মুফতি দিদার শফিক
একটি পরিবার গড়ে ওঠে বাবা-মায়ের হাত ধরে। সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যান বাবা-মা। বাবা দেন অর্থের জোগান। মা সামলান ঘর। সন্তানের লালন-পালনে মায়ের ভূমিকা অনেক বেশি। কিন্তু সমাজচিত্রে দেখা যায় ‘মা’ খুব অবহেলিত হন পরিবারে।ইসলাম মাকে যথার্থ সম্মান দিয়েছে। দিয়েছে তার অধিকার। সন্তানের প্রতি মায়ের কোমল স্বভাব মায়ের অফুরন্ত ভালবাসার নিদর্শন। এ কোমলতাকে অনেক সন্তান যথার্থ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়। মা যেন অবহেলিত না হন, মায়ের অধিকার যেন রক্ষিত হয় সে লক্ষ্যে নবি সা. বলেছেন, ‘হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল 'ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি সর্বাগ্রে কার সঙ্গে সদাচরণ করব? রসুল সা. বলেন, তোমার মায়ের সঙ্গে। লোকটি প্রশ্ন করল, তারপর? উত্তর এলো তোমার মা। লোকটি আবার জানতে চাইল অতঃপর কে? রসুল সা. এবারও জবাব দিলেন তোমার মা। ওই লোক চতুর্থবার একই প্রশ্ন করলে রসুল সা. বলেন, তোমার পিতা। ' বোখারি ও মুসলিম
সন্তান মায়ের তুষ্টির সেবাদাস।মায়ের তুষ্টিতেই সন্তানের দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা। যার প্রতি মা সন্তুষ্ট তার দুনিয়া ও আখেরাত উজ্জ্বল। মায়ের তুষ্টি-অতুষ্টির উপর নির্ভর করে সন্তানের ভবিষ্যৎ। তাই নবি সা. বলেছেন,‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’
মায়ের অবাধ্য সন্তানকে আখিরাতে কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। আলকামা নামক এক সাহাবি মৃত্যুমুখে পতিত। মৃত্যু- মুহূর্তে তার মুখ দিয়ে কালেমা বের হচ্ছে না। খবর পেয়ে রসুলুল্লাহ এলেন এবং তিনি আলকামার মাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি পুত্রের ওপর অসন্তুষ্ট? উত্তরে তিনি বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমার ছেলে আমার চেয়ে তার স্ত্রীকে বেশি গুরুত্ব দিত। এ কারণে আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট। তখন রসুলুল্লাহআদেশ দিলেন, আলকামাকে আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দাও। আলকামার মা এ কথা শুনে হাউমাউ করে কান্নাকরে চিৎকার দিয়ে বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ!
আমার চোখের সামনে আমার সন্তানকে আগুনে জ্বালিয়ে দিলে আমি মা হয়ে কীভাবে তা সহ্য করব? রসুলুল্লাহ তখন আলকামার মাকে অনুরোধ করলেন, তাহলে আপনার সন্তানকে ক্ষমা করে দিন। তা না হলে চিরকাল সে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। তা আপনি কী করে সহ্য করবেন? একথা শুনে মায়ের মন নরম হয়ে গেল, তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করে দিলেন। তারপর আলকামার জবান থেকে কালেমা তাইয়্যেবা জারি হয়ে গেল এবং কালেমা পড়তে পড়তে ইমানের সঙ্গে আলকামা মৃত্যুবরণ করলেন।
মা অসন্তুষ্ট হলে সন্তানের আখেরাতের শান্তি অনিশ্চিত হয়ে যায় হাদিস থেকে এটাই স্পষ্ট হয়েছে। তাই সন্তানের উচিত দায়িত্ব-কর্তব্যের দায় ছাড়াও নিজের ভবিষ্যৎভাবনায় মাকে সন্তুষ্ট রাখা।
কারও আচরণে মা-বাবা কষ্ট পেলে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। নিজের সুবিধা কিংবা স্বার্থের জন্য বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। ইসলামে হিজরত ও জিহাদ অনেক সওয়াবের কাজ। হাদিস পাঠে দেখা যায় বাবা-মাকে কষ্টে ফেলে হিজরত ও জিহাদে যাওয়ার অনুমতি দেননি নবি সা.।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, এক ব্যক্তি তার বাবা-মাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হিজরতের উদ্দেশ্যে বাইআত হওয়ার জন্য উপস্থিত হলো। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : বাবা-মার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের যেমনিভাবে কাঁদিয়ে এসেছ, তেমনিভাবে তাদের মুখে হাসি ফোটাও। আদাবুল মুফরাদ
এ হাদিসে রয়েছে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য পালনের বিবেক জাগানিয়া বার্তা। বাবা-মা যখন দুর্বল, বয়োবৃদ্ধ হয়ে যান এবং সন্তানের সাহায্য-সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও সওয়াবের আমলের চেয়েও তাদের সেবা-শুশ্রুষা করা অধিক উত্তম।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৈশবে তার জননীকে হারান। জননীর প্রতি দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য তার সেভাবে হয়নি।
আবু দাউদ শরিফের হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যখন তার দুধমা হালিমা সাদিয়া আসতেন তখন তিনি তাকে দেখামাত্রই সম্মান জানিয়ে ওঠে দাঁড়াতেন। নিজের পাগড়ি অথবা গায়ের চাদর বিবি হালিমাকে বসার জন্য পেতে দিতেন। মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন শুধু মৌখিকভাবে নয়, আচরণ-ব্যবহারের মধ্যদিয়ে প্রকাশ হতে হবে। উপর্যুক্ত হাদিস থেকে এ শিক্ষাই পাওয়া যাচ্ছে।
মা কষ্ট পেলে কষ্টদানকারী সন্তান দুনিয়ায়ই ফেঁসে যায়। আখেরাতও ধ্বংস হয়। তাই মায়ের মর্যাদা কেমন, কোন পর্যায়ের তা অনুধাবন করা খুবই জরুরি। মায়ের কাছে বেশি বেশি দোয়া ও মায়ের হক আদায় করার মাধ্যমে সন্তানের জীবন আলোকময় হয়ে ওঠতে পারে। হাদিস থেকে এমন ঈঙ্গীতই পাওয়া যায়।রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মায়ের দোয়া অতি দ্রুত আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। আল্লাহ বান্দার সব গোনাহ ইচ্ছামতো ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু মাতা-পিতার অবাধ্যতার গোনাহ আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। বরং ওই অবাধ্য সন্তানকে এই পার্থিব জীবনের মৃত্যুর আগে শাস্তি দিয়ে থাকেন। বায়হাকি
প্রতিটি সন্তানের মনে রাখত হবে মায়ের রক্তে-মাংসেই বেড়ে ওঠেছি আমি। আজকের আমি ‘আমি’ হওয়ার পেছনে মায়ের অনেক ত্যাগ ও দুঃখ-বেদনার অতীত রয়েছে। আমার বর্তমান ও মায়ের অতীত এ দুয়ের মাঝে রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় ও পালনীয় বিষয়। এ বিষয়গুলো সন্তানের সামনে উপস্থিত থাকলে পৃথিবীর সকল মা-ই হবেন রত্নগর্ভা শ্রেষ্ঠ মা।
লেখক: আলেম ও মিডিয়াকর্মী