হাওলাদার জহিরুল ইসলাম
দেওবন্দ থেকে
এক পরিচিত দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে- ‘ভাই! কুছ সামান চাহিয়ে৷ লেকিন পায়সে খুল্লে নেহি হ্যায়৷ বা'দ মে লেনা পড়ে গা৷’
‘মাফ করিয়ে ভাইয়া! এয়সা করনা মুমকিন নেহি৷ বহুত সারে আদমি কো বাকি দে রাক্ষা৷ আওর নেহি দোঙ্গা৷ হাম ভী বহুত পেরেশান হে৷’
চলে এলাম অন্য দোকানে৷ সেখানেও একই জবাব মিললো৷ কেউ বাকি দিতে রাজি নয়৷ অথচ এরা অন্য সময় হাজার রুপির বাকি দিতে দ্বিধাবোধ করতো না৷ ভাবতে পারেন বাকি নেয়ার কী প্রয়োজন৷ নগদ টাকা দিয়ে নিলেই পারেন৷ হু, ভাই আমার পকেটে একটি নয় পাঁচটি পাঁচ শ রুপির নোট পড়ে আছে৷ এগুলো তারা নেবেন না৷ রুপিগুলো জাল? নাহ, একটিও জাল নোট নয়৷ তবে…
খুচরো রুপি যা ছিলো দু'দিনেই শেষ৷ নাশতা করা তো দূরে থাক কাপড় পরিষ্কার করার জন্য একটি দশ রুপির সাবান কেনারও হয়নি৷
শুধু আমি একা নই কম বেশি সবাই-ই এ অবস্থার শিকার৷ খুচরো রুপি না থাকায় কতো মানুষ যে অসুখে ভুগছেন তার হিসেব নেই৷ শীতের মওসুম হওয়ায় অনেকে প্রচণ্ড জ্বর-ঠাণ্ডায় ভুগছে৷ কিন্ত পকেট খালি থাকায়…৷
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ‘বিবিসি উর্দু’র হিসেব মতে নোট সংকটে এ পর্যন্ত ৭০জন মৃত্যুবরণ করেছে! তবুও সরকার নির্বিকার৷ রাষ্ট্রনেতারা বারবার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন ক’দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু সেই ‘ক'দিন’ যে কবে শেষ হবে তা আমাদের জানা নেই৷ আশায় ছিলাম দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ছাত্রদের মাসিক ২০০ রুপি করে যে ভাতা দেয়া হয় তা দিয়ে কিছু দিন চলতে পারবো৷ ছাত্ররা মুখিয়ে ছিলো বেতনের জন্য কিন্তু সে আশা নিরাশায় পরিণত হতে সময় লাগলো না৷
দফতরে এহতেমাম থেকে জারি করা, হজরত মুহতামিম সাহেব স্বাক্ষরিত বিশেষ নোটিশ দেখে চোখ কপালে উঠলো সবার৷ নোটিশের ভাষ্য এমন- ‘মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বহু চেষ্টার পরও ব্যাংক থেকে পুরাতন রুপিগুলো পরিবর্তন করে আনতে পারেনি৷ তাই সকল শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ একাউন্ট নম্বর (ব্যক্তিগত তথ্যসহ) মাদরাসার প্রশাসনিক দফতরে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো৷ এখন থেকে মাসিক ভাতা প্রত্যেকের একাউন্টে পাঠিয়ে দেয়া হবে৷ খুচরো রুপি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না৷’
একে তো একাউন্ট নম্বর নেই৷ আর থাকলেই বা কী লাভ? দারুল উলুম সংলগ্ন তিনটি এটিএম বুথের দুটিই বন্ধ পড়ে আছে৷ একটি গতকাল থেকে প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য চালু করা হয়েছে৷ সেখানে যে লম্বা সিরিয়াল তাতে টাকা উঠানো প্রায় অসম্ভব৷ অপর দিকে এটিএম'র রুপি মুহূর্তেই ফুরিয়ে যাচ্ছে৷ ছাত্ররা ভোর রাত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও টাকা পাচ্ছে না৷ শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত, বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে হোস্টেলে৷ উস্তাগণও বেশ পেরেশান৷ তাদের বেতনও হাতে হাতে দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ ৷ যার যার একাউন্টে পাঠানো হবে মাসিক বেতন৷ পরে সেখান থেকে উঠিয়ে নেয়া যাবে৷
দেওন্দের প্রতিটা ব্যাংক ও এটিএম বুথে এখন উপচে পড়া ভিড়৷ মানুষ-জন কাজ কর্ম ফেলে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা৷ তাও সিরিয়াল দিতে হয় ভোর রাতে৷ ভাগ্য ভালো হলে তো (১ দিনে ৪ হাজার) রুপি মিলবে৷ অন্যথায় বাসায় ফিরতে হবে খালি হাতেই৷ দেওবন্দের উস্তাদগণ এতো সময় কোথায় পাবেন? তাদের পক্ষে কি দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব!? অপর দিকে দারুল উলুমের হিসাব বিভাগের দায়িত্বশীলগণ হিমশিম খাচ্ছেন বোর্ডিং খরচ চালাতে৷
সূত্র মতে, দারুল উলুমের বোর্ডিংয়ে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ রুপি ব্যয় হয়৷ বর্তমানে সরকারি ব্যাংক থেকে দারুল উলুমকে প্রতিদিন (নোট পরিবর্তন করে) দেয়া হয় মাত্র ৪০ হাজার রুপি! বাকিটা ভিন্ন কোনো পদ্ধতিতে ম্যানেজ করতে হয়৷ নিরুপায় হয়ে চলমান নির্মাণ কাজগুলোও স্থগিত রাখা হয়েছে৷
দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষার্থীদের মাঝে নেই আগের মতো সেই চঞ্চলতা৷ সব যেনো স্থবির হয়ে পড়েছে৷ আগে নাশতা করতে গেলে ৫০রুপি খরচ করতাম নির্দ্বিধায় এখন ৫ রুপি খরচ করার আগে একবার ভেবে নিতে হয় পকেটে কিছুটা বাকি আছে তো?
আমার মতো যেসব শিক্ষার্থী বোর্ডিংয়ের খাবারের পরিবর্তে নিজেরা রান্না করে খেতো নিয়মিত এখন তাদের চুলোয় আগুন জলে না৷ পলিথিনভর্তি কাচা সবজি নিয়ে ফেরে না কামরায়৷ একেবারে কাছের বন্ধুটিও এক বেলা তার সঙ্গে খেতে বলে না এখন৷ সবাই চরম বিপাকে৷ সবাই পরিস্থিতির শিকার৷ সরকারে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক৷ জনগণের কষ্ট লাঘবে সরকার খুলে দিক বিকল্প কোনো পথ৷ সবার মুখে হাসি ফুটুক৷ ফিরে আসুক সবার মাঝে ঐকান্তিক সুখ, অনাবিল আনন্দ৷ এটাই চরম প্রত্যাশা৷
আরআর
http://ourislam24.com/2016/11/21/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%87-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AD%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4/