আওয়ার ইসলাম: গত ১৩ নভেম্বর ভারতের আজমির শরিফে অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ‘বিশ্বশান্তি সম্মেলনে’ যোগদান শেষে ১৪ তারিখে দেওবন্দ আসেন আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তিনি অবস্থান করেছিলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সেক্রটারী জেনারেল মাওলানা সাইয়্যিদ মাহমুদ আসআদ মাদানি’র বাসায়৷
পরদিন (১৫ নভেম্বর) দুপুর পৌনে ২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বাংলাদেশি ছাত্রদের নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন৷ দেশে যেসব বিষয় নিয়ে হজরতের নামে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোরও তিনি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করেন৷ এ সময় ছাত্ররা আলেচিত 'কওমি স্বীকৃতি' নিয়ে হজরতের অবস্থান, স্বীকৃতির ধরণ, কার মাধ্যমে হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চায়৷
সেই আলোচনাগুলো 'আওরইসলাম টোয়েন্টিফোর' এর পাঠকদের জন্য লিখে পাঠিয়েছেন, দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষার্থী ও আওয়ার ইসলামের' দেওবন্দ প্রতিনিধি হাওলাদার জহিরুল ইসলাম
# দেশের সব আলেমই কি স্বীকৃতি চান?
## স্বীকৃতির ব্যাপারে মূল কথা হলো স্বীকৃতি সবাই চায়, সবাই এর পক্ষে বলে৷ এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি স্বীকৃতির বিরোধিতা করেন৷ বাংলাদেশের কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের কেউই বিরোধী নন৷ তবে যারা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন তারা কেবল রাজনৈতিক কারণেই এর বিরোধিতা করছেন এবং তারা কয়েক জায়গায় বলেছেনও, ‘যদি আওয়ামী লীগ স্বীকৃতি দেয় তাহলে তো আ'লীগের নাম হয়ে যাবে৷ তাই আমরা বিএনপি থেকে স্বীকৃতি নিতে চাই৷’ স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তাকে এরাও অস্বীকার করেনি৷
এই স্বীকৃতির জন্য বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক, শায়খুল হাদিস আজিজুল হক রহ. সহ অনেকে আন্দোলন করেছেন৷ তারা তো এতো চেষ্টা করেছেন যে শায়খ বৃদ্ধ বয়সে পল্টনে ধুলোমাখা রাস্তায় ৩ তিন দিন পর্যন্ত পড়েছিলেন৷ বিএনপি-জামায়াত তখন ক্ষমতায়৷ তাদের একটি লোক এসে হজরতকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না! অথচ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উনার থেকে তারা ফায়দা হাসিল করেছে৷ চার দলীয় জোট গঠন করে তারা ক্ষমতায় গেছে৷ তারা হজরতকে ব্যবহার করেছে৷
# যদি সবাই স্বীকৃতি চায় তাহলে এখতেলাফ কেনো?
## এখতেলাফ হলো স্বীকৃতির ধরণটা কী হবে এটা নিয়ে। কেউ বলছেন দারুল উলুম দেওবন্দের আদলে হবে৷ কেউ বলছেন সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে৷ আবার কেউ এই ভয় করছেন যে একবার স্বীকৃতি নিলে যদি পরবর্তীতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ এসে যায়!
যারা বলছেন- যেমন হজরত আল্লামা আহমদ শফি সাহেব বলেছেন, স্বীকৃতি চাই দেওবন্দের আদলে৷ এখন দেওবন্দের আদলটা কী তা কেউ স্পষ্ট করছেন না৷ দেওবন্দ তো কারো কাছে স্বীকৃতির জন্য যায়নি৷ দেওবন্দের যে হায়সিয়ত (মর্যাদা-অবস্থান) যা বিগত দেড়শ পৌনে দুইশ' বছরে হাসিল হয়েছে৷ বাংলাদেশের সকল মাদরাসা মিলে কি সে হায়সিয়তে আসবে?
আমার ব্যাপারটা দেখো, বাংলাদেশ গভঃর্মেন্টের সর্বোচ্চ পদে চাকরি করতেও আমার কোনো সনদ বা স্বীকৃতি লাগেনি৷ দেখো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এরা তেমন পড়ালেখা করেননি৷ কিন্তু বিএ, এমএ-তে তাদের গল্প-কবিতা, রচনা পড়ানো হয়৷ এদের যে হায়সিয়ত তা কি তোমার হবে? সুতরাং তোমার এ চিন্তা করাটাই বাতুলতা যে দেওবন্দের যে মর্যাদা সে মর্যাদা তোমার হবে! ধরো, মেনে নিলাম তোমার সে মর্যাদা হবে৷
তবুও দেখো, দারুল উলুম দেওবন্দের স্বীকৃতিতে কোনো বিশেষ কিছু নেই৷ এটা দিয়ে ভারতের কোনো কোনো ইউনিভার্সিটি যেমন, আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়, দিল্লির জমিয়া মিল্লিয়া, নেহরু ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দিয়ে অনার্সে ভর্তি হওয়া যায়৷ ভালো সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে হলে পৃথকভাবে ইংলিশ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়৷
আমরা তো দাবি করেছি এমএ-র মান৷ আর এখানে (ভারতে) দেয়া বয়েছে ইন্টারের মান৷ অনার্সে ভর্তি হওয়ার মানে কী? ইন্টারের মান৷
আর যদি দেওবন্দের আদল বলতে এটা বোঝানো হয়, দারুল উলুম দেওবন্দ যে বুনিয়াদের উপর চলে আসছে অর্থাৎ 'উসুলে হাশতেগানা' এটা তো আমরা আমাদের খসড়া আইনের মধ্যে লিখে দিয়েছি যে বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো চলবে উসুলে হাশতগানা'র ভিত্তিতে৷
আমি কিন্তু কওমি শব্দটা পছন্দ করি না৷ কেনো করি না? কওমি জুট মিলস এবং আরো কয়েকটি কম্পানি আছে এ নামে৷ আর এই মাদরাসাগুলো মৌলিকভাবে পাকিস্তানিদের খপ্পরে পড়ে কওমি নাম দিয়েছে৷ আমাদের ছোট বেলায় এগুলেকে কওমি বলা হতো না৷ আসলে এগুলো দেওবন্দী নেসাবের মাদরাসা৷ এখন কওমি শব্দটা চালু করা হয়েছে দেওবন্দকে ভুলিয়ে দেয়ার জন্য৷ এটা আমার মত৷ তুমি এক্ষেত্রে আমার সাথে একমত নাও হতে পারো৷ আমার সাথে একমত হওয়া জরুরি নয়৷
তো দেওবন্দ বললে আকাবিরদের একটা ফেহরিস্ত (তালিকা) চোখের সামনে এসে যায়৷ কওমি বললে এরা চোখে ভাসে না৷ এখানে (দেওবন্দে) কাউকে কওমি মাদরাসা বলতে শুনেছো? এটা পাকিস্তান চালু করেছে৷ আর পাকিদের প্রভাবে আমাদের ওখানে চালু হয়েছে৷ যাই হেক, তো উসুলে হাশতগানা চলবে এটা আমরা লিখে দিয়েছি৷ আমরা খসড়া আইনে এটাও লিখে দিয়েছি যে এটা (স্বীকৃত) হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা৷ স্বাধীন বলতে এর ওপর কেউ কোনো প্রকারের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না৷ আর সংবিধিবদ্ধ এর অর্থ হলো এটা পার্লামেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হবে৷ আর পার্লামেন্ট এটাকে রদ বা বাতিল করতে চাইলে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য লগবে৷ আর কোনো পার্লামেন্টে কোনো পার্টির দুই-তৃতীয়াংশ হওয়াটা প্রায় অসম্ভব৷ এবার তো খালেদা জিয়ার বোকামি আর শেখ হাসিনার কপালের কারণে তারা এতো বেশি পাশ করেছে৷ সুতরাং একবার পাশ হয়ে গেলে কেউ চাইলেই হস্তক্ষেপ করতে পারবে না৷
আমরা এও বলেছি যে এর কমিটিতে কেবল উলামায়ে কেরামই থাকবে৷ গভঃর্মেন্টের কেউ এর সদস্য হতে পারবে না৷ আরো বলেছি, স্বীকৃতি হবে হজরত আহমদ শফী সাহেবের মাধ্যমে৷ কয়েকদিন আগে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আমার বৈঠক হয়েছে সেখানেও স্পষ্ট করে বলেছি স্বীকৃতি নেয়া হবে হজরত আহমদ শফী (দামাত বারাকাতুহুম) কে সদর বানিয়ে৷ এ প্রস্তাব আমি নিজে দিয়েছি৷
# আপনি কিছু দিন আগে বলেছিলেন আপনাকে আহমদ শফী’র সাথে দেখা করতে দেয়া হয় না?
## হ্যাঁ, এটা সত্য৷ কেনো দেখা করতে দেয়া হয় না আমার বুঝে আসে না৷ হজরত তো চান আমি তার সাথে দেখা করি৷ কিন্তু মুশকিল হলো, হজরতের আশ-পাশে যারা থাকেন তারা অনেকের মাধ্যমে (পরামর্শে) চলেন৷ তাদের অনেক ধরনের মতিগতি৷ আমি একবার হাটহাজারী মাদরাসায় গেলাম৷ তারা আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে বসিয়ে রাখলো৷ শেষে বললো, হজরত অসুস্থ৷ দেখা করা যাবে না৷ আমি চলে এলাম৷ আলহামদুলিল্লাহ! আমি এমন একজন ছোট মানুষ যাকে শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় গেলে সম্মান দেয়া হয়!
আমি হজরতকে সম্মান করি৷ বাস্তবে সম্মান করি বলেই সরাসরি হজরতের সঙ্গে দেখা করতে চলে গিয়েছি৷ কেনো তাকে সম্মান করবো না? তিনি শাইখুল ইসলাম হজরত হুসাইন আহমদ মাদানি রহ এর শাগরেদ এবং তাঁর খলিফাও৷
ওই বার হাটহাজারী থেকে আসার পর তাদের আমি বলেছিলাম, আমরা টিম নির্ধারণ করে আমাকে বললে যে কোনো সময় আমি আসতে প্রস্তুত৷ গিয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করার তো কোনো মানে হয় না৷
মূল কথা হলো, আমি হজরতের মাধ্যমেই স্বীকৃতি চাই৷ তিনি সরকারের কাছে মাথা নত করবেন? কখনোই না৷
অনেকেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে দেশের সাধারণ ছাত্রসমাজকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে৷ এ ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবিরের লোকেরা এগিয়ে আছে৷ আমি স্পষ্ট করে বলছি, স্বীকৃতি চাওয়া, এ নিয়ে কাজ করার মধ্যে আমার বিন্দুমাত্র স্বার্থ নেই৷
[উল্লেখ্য, গত ১০ ডিসেম্বর হাটহাজারীতে আল্লামা আহমদ শফী’র আহ্বানে একটি বৈঠক হয়েছে যেখানে আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদও অংশ নিয়েছিলেন।]
# আপনি স্বীকৃতি কেনো চান?
## কওমি স্বীকৃতি হলে এর মাধ্যমে কওমি মাদরাসার ছেলেরা চাকরি পাবে, এই হবে, সেই হবে এটা আমার উদ্দেশ্য নয়৷ আমার স্বীকৃতি চাওয়ার উদ্দেশ্য হলো, এ দেশের মাদরাসাগুলোকে সত্যিকারার্থে দারুল উলুম দেওবন্দের সাথে একটি স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করে দেয়া৷ স্থায়ী সম্পর্কের উপায় বের করে দেয়া৷
আমি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এ নিয়ে কথা বলেছি৷ তিনি বলেছেন, আপনাদের তো সরকারি কোনো সার্টিফিকেট নেই৷ প্রথমে আপনারা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হোন৷ পরে আমরা সহযেগিতা করবো৷
শ্রুতি লিখন: হাওলাদার জহিরুল ইসলাম / শিক্ষার্থী: দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত৷
আরআর