সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
চিকিৎসকরা বছরে দুইবারের বেশি বিদেশ যেতে পারবেন না ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে খুলনায় গেলো পরীক্ষামূলক ট্রেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা: প্রেস উইং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের

নিরাশ্রয় এই মানুষগুলোকে সাময়িক আশ্রয় দিন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

Rohingaমিয়ানমারে 'অহিংস' নামধারী বৌদ্ধসন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এই যে এত নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে, নির্বিচারে তাদের হত্যা করছে, ঘর-বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, লুণ্ঠন করছে মুসলিম নারীদের ইজ্জৎ, বিতাড়িত করছে তাদের ভিটেমাটি থেকে। তার কি কোনো প্রতিকার নেই?

অবুঝ শিশুগুলোর নিষ্পাপ চেহারার মায়াবী চাহনিতে কারো মনে কি সামান্য করুনারও উদ্রেক হয় না? কেঁদে কি ওঠে না কারো অন্তর? কোথায় হে বিশ্ব মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দগণ, মজলুম এই মানুষগুলোর অার্তনাদ কি অাপনারা শুনতে পাচ্ছেন? এখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতিটি দিন কাটছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। রাতগুলোতে নামছে আতঙ্কের অন্ধকার। মজলুম রোহিঙ্গাদের ক্রন্দনে অাজ ভারি হয়ে ওঠেছে মিয়ানমারের আকাশ। নদীগুলো রূপান্তরিত হয়েছে লালে লাল দরিয়ায়। দীর্ঘকাল যাবত এই মানুষগুলো বৌদ্ধদের সৃষ্ট নরকে জ্বলছে।

মিয়ানমার সরকার তথাকথিত 'জাতিশুদ্ধি অভিযান' নামে নিরপরাধ মুসলমানদের ওপর এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে অাসছে। সম্প্রতি তাদের সেই অমানুষিক নির্যাতনের মাত্রা এতটাই নির্মম হয়েছে, যার নিন্দা জানানোর ভাষা খুঁজতে গেলে অভিধানকেও অক্ষমতা স্বীকার করতে হয়। মিয়ানমার সরকার তাঁদের সে দেশের নাগরিক বলে অস্বীকার করছে।

কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান (বর্তমানে রাখাইন) তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানেরই বংশধর। কথিত আছে, ৭৮৮-৮১০ খ্রিস্টাব্দে কয়েকটি বাণিজ্য বহর রামব্রী দ্বীপের তীরে এসে এক সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। জাহাজের আরবীয় মুসলমানেরা ভাসতে ভাসতে কূলে পৌঁছে বলে 'আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি।' সেই ‘রহম’ থেকেই তাদেরকে রোহিঙ্গা নামে অভিহিত করা হয় বলে ধারণা করা হয়। ইতিহাস বলে, ১৪৩০ সালে আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এ সময়ে প্রায় প্রত্যেক রাজাই মুসলমানদের অাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নিজেদের বৌদ্ধ নামের সাথে একটি মুসলিম নাম ব্যবহার করেছেন। ফারসীকে সরকারি ভাষা হিসেবে চালু করেছেন। মুসলমানদের অনুকরণে মুদ্রা প্রথার প্রবর্তন করা হয়। মুদ্রার একপিঠে রাজার মুসলিম নাম ও অভিষেক কাল এবং অপরপিঠে মুসলমানদের কালিমা শরীফ আরবী হরফে লেখা হতো।

১৬৩৫ সালে আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আর এই দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়েই আরাকানে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। উত্থান হয় রাজা থান্দথুধম্মার। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপরই শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন।

হায় আফসোস! এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই নিজভূমে পরবাসী। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এইযে এত নিপীড়ন, লোমহর্ষক নির্যাতন তা দেখার যেন আজ কেউ নেই। নেই প্রতিবাদ করার মতো কোনো রাষ্ট্র কিম্বা সংস্থা। নেই নামধারী মানবাধিকার কর্মীদের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি, নিরব অবস্থানে রয়েছে বিশ্বমিডিয়া, খোদ জাতিসংঘ। ঘুমে বিভোর আরব,ইরান পাকিস্তান,তুরস্ক বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেড়শত কোটি মুসলমানও।

অথচ হাদিসে এসেছে, 'মুসলিমগণ সকলে মিলে যেন একটি মানুষ, যার চোখে ব্যাথা হলে গোটা দেহ অস্থির হয়, মাথায় ব্যাথা হলেও গোটা দেহ অস্থির হয়।' ( সহীহ মুসলিম হাদীস : ২৫৮৬)

আমাদের দেখলে কেইবা বলবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এহেন নিপীড়নে আমাদের পরাণ জ্বলছে, আঁখিকোণ ভিজেছে তপ্তজলে। তাদের উদ্ধারে আমরা মরিয়া। দুর্ভাগ্যের বিষয়তো এইইযে, বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন 'ওআইসি'ও আজ দায়সারা ভূমিকা পালন করছে। রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, এপর্যন্ত মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটা কার্যকরী পদক্ষেপও নেইনি এ সংগঠনটি। অপর দিকে মোড়লগিরি করে বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ায় যেসব দেশ, যারা শান্তির পক্ষে দামি দামি কথা বলে, বহু টাকা পয়সা ব্যয় করে শান্তিতে নোবেল দেয় অশান্তির প্রতীক অং সান সুচিদের, তাদের চোখে পড়ে না রোহিঙ্গাদের বিভৎস লাশ, ঘর-বাড়ি হারা অসহায়দের ক্রন্দনধ্বনি। কর্ণকুহরে পৌঁছে না আগুনে দগ্ধ হওয়া অবুঝ শিশুর 'বাঁচাও' 'বাঁচাও' চিৎকার। এর কারণ একটাই, আর তা হচ্ছে রোহিঙ্গারা মুসলমান। এটাই যেন তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। অার সেই অপরাধের জন্যই রোহিঙ্গা অাজ মরুক, পচুক তাতে কারো কিচ্ছু যায় আসে না। নতুবা কোথায় অাজ বিশ্বমিডিয়া? নীরব কেন আজ মানবাধিকার সংস্থা? নিশ্চুপ কেন জাতিসংঘ?

গত দুই দশকে জাতিসংঘের অসার ভুমিকা দেখে মনে হচ্ছে এটা কোনো মানবতার পক্ষে নয়, বরং এটা শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একটা বিশেষ হাতিয়ার।তাইতো সবায় মিলে যেন আজ মুসলিম নিধনে এক হয়েছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও অং সান সুচি’র মধ্যে এত তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ থাকা স্বত্বেও মুসলমান নিধনে তারা কি করে একাট্টা হয়! তাদের কথা বাদই দিলাম আমরাইবা কোন পদক্ষেপ নিচ্ছি? বৌদ্ধদের শত নির্যাতন, নিপীড়নে দগ্ধ হয়ে অসহায় এই মানুষগুলো যখন তাদের সব কিছু ফেলে জীবন বাজী রেখে আমাদের দ্বারস্থ হচ্ছে, তখন আমরা তাদেরকে কতটাই না নির্লিপ্তভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছি!

নবীজি বলেছেন, 'এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই।' সেই বিশ্বাসেই তারা আমাদের কাছে ছুটে আসে একটু আশ্রয়ের জন্য, জীবনের নিরাপত্তার জন্য, বৌদ্ধদের তাণ্ডবলীলা থেকে মুক্তির জন্য। আর আমরা তাদেরকে আশ্রয়ের পরিবর্তে ঠেলে দিচ্ছি সেই নরকেই। অথচ মহানবী সা. ইরশাদ করেছেন, 'কোনো মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে এমন স্থানে যদি সাহায্যকারী ও বন্ধুহীন ছেড়ে দেয় যেখানে তার অসম্মান হচ্ছে, তার ইজ্জত-সম্মানের ওপর হামলা-আক্রমণ হচ্ছে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন স্থানে বন্ধুহীন সাহায্যকারী ছাড়া ছেড়ে দেবেন, যেখানে সে নিজের জন্য সাহায্যকারীর প্রত্যাশী হয়।' (জামউল ফাওয়ায়িদ : খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা- ৫৫)

হ্যাঁ এ কথা সত্য যে এমনিতেই বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখনো একটি পশ্চাদপদ দেশের নাগরিক। যৌক্তিক কারণেই আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। তাই যুক্তির খাতিরে এ কথা বলাই স্বাভাবিক যে, 'ঘাড়ের উপরে আমরা অন্যদের বোঝা নেব কেন?' কিন্তু মানবতা বলেওতো একটা কথা আছে। নির্যাতিত এই মানুষগুলোকে দীর্ঘমেয়াদিভাবে আশ্রয় নাইবা দিলাম, অন্তত কিছু দিনের জন্যতো তাদের আশ্রয় দিতে পারি। প্রয়োজনে না হয় আমরা তাদের জন্য কিছুদিন কষ্ট করলাম। আমাদের কিছু অারাম অায়েশকে তাদের জন্য কোরবানি করলাম। মানুষতো মানুষেরই জন্য। এতে করে হয়তো তাদের জীবনটা রক্ষা পাবে। রক্ষা পাবে কিছু রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ। এটাইতো মানবতা। ইসলামের মহান শিক্ষা। রাসূল সা. বলেছেন, 'যখন তুমি তরকারী রান্না করবে তাতে বেশি করে পানি দেবে। অতঃপর তোমার প্রতিবেশীর খবর নিয়ে তার থেকে তাদেরকে কিছু দেবে। (মুসলিম : ৪৭৫৯)

মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গা মুসলমানরা এক দিকে যেমন আমাদের প্রতিবেশী, তেমনি অপর দিকে তাদের সাথে আমাদের রয়েছে ঈমানী সম্পর্ক। আত্মিক বন্ধন। যা মুমিন হওয়ার জন্য অন্যতম শর্তস্বরূপ। তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। নবীজি বলেন, 'আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম সে মুমিন নয়, বলা হল কে সে হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তি যার কষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।' (বোখারি : ৫৫৫৭)

তাই মাননীয় সরকারের নিকট বিনীত অনুরোধ, রোহিঙ্গা মুসলমানদের এই বিপদসংকুল মুহুর্তে তাদের কথা একটু ভেবে দেখুন। অন্তত মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অাগ পর্যন্ত তাদের জন্য সাময়িকভাবে হলেও একটু আশ্রয় দিন। ভাসমান এই মানুষগুলোর মৃত্যু মানে কিন্তু আমাদের মানবতারই মৃত্যু। সারা দুনিয়ায় আমাদের উদার মানবতার যেই উজ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে তার প্রমাণস্বরূপ নিরাশ্রয় এই মানুষগুলোকে সাময়িক আশ্রয় দিন। একই সাথে মিয়ানমারের এই সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘকে চাপ প্রয়োগ করুন।

প্রয়োজনে বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলুন। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে, 'মুসল মুসলমানের ভাই' হিসেবে এটাই হবে আমাদের জন্য সামাজিক, নৈতিক ও ঈমানী চেতনার বহিঃপ্রকাশ।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, 'হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো, তোমরা কেন আল্লার রাস্তায় অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়াই করছ না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হয়ে ফরিয়াদ করে বলছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালিম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোনো বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাঠাও। (সুরা নিসা: অায়াত,৭৫)

লেখক : ইমাম ও খতিব, আদ্রা জামে মসজিদ, কসবা, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া।
[email protected].


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ