۞ মুফতি মাহ্ফুজুর রহমান হুসাইনী
জসনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী। 'সকল ঈদের সেরা ঈদ ঈদে মীলাদ' এই স্লোগানে রাস্তা-ঘাট কেঁপে উঠে। মিছিল, আনন্দ র্যালী, মিষ্টি বিতরণ ও খাওয়া দাওয়ার ধুম পড়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কতিপয় মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম দিবসকে কেন্দ্র করে ১২ রবিউল আউয়ালে ঈদে মীলাদুন্নবী সা. উদযাপন করে থাকে। পূর্বে থেকেই পোস্টারিং, দেয়াল লেখন ও মাইকিং করা হয়। কয়েক বছর আগেও এই ঈদের কথা মানুষ জানত না। কুরআন-হাদীসেও এই ঈদ-উৎসবের কোন আভাস নেই।
ইসলামে কেবল মাত্র ঈদ-উৎসব দুটি। হযরত আনাস বিন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পৌঁছে দেখলেন বছরে দুটি দিন মদীনাবাসিরা আনন্দ-ফূর্তি করে থাকে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এ দিন দুটি কিসের?
তারা বলল, আমরা জাহেলি যুগে এই দুই দিন আনন্দ-ফূর্তি করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এ দুদিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন, তা হল ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর। আবু দাউদ, হদিস নং-১১৩৬
সহীহ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত ইসলামে ঈদ-উৎসব শুধু দুটি এবং এটি ইজমায়ে উম্মত দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত। যদি কেউ ইসলামে তৃতীয় আরেকটি ঈদের প্রচলন করে তবে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমাদের এ দ্বীনে নাই এমন নতুন কোন বিষয় কেউ প্রচলন করলে তা প্রত্যাখ্যাত। বুখারি, হাদিস নং-২৬৯৭
আশেকে রাসূলের দাবি করে মূলত ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করা হয়। এটা যদি আশেকে রাসূলের বহিঃপ্রকাশ বা ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হত তাহলে সাহাবায়ে কেরাম রা. অবশ্যই এই ঈদ পালন করতেন। কেননা, তাঁরাই হলেন নবীজির সবচেয়ে বড় আশেক ও সর্বোচ্চ অনুসারী। পৃথিবীতে তাঁরা নবী প্রেমের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
কোন হাদিসের কিতাবে বা নির্ভরযোগ্য কোন গ্রন্থে তাঁদের থেকে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের সামান্যতম প্রমাণও পাওয়া যায় না। হাদিসে উল্লেখ আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুক্রবার ও আরাফাতের দিনের ফযিলত বুঝাতে ঈদ বলেছেন। কিন্তু তাঁর জন্ম দিবস উপলক্ষে ঈদ পালন বা উৎসবের কথা কোথাও বলেন নাই এবং কোন ধরনের ইংগিতও দেন নাই। বরং তাঁর জন্মদিবসকে তিনি ঈদ-উৎসবে পরিণত করার বিরোধিতা করে গেছেন।
সাহাবী আবু কাতাদাহ রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোমবারে রোযা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি বললেন, এ দিনে আমার জন্ম হয়েছে এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়ত দেয়া হয়েছে বা আমার উপর কুরআন নাজিল শুরু হয়েছে। মুসলিম, হাদিস নং- ২৮০৪
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়তো জানতেন পরবর্তীতে কিছু লোক তাঁর জন্মদিবসে ঈদ-উৎসব পালন করবে। এ কারণে তিনি নিজেই জন্মদিবসে রোযা রেখে ঈদের বিরোধী করেছেন। কেননা, রোযা ঈদের বিপরীত। ঈদ মানে আনন্দ-উৎসব, খাওয়া দাওয়া, ফূর্তি করা। আর রোযা এসবের ব্যতিক্রম। এ কারণে ইসলামের দুই ঈদে রোযা রাখা নিষেধ।
নিঃশর্তভাবে নবীজির আনুগত্যের মাঝেই রয়েছে সকল সমস্যার সমাধান: এ কিউ এম ছফিউল্লাহ আরিফ
সাহাবি আবু সাইদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। বুখারি, হাদিস নং-১৯৯১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য রহমত সরূপ। তাঁর উপর দুরুদ পড়া, তাঁকে শ্রদ্ধা করা, সম্মান করা, অনুসরণ করা ঈমানি দায়িত্ব। কিন্তু তিনি যা করেন নাই, বলেন নাই এবং ইসলামে যা নাই তা কখনোই করা যাবে না। বাহ্যিকভাবে তা যতই ভাল হোক। যেমন, নামায সবচেয়ে বড় ইবাদত এবং সবোর্ত্তম ভাল কাজ। যদি কেউ ফজরের ফরয দুই রাকাতের পরিবর্তে বাড়িয়ে চার রাকাত ফরয পড়ে তবে অবশ্যই সে গোনাহগার হবে। নামায সবচেয়ে ভাল কাজ হওয়া সত্ত্বেও বাড়ানোটা অন্যায়। কেননা, ইসলামের হুকুম-আহকাম সুনির্ধারিত। ইসলামের নির্ধারিত দুই ঈদের সাথে নতুন করে তৃতীয় আরেকটি ঈদ উদ্ভাবন করা মারাত্মক গোনাহের কাজ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, সবচেয়ে নিকৃষ্টতম বিষয় হল (ইসলামের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। প্রতিটি নব উদ্ভাবিত বিষয় বিদআদ ও প্রতিটি বিদআদ গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহী জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।নাসায়ী শরীফ, হাদিস নং-১৫৮৯
ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রচলন হয়েছে নবী ও সাহাবাদের যুগের অনেক পরে। হিজরি সপ্তম শতাব্দীতে ক্রুসেড বিজেতা সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী কতৃক নিযুক্ত ইরাকের এরবল এলাকার গভর্নর আবু সাইদ মুযাফ্ফর উদ্দিন কুকুবুরী সর্বপ্রথম ৬০৪ হিজরিতে ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রচলন ঘটায়। রাসূলের মৃত্যুর ৫৯৩ বছর পরে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের নামে তারা চরম সেচ্ছাচারিতা শুরু করে। গভর্নর নিজে তাতে অংশ নিতেন।
এই অনুষ্ঠানের সমর্থনে এগিয়ে আসেন তখনকার তথাকথিত আলেম আবুল খাত্ত্বাব ওমর বিন দেহিইয়াহ। তিনি এর সমর্থনে কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যাসহ বহু জাল ও বানাওয়াট হাদিস জমা করেন।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বালুদিঘি ঘাট নিকটস্ত খানখায়ে কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া থেকে ১৯৭৪ সালে আঞ্জুমানে রাহমানিয়া আহমাদিয়ার ব্যাবস্থাপনায় ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে জসনে জুলুসের প্রবর্তন করেন। তারপর ঢাকায় সর্বপ্রথম ১৯৮০ সালে ৯ রবিউল আউয়ালে জসনে জুলুসের মিছিল বের করা হয়। ইসলাম প্রবর্তনের এত বছর পরে যেই ঈদের আবিষ্কার তা ইসলামের কোন ঈদ হত পারে না। নিঃসেন্দহে এটা মানুষের বানানো ও নব উদ্ভাবিত ঈদ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে যে বেঁচে থাকবে সে বহু মতবিরোধ দেখতে পাবে। সাবধান! তোমরা নব উদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কেননা, তা গোমরাহী। তোমাদের মধ্যে কেউ সে যুগ পেলে সে আমার সুন্নত ও হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত অনুসরণ করবে। তোমরা এটাকে খুব মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে। তিরমিযী, হাদিস নং-২৮৯১
তিনি আরো ইরশাদ করেন, আমার পূর্বে কোন জাতির কাছে আল্লাহ যে নবীকেই পাঠিয়েছেন, সে জাতির মধ্যে থেকে তাঁর সহযোগী ও সঙ্গী থাকত। তাঁর সুন্নতকে তারা আঁকড়ে ধরতো এবং তাঁর হুকুমের অনুসরণ করতো। তাদের পর এমন কিছু লোকের উদ্ভব হল তারা যা বলতো নিজেরা তা করত না এবং এমন কাজ করত যা তাদের নির্দেশ দেয়া হয়নি। এধরনের লোকের বিরুদ্ধে যে হাত দিয়ে জিহাদ করবে সে মুমিন, যে মুখ দিয়ে জিহাদ করবে সেও মুমিন, যে অন্তর দ্বারা জিহাদ করবে সেও মুমিন। এরপর সরিষার দানা পরিমাণও ঈমানের স্তর নেই। মুসলিম, হাদিস নং-১৮৮
ঈমানী দায়িত্ব হল, প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীজির সুন্নত ও হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত অনুসরণ করা এবং এসব নব আবিস্কৃত বিষয় পরিহার করা ও যথাসম্ভব এর প্রতিরোধ করা। কমপক্ষে অন্তর দিয়ে ঘৃণা হলেও করতে হবে। এটাই ঈমানের নিম্মস্তর। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।।
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া শায়েখ আব্দুল মোমিন, মোমেনশাহী