মুসা আল হাফিজ
কবি ও কলামিস্ট
১৯৬২ সালে ক্ষমতায় এসে জেনারেল নেউইন রোহিঙ্গাদের মেরুদণ্ড গুড়িয়ে দেন। ১৯৭০ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে কেড়ে নেয়া হয় ভোটাধিকার। ১৯৮২ এর নাগরিকত্ব ও সাংবিধানিক অধিকার। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য বিষয়েও আরোপ করা হয় নিপীড়নমূলক বিধি নিষেধ।
শিক্ষা চিকিৎসা ব্যবসা বাণিজ্যের স্বাধীনতাসহ প্রতিটা ক্ষেতে তরা প্রচণ্ড কড়াকড়ি ও বৈষম্যের শিকার। হত্যা, ধর্ষণ তো একেবারে প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে উঠে। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেয় হয়। নানা অজুহাতে তাদের উপর ট্যাক্সের বোঝা এতই চাপানো হয় যে, রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড গুড়িয়ে যায়। তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষেত খামার দখল করে নেয় মগ সন্ত্রাসীরা। রাস্তা ঘাট অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদিতে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়।
২০০১ সাল থেকে আরাকানের আকিয়াব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পড়ার সুযোগ সীমিত করা হয়। ফলে থেমে গেছে তাদের উচ্চশিক্ষা। চিকিসা কিংবা শিক্ষার জন্য তারা কোথাও সফর করতে পারবে না। তাদের বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে এজন্য বিধি নিষেধের শেষ নেই। ধর্মীয় স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই রোহিঙ্গাদের। ইতোমধ্যে তাদের বহু মসজিদ পরিণত হয়ে গোডাউনে। নতুন মসজিদ নির্মাণ বন্ধ। আযান দিতে দেয়া হয় না। নামাজ আদায়ের উপরও চলতে থাকে কড়াকড়ি। মাদরাসা তৈরি করলেই জ্বালিয়ে দেয়া হয়। শিক্ষিত বা ধনাঢ্য ব্যক্তি কিংবা কুমারী নারী সর্বক্ষণ থাকেন অপহরণের আতঙ্কে। কারো কোনো বিন্দু পরিমাণ নিরাপত্তা ও অধিকার নেই। তাদের সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তাকে কেড়ে নেয়ার জন্য তৈরি আছে মগ সন্ত্রাসী, লুটেরা বাহিনী ও নাসাকা বর্বরতা।
২০ হাজার বর্গমাইল অধ্যুষিত আরাকান উত্তর পশ্চিমে ১৭১ মাইলব্যাপী বাংলাদেশ দ্বারা বেষ্টিত। এখানকার ৪০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ২০ লাখ মগবৌদ্ধ, ১৪ লাখ রোহিঙ্গা, ৪ লাখ সর্বপ্রবণবাদী এবং ২ লাখ রয়েছে হিন্দু-খৃষ্টান। হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে ১৪ লাখ মানুষ যেখানে বসবাস করছে, সেখান থেকে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার কর্মসূচি হাতে নেয় উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। এই অসম্ভব কাজটি না করলে যেন তাদের চলছে না।
কালাদান নদীর পানিস্রোতকে তারা রক্তলাল করছে বছরের পর বছর। যেকোনো ছুতোয় তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং হত্যার উৎসবে মেতে উঠছে।
২০১২ সালে রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরু হয় নতুন করে। খুবই তুচ্ছ ব্যাপার থেকে এর সূচনা। কে বা কারা ধর্ষণ করেছিলো এক রাখাইন নারীকে। মগ সন্ত্রাসীরা এজন্য দায়ি করলো রোহিঙ্গাদের। দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত কয়েকজন মোবাল্লিগকে তারা যাত্রীবাহী বাস থেকে নামিয়ে জবাই করে হত্যা করলো। রোহিঙ্গারা এর প্রতিবাদে মুংডু জেলায় জুমাবারে মিছিল বের করে। শুরু হয় রাখাইনদের ইট-পাথর ও গুলিবর্ষণ। শুরু হয় নিরাপত্তাবাহিনীর অত্যাচার। ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গা। নাসাকাদের বুলেটে শহীদ হন অসংখ্য রোহিঙ্গা। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের নাম করে জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। রাখাইনরা সংঘবদ্ধ হয়ে জরুরি অবস্থার মধ্যেও গণহত্যা অব্যাহত রাখে। মগ সন্ত্রাসীরা ঘরে ঘরে গিয়ে আগুন লাগাতে শুরু করে। তারা হত্যা করে অসংখ্য পুরুষ, নারীদের করে ধর্ষণ, যুবতী ও শিশুদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে উধাও করে দেয়। শুধু মংডু জেলা থেকে নিখোঁজ হন পাঁচ হাজারেরও অধিক তরুণী। তাদের ভাগ্যে কী ঘটলো সে খবর কেউ জানতে পারেনি।
আরআর