেছেন, তিনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন। এমনকি ইসরায়েলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন ফিলিস্তিনবিরোধী ডেভিড ফ্রিয়েডম্যানকে। সম্প্রতি ফ্রিয়েডম্যান ঘোষণা দিয়েছেন, বসতি স্থাপন বন্ধের ব্যাপারে ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে কোনো ধরনের চাপ দেবে না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ছিল জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া।
ফিলিস্তিন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটা বড় ফ্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও সামরিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে ইসরায়েল হচ্ছে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ট্রাম্পের বড় দুই পুত্রবধূ ইহুদি ধর্মাবলম্বী। তাঁর প্রিয় কন্যা ইভানকার স্বামী জারেদ কুশনার একজন ধনাঢ্য ইহুদি ব্যবসায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং প্রযুক্তির প্রায় সব কটি ক্ষেত্রই নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদি স¤প্রদায়। সুতরাং ইহুদি স¤প্রদায়ের জন্য ট্রাম্প যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকে সফলভাবে চালাতে হলেও তাদের প্রয়োজন আছে ট্রাম্পের।
এক টুইটার বার্তায় ট্রাম্প লেখেন, ‘২০ জানুয়ারির পর জাতিসংঘের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতিই বদলে ফেলা হবে। ’ জাতিসংঘের নিস্ক্রিয়তা বহু আগে থেকেই। তার উপর যুক্তরাষ্ট্রে কর্তৃত্বপরায়ণতা এবং ট্রাম্পের নতুন নীতি কতটুকু স্বস্তি দিবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়াও ৬৫ লাখ ইহুদি অধ্যুষিত যুক্তরাষ্ট্র ক্রমে ক্রমে পরিণত হয়েছে দ্বিতীয় ইসরায়েলে। ভিতর বাহির যেভাবে দেখা হোক না কেন যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে আছে। আর এই পালে হাওয়া দিচ্ছে ট্রাম্পের নতুন প্রশাসন।
ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশেই স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারছে না। বিশেষ করে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে যখন-তখন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর আগ্রাসন, যাকে খুশি তাকেই বাড়ি থেকে তুলে নেয়া এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ২০০৭ সালে গাজায় সরকার পরিচালনার দায়িত্ব হামাস পাওয়ার পর থেকে সেখানে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী পণ্য পরিবহনে বিধি-নিষেধ আরোপ করে। যার ফলে সেখানে প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং ওষুধ নিতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে অপুষ্টিতে ভুগছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
দখলকৃত অংশে পানির নিয়ন্ত্রণও ইসরাইলের হাতে। ১৯৬৭ থেকে জবর-দখল করা ফিলিস্তিন অংশে পানির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে ইসরাইল। বিশেষ করে গাজা ও পশ্চিম তীরে পানির জন্য ফিলিস্তিনদের যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তার উপর যখন-তখন পানির সরবরাহ বন্ধ করে তাদেরকে বিপদে ফেলছে ইসরাইল। এ তথ্য ইসরাইলের মানবাধিকার সংগঠন বিৎসেলেমের। বেথেলহেমের বাসিন্দরা মানবাধিকার সংগঠনটির কাছে এমনও অভিযোগও করেছেন যে, টানা ৪০ দিন পানি সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছিল ইসরাইল। ওই সময় তাদের নাওয়া-খাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছু নিয়েই তাদের অবর্ণনীয় কষ্টে দিন কেটেছে। এমনকি গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিন হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা যাচ্ছে না ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞার কারণে। ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেক রোগীও চিকিৎসা করতে বাইরে যেতে চাইলে তাদের বাধা দিচ্ছে ইসরাইল। মিডেলইষ্ট মনিটর নামে একটি সংগঠন জানায়, এ বছর ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত ৫৪৮ ফিলিস্তিন নারী ট্রেভেল পার্মিটের জন্য আবেদন করলেও নিরাপত্তার অজুহাতে চার শতাধিক নারীকেই চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে দেয়নি ইসরাইলি প্রশাসন।
হাজারো সমস্যায় জর্জরিত ফিলিস্তিনিদের বহিস্কার করা হচ্ছে দখলকৃত এলাকা থেকে। গড়ে তোলা হচ্ছে ইহুদী বসতি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে নতুন করে ৬ লাখ ইহুদী বসতি স্থাপন করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অধিকৃত এলাকায় নতুন করে ২০ শতাংশ বসতি গড়ে উঠেছে। সেখানকার হাজার হাজার ফিলিস্তিন ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরাইল।
নিজ ভূমিতে ফিলিস্তিনিরা আজ পরাধীন। যখন-তখন বিনা প্ররোচনায় ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছে ইসরাইলি বাহিনী। বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পিটাচ্ছে, গুলি করছে। নিজ দেশে এখন তারা উদ্বাস্তু। আর এ বিষয়ে আইনী সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। বিভিন্ন সময় ফিলিস্তিন থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া লোকজনদের আট দিন পর্যন্ত বিনা বিচারে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে ইসরাইলে। অথচ, ইসরাইলি আসামিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করা হচ্ছে। ফিলিস্তিন বন্দিদের ব্যাপক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
কিন্তু কি হবে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে? দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে যুদ্ধ করা নিঃস্ব, রিক্ত ফিলিস্তিনিরা কতটুকু পারবে তাদের ভাগ্য ফেরাতে? প্রতিনিয়ত অসহায়ত্ব যেন তাদেরকে তাড়া করে ফিরছে। আরব বিশ্বের নিরবতা, পশ্চিমা বিশ্বের একচোখা নীতিতে ফিলিস্তিনবাসীরা হয়ত তাদের শেষ সম্বলটুকু হারানোর অপেক্ষায় প্রহর গুণছে।
লেখক: শিশু সাহিত্যিক
আরআর