মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ দমন-পীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত জরুরি ভিত্তিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভা ডাকা।
আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেখানে যাওয়া উচিত। রেডিও তেহরানের সাথে দেয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে এমন অভিমত দিয়েছেন বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ দমন-পীড়ন ও নির্যাতন চলছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই নির্যাতন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয় কী?
দেখুন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ দমন-পীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করার ব্যাপারে যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিকতা থাকত তাহলে জরুরিভিত্তিতে সব বড় শক্তি একত্রিত হয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভা ডাকত এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রতিরোধ ও প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করত। তারপর জাতিসংঘের মাধ্যমে ন্যাটো বাহিনীকে দিয়ে মিয়ানমারে এক বা দুই দিনের জন্য হামলা চালাতে পারত। তাহলে মিয়ানমার সাথে সাথে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হতো এবং তাৎক্ষণিকভাবে এর সুফল পাওয়া যেত। মিয়ামারে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধে এটাই সবচেয়ে আদর্শ ব্যবস্থা হতে পারত। কিন্তু সেটা হবার নও। তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্পদ্রায়ের পক্ষ থেকে যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল তা দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ কী? কেন এই পিছু টান?
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ার কারণ হচ্ছে- আসলে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও বৃটেন –এরা সবাই মিয়ানমারে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা চিন্তা করছে। তারা মনে করে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেলে এ ধরনের বর্বরতা কমে যাবে।
তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি মিয়ানমার সরকারে যে পথ বেছে নিয়েছে সেটা অনেকটা কসোভোতে সার্ভিয়ারা যে পথ বেছে নিয়েছিল তার মতো। মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে আরাকান থেকে বের করে দিতে চাচ্ছে। এখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের কোনো চিহ্ন রাখতে চাচ্ছে না। এটা অত্যন্ত ভয়াবহ আত্মঘাতী পদক্ষেপ।
তারপরও কিছুটা হলেও প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়া ও মালেয়েশিয়াসহ বেশ কিছু দেশ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে একটা হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এরপরও মিয়ানমার সরকার আদৌ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর তাদের অত্যাচার-নির্যাতন এবং হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করবে কিনা তা নিশ্চিতবাবে বলা যায় না।
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকাকে আরো বেশি জোরদার দেখতে চায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের এই দাবিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মিয়ানমার ইস্যুতে আমরা অনেক সময় মনে করি যে বাংলাদেশ যদি তাদের সীমান্ত একেবারে খুলে দেয় তাহলে এই লোকগুলোর জীবন বেঁচে যাবে। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। সেটি হচ্ছে- আমরা যদি সীমান্ত খুলে দেই তাহলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর তাদের দমন নীতি আরো শতভাগ বৃদ্ধি করবে। এখনও বাকি প্রায় ৪/৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান সেখানে রয়েছে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। আমরা জানি বেসরকারি সূত্রমতে গত এক সপ্তায় প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশ ঢুকেছে। আর এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। বনে জঙ্গলে দিন কাটাচ্ছে এবং নদীতে ভাসছে বহু রোহিঙ্গা। তারা চেষ্টা করছে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে। যদিও জাতিসংঘ কর্তৃক সরকারিভাবে বলা হচ্ছে মাত্র ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে জাতিসংঘের এই তথ্য সঠিক নয়।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য হচ্ছে বর্তমান আন্তর্জাতিক বাস্তবতার একটি সুযোগে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে নিধন করা বা দেশ থেকে বের করে দেয়া।
আর আন্তর্জাতিক বাস্তবতার বিষয়টি হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণ করবে। এ সময় তারা অনেকটা নিশ্চূপ। তুরস্ক সংকট নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনেকটা ব্যস্ত। ইউরোপে অনেক শরণার্থী ঢুকেছে সিরিয়া থেকে। এই যে বৃহৎ দুই পশ্চিমা শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ এখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা নিয়ে ব্যস্ত। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এই সুযোগটা গ্রহণ করছে। তারা এমনটি মনে করছে পশ্চিমা বিশ্ব তুলনামূলকভাবে যখন নির্লিপ্ত সে সুযোগে তারা বাংলাদেশের ওপর আঘাত করতে চায়।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক প্রয়াস এবং সমর্থনের বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি একটা প্রক্রিয়া। আমি মনে করি বাংলাদেশের কিছুটা শক্তিভিত্তিক যোগ্যতা অর্জন করা উচিত।
যেমন দেখুন চীন ও থাইল্যান্ডও মিয়ানমারের শরণার্থী দ্বারা আক্রান্ত। তবে তাদের পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি আছে এবং তা তারা ব্যবহার করে। চীনও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সামরিক অ্যাকশনের হুমকি দিয়েছে। আর থাইল্যান্ডের বাহিনী তাদের সীমান্তে প্রায়ই পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। আর আমরা আমাদের সীমান্তে সম্পূর্ণভাবে তোষামোদ নীতি অনুসরণ করছি। আমাদের সামর্থ্য এবং সামরিকবাহনী নিজেদেরকে অত্যন্ত দুর্বল প্রমাণিত করেছে। একথা বলছি এজন্য যে- সীমান্তে আমাদের সেনাবাহিনীর কোনো উপস্থিতি নেই-এবং সেখানে এই পরিস্থিতিতে যাওয়ার কোনো প্রস্তুতিও নেই। শুধুতাই নয় নিবারক হিসেবে তুলে ধরার মতো তাদের কোনো আগ্রহও দেখা যায় না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুধু বিজিবিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া বিজিবির হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্র গোলাবারুদও নেই। আজকের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেখানকার মুসলমানদের শরাণার্থীতে পরিণত করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বিজিবিকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন ছিল। সুতরাং যতদিন আমরা আমাদের নিজেদের বাহিনীকে সামর্থ্যবান করতে না পারব ততদিন রোহিঙ্গা শরণার্থী দ্বারা আমরা বারবার আক্রান্ত হতে থাকব। রোহিঙ্গারাও আক্রান্ত হবে এবং বারবার তারা আমাদের ভূসীমানায় প্রবেশ করার চেষ্টা করবে।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি কিন্তু নীরবতা পালন করছেন বলে আমরা দেখতে পাচ্ছ। তার এ ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
দেখুন অং সান সুচির কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু আশা করি। কিন্তু বড় হচ্ছে আমরা তার কে হই এবং রোহিঙ্গা মুসলমানরা তার কে হয়! অং সান সুচি সম্পর্কে আমাদের এই প্রত্যাশার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো উচিত।
অং সান সুচির বাবা মিয়ানমার রাষ্ট্রের স্রষ্ঠা ছিলেন। তিনিও সুস্পষ্টভাবে মিয়ানমার ভাবাপন্ন একজন জাতীয়তাবাদী নেতা। তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে আজ পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো অবস্থান নেন নি। তিনি কখনও একথাও বলেন নি যে রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদের সমঅধিকার ফিরিয়ে দেয়া হবে। তার অবস্থান সবসময় অস্পষ্ট। তাছাড়া দীর্ঘসময় তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। জীবনের এই শেষপ্রান্তে এসে তিনি নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বুঝছেন না –এটাই বাস্তবতা। তিনি তার নিজ সম্প্রদায়ের রাখাইন বৌদ্ধদের কাছে হিরো হতে চান। তাদের কাছে তিনি একজন মহান নেত্রী হতে চান। তিনি যদি রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নেন তাহলে শুধু তার দেশবাসী বৌদ্ধরাই নয় সামরিকবাহিনী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে আবার অর্ন্তবাসে পাঠাবে। আর সেটা হবে অং সান সুচির জন্য চরম দুর্ভোগ। তিনি সেরকম জীবন চান বলে মনে হয় না।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অং সান সুচির মতো ব্যক্তিত্ব আপনারা ভুরি ভুরি দেখতে পাবেন যারা শান্তির জন্য কোনো কাজ করছে না। অতীতের হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব। আমাদের ড. ইউনূস এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তারা শান্তির জন্য কি করেছেন বা করছেন। ওবামার সময় মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম নিধন হয়েছে এবং ইসরাইল আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গ করেছে। বারাক ওবামার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ফলে বিশ্বের কোনো লাভ হয়নি। ড. ইউনূসকে দিয়েও শান্তির পক্ষে কোনো কথা বলা বা উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয়নি। কাজেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা হচ্ছে নিছক একটা অলংকার। যাদের স্বার্থে এটা দেয়া হয়- তাদের স্বার্থকেই এরা তুলে ধরেন। অং সান সুচি এ বিষয়ে কোনো ব্যতিক্রম নন।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের এই বিদ্যমান সমস্যা....এ সংকটের সমাধান কোন পথে বলে আপনি মনে করেন?
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরীখে চিন্তা করলে- আমি বলব যে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং আমাদের নিরাপত্তাবাহিনীর প্রধানদের মিয়ানমারে যেতে হবে এবং সরাসরি তাদের সামরিক বাহিনীর সাথে বসতে হবে। তাদের সাথে সরাসরি কথা বলে একথা জানাতে হবে যে- বাংলাদেশের ওপর রোহিঙ্গা বোঝা চাপিয়ে দেয়া পুরোপুরি বন্ধুত্বের সম্পর্কের বিপরীতধর্মী কাজ।
মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বের যদি বোধোদয় না হয় তাহলে এর সমাধান সহজে সম্ভব নয়। মিয়ানমারকে একথা বলতে হবে যে সীমান্তে মিয়ানমার পুলিশ ক্যাম্পগুলো যে আক্রান্ত হয়েছে আমরা তার নিন্দা জানাই এবং এর সমালোচনা করি। তবে আমাদের সীমান্তে যেন কোনো অবস্থাতেই মিয়ানমার তার দেশের লোকদের ঠেলে না দেয়। এই প্রক্রিয়াটা যদি আমরা শুরু করতে পারি তাহলে অন্তত খানিকটা হলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের পরিমাণ কমবে। সরসরি কথা বলা ছাড়া মিয়ানমারের সামরিকবাহিনীর আচরণগত দিকের পরিবর্তন ঘটানো অসম্ভব।
তাছাড়া মিয়ানমারের সাথে সুসম্পর্ক রাখা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্যও অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা চীনের মাধ্যমে মিয়ানমারের সহযোগিতা ছাড়া গভীর সমুদ্রে বাণিজ্য অসম্ভব। পদ্মা সেতুর জন্য যে পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে তা আসে মিয়ানমার থেকে। নাফ নদীতে মাছ ধরার মাধ্যমে আমাদের মানুষেরা কোটি কোটি টাকা আয় করে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গার চেয়েও আরো বিশাল আমাদের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। ফলে যেকোনো মূল্যে মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সামরিক নেতৃত্বকে সামনে রেখে অবিলম্বে বসা উচিত। প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমারে যাওয়া উচিত। কিন্তু সেরকম কোনো পদক্ষেপই আমরা নিচ্ছি না। আমরা শুধু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আচরণের জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু সেটা তো একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সেটার জন্যে অপেক্ষা করতে গেলে যে বড় ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে যাবে। রোহিঙ্গা মুসলমান নিধন বন্ধ করতে হলে অবিলম্বে মিয়ানমারে আমাদের দূত পাঠানো উচিত। এটাই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা।
আরআর