মুফতি মাহফূযুল হক
শিক্ষক ও কলামিস্ট
প্রথম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে শুনি ও বলি পাঠে ‘ও’ অক্ষর চেনাতে ওড়না পরা একটি কন্যাশিশুর ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে ‘ওড়না চাই’। যারা এ বই রচনা, সম্পাদনা ও মূল্যায়নের সাথে জড়িত ছিলেন তারা এ দেশের মাটি ও মানুষের কাছে এমনকি শিশুদের কাছে অতি পরিচিত একটি বস্তু দিয়ে ‘ও’ বর্ণটি চেনানোর সুন্দর উদ্যোগ নিয়েছেন। ‘ও’ চেনানোর জন্য ওড়না শব্দ চয়ন করে তারা নিজেদের সুস্থ রুচি ও উদার মনের পরিচয় দিয়েছেন। তারা এ জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
কিন্তু যারা বরাবর গণবিচ্ছিন্ন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আদর্শ ও চেতনার প্রতি যারা কখনও শ্রদ্ধাশীল হতে পারেনি তারা স্বাভাবিক এ বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করার নিন্দনীয় চেষ্টায় মেতে উঠেছে।
ওড়না শব্দ নিয়ে যে কয়েকটি পয়েন্টে আপত্তি করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল, `এতে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে’। যারা এ আপত্তি তুলেছেন তারা মনে হয় চাচ্ছেন, সৃষ্টি ও প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের শিশুরা অজ্ঞ থাকুক। যেখানে প্রকৃতি নিজেই অলংঘনীয় এক বিভেদ সৃষ্টি করে রেখেছে সেখানে দৃশ্যমান এ বিভেদ এড়িয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে রাখা অযৌক্তিক ও অবাস্তব। নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে জানতে না পারলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আর নিজেকে জানতে হলে এটাও জানতে হবে আমি ছেলে, নাকি মেয়ে। নর-নারীর বিভেদ শিশুর থেকে লুকিয়ে রেখে তার মাতা-পিতা তাকে কিভাবে চেনাবেন, তার ভাই-বোন তাকে কিভাবে চেনাবেন, তার দাদা-দাদী তাকে কিভাবে চেনাবেন।
ওড়না শব্দ নিয়ে যারা আপত্তি করেছে তাদের মধ্যে অনেকেই বলেছে, ‘সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে এটি করা হয়েছে’। বড় আশ্চর্য লাগে এ সকল জ্ঞানপিপড়াদের দেখে। তাদের দৃষ্টির অন্ধত্ব, মনের সংকীর্ণতা আর বিবেকের প্রতিবন্ধকতা দেখলে তাদের উপর করুণা হয়। ওড়না শব্দ চয়ন যদি সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে হয়ে থাকে তবে ‘রথ’ শব্দ চয়ন কোন মানসিকতা থেকে হয়েছে। একই বইয়ে ‘র’ বর্ণ চেনাতে যেয়ে মূর্তি স্থাপিত রথ যাত্রার ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে “রথ টানি”। কিন্তু রথ টানাতে তারা সাম্প্রদায়িক মানসিকতা অনুভব করতে পারেন নি। অথচ রথ টানা নিছক হিন্দু সম্প্রদায়ের কাজ।
কিন্তু ওড়না পরা কোন সম্প্রদায়ের কাজ নয়। কেননা, হাজার বছরের গ্রাম বাংলার সাধারণ চিত্র এটাই যে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এ মাটির সকল সম্প্রদায়ের মেয়েরা ওড়না পরে থাকে। দেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দু মেয়েরা ওড়না পরে বাইরে বের হতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে থাকে। হ্যাঁ, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিষাক্ত বাতাস যে সকল শহুরে মেয়েদের গায়ে লেগেছে তারাই ওড়না ছাড়া চলাফেরা করে। এদের মধ্যে যেমন আছে হিন্দু মেয়ে তেমনই আছে মুসলিম মেয়ে। তাই ওড়না সাম্প্রদায়িক পোশাক নয় বরং আমাদের দেশীয় পোশাক। আমাদের আঞ্চলিক ঐতিহ্যের অংশ। ওড়না শব্দের চয়ন সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে হয় নি বরং ঐতিহ্যের প্রতি যত্নশীল মানসকিতা থেকে হয়েছে। বরং বলতে গেলে বলতে হবে ‘রথ’ শব্দ চয়ন হয়েছে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে।
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিষাক্ত বাতাস যে সকল শহুরে মেয়েদের গায়ে লেগেছে তারাই ওড়না ছাড়া চলাফেরা করে। এদের মধ্যে যেমন আছে হিন্দু মেয়ে তেমনই আছে মুসলিম মেয়ে। তাই ওড়না সাম্প্রদায়িক পোশাক নয় বরং আমাদের দেশীয় পোশাক।
এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আপত্তি করতে যেয়ে বলেছেন, ‘শিশুরা যখন জানতে চাবে ওড়না কেন ব্যবহার করা হয়, তখন কী উত্তর দেবেন শিক্ষকরা?’ এ দেশের শিশুরা এটা জানতে চাবে না। কারণ, তারা জন্মলগ্ন থেকেই দেখে আসছে তার মা ওড়না পরে কিন্তু বাবা পরে না। তারা বোন ওড়না পরে কিন্তু ভাই পরে না। স্কুলে যাওয়ার অনেক আগেই পরিবেশ দেখে এদেশের শিশুরা শিখে ফেলে যে, ছেলেরা ওড়না পরে না, কিন্তু মেয়েরা ওড়না পরে। পাঠ্যবইয়ে ওড়না দেখে এ দেশের শিশুরা একটুও অবাক হবে না। এতে ওরা নতুনত্বের কিছুই পাবে না। ওড়নার প্রতি নতুন কোন কৌতূহল ওদের মনে জাগবে না। তাই এ ধরণের প্রশ্নও শিশুরা করবে না। হ্যাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ প্রশ্ন করলেও করতে পারে।
আরেকটি আপত্তি মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছে, “শিশুদের কাছে ওড়না পরিচিত নয়। ওলকপি, ওজন ইত্যাদি দিয়ে শিশুদের সহজেই ‘ও’ বর্ণ চেনানো যেত।” এ আপত্তি ও সমাধান যে কত হাস্যকর তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ দেশের শতকরা কত জন শিশু ওলকপি চেনে? শিশু তো দূরের কথা উচ্চবিদ্যালয়ের শতকরা কত জন কিশোর বাস্তব জীবনে ওলকপি দেখেছে? মনে হয় তা না ভেবেই উক্ত পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শিশুরা ওলকপি আর ওজন না চিনলেও ওড়না ঠিকই চিনে। কেননা, এ দেশের শিশুদের মায়েরা ওড়না সরিয়ে পবিত্র স্তন্য দান করে শিশুকে বড় করেছে। তাই ওড়না এদেশের শিশুদের কাছে শুধু পরিচিত নয় বরং সুপরিচিত। এখানেই শেষ নয় বরং ওড়নার প্রতি রয়েছে শিশুদের মায়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
এক কথায় যারা ওড়না নিয়ে আপত্তি করেছেন, বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি অতিরিক্ত ঘৃণাবোধ থেকে এ কাজটি করেছেন। এবং অন্ধভাবে এ ঘৃণিত কাজটি করতে যেয়ে তারা বারবার বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন।
এআর