মুসা আল হাফিজ
কবি ও কলামিস্ট
(১ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন) ধীরে ধীরে স্থানীয়রা গ্রহণ করেছে ইসলাম। ত্রয়োদশ শতকে এসে গোটা অঞ্চলটাই হয়ে ওঠেছে মুসলিম জনপদ। ইবনে বতুতা যখন আরাকানে এলেন, তখন সেখানে সমৃদ্ধি আর সম্প্রীতির সুবাতাস বইছে। তিনি সেখানে বহু সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার ও এলাকার সাক্ষাৎ পান। মুসলিমদের নৈকট্যে বৌদ্ধরা ছিলো সুখি ও নিরাপদ। ফলে অারাকানের ম্রাইক-উ রাজ বংশের শাসনামলে মুসলমানদের হাতে আসে অনেক। ক্ষমতাভ চন্দ্র ও সূর্য বংশের রাজা অসুথুর পুত্র নরমিলখলা যখন রাজা, তখন প্রভাবশালী নরমিখলা ক্ষমতা হারালে গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন। নরমিখলাকে অতিথি করে গৌড়ে রাখেন ২৪বছর। ৫০হাজার সৈন্য দিয়ে দুই দফায় তাকে সাহায্য করেন। এই সৈন্যরা যুদ্ধ করে নরমিখলাকে পুণরায় ক্ষমতায় বসায়। এতে মুগ্ধ হয়ে রাজা নিজের বৌদ্ধ নাম পরিহার করে গ্রহণ করেন মুসলিম নাম- সোলাইমান শাহ।
এর পরে আরো অনেক আরাকান রাজা বৌদ্ধ হয়েও মুসলমানি নাম গ্রহণ করেছেন। এখানে শতাব্দির পর শতাব্দি মুসলমানরা সমাজ-রাষ্ট্র ও সংস্কৃতিতে অনস্বীকার্য প্রভাব রেখে আসছেন। বিচার ব্যবস্থায় বারাবরই ছিলো মুসলমানদের কর্তৃত্ব। প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, প্রধানকাজী ইত্যাদি পদ মুসলমানদের জন্য ছিলো নিশ্চিত। ১৪৩০ সালে আরাকানে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম রাজ্য। ২০০ বছরেরও বেশি সময় সেটা স্থায়ী ছিলো। ১৬৩১ থেকে ১৬৩৫ পর্যন্ত স্থায়ী এক দুর্ভিক্ষ আরাকান কে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। পরে অবসান হয় মুসলিম শাসনের।
১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দ থু ধম্মা নিজ রাজ্যে অাশ্রিত সুজাকে হত্যা করে। সে ধীর ধীরে অত্যাচারী হয়ে ওঠে। তার শাসনামলে মুসলমানদের উপর দুর্ভোগ বয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও সতের শতকের আটের দশক পর্যন্ত রোহিঙ্গা রাজ্যে মুসলিম বৌদ্ধ মিলে মিশে শান্তি পরিবার হিসেবে স্বাধীনতা ভোগ করছিলো। এর উপর আঘাত আসে মিয়ানমারের বৌদ্ধ রাজা বোদাওফার পক্ষ থেকে। ১৭৮৫ সালে তিনি আক্রমন করে রাজ্যটি দখল করে নেন। তার ত্রিশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী দেশব্যাপী ধ্বংসের উৎসবে মেতে উঠে। মসজিদসমূহ ধ্বংস করে। কাঁচা-পাকা ঘরসমূহ মাটির সাথে মিশিয়ে পুড়িয় হত্যা করা হয় অসংখ্য রোহিঙ্গাকে। বোদাওফা বাহিনীর আক্রমণে মারা যায় অধিকাংশ বয়স্ক রোহিঙ্গা। সাজানো জনপদগুলো বধ্যভূমি পরিণত হয়। ফসলের ক্ষেত, সুবিশাল বাগিচা, নজরকাড়া স্থাপনা, সুরম্য বাসভবন সমস্তই দুঃস্বপ্নের আগুনে ছাই হয়ে যায়। এই ধ্বংসযজ্ঞে যারা মারা গেলো তাদের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করতো পরবর্তীতে জীবিত রোহিঙ্গারা। কারণ দুই লক্ষ জীবিত রোহিঙ্গাকে বৌদ্ধরা দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলে। তাদের জীবনকে করে তোলে অসহনীয়, অগ্নিময়। সর্বক্ষণ এই মানুষগুলো ছিলেন অমানবিকতায়। তাদের উপর দূরাবস্থার ঝড় বইছে।
এমতাবস্থায় ১৮২৫ সালে রোসাঙ্গ রাজ্যে হানা দিলো ব্রিটিশরা। রোহিঙ্গারা তখন বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে যাননি। ফলে বৃটিশরাও তাদের উত্যক্ত করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারা বৃটিশদের অনুগত হয়ে ভূমিকা পালন করে। অপরদিকে মগ বৌদ্ধরা স্বধর্মীয় জাপানিদের পক্ষ নেয়। যুদ্ধে জাপান হারলো। রাখাইন মগরা এ জন্যে দুঃখিত ছিলো। তারা সমস্ত দুঃখ ও আক্রোশ মেটাতে চাইলো রোহিঙ্গাদের উপর। ১৯৪২ সালে চালালো ভয়াবহ নৃশংস গণহত্যা। শিশু নারী বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি মগদের নির্মমতা থেকে। সুস্থ-অসুস্থ সবাইকে তারা হত্যা করলো নির্বিচারে। পঞ্চাশ হাজার রোহিঙ্গাকে মেরে ফেলা হলো। বিলুপ্ত হয়ে গেলো ৩০৭ টি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রাম। জনপদের পর জনপদ পরিণত হলো পড়ো ভূমিতে। কালাদান নদীর পূর্ব তীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকা সমূহে মুসলমানদের খোঁজ খবর নেয়ার মত জীবিত পুরুষ বিদ্যমান ছিলো না।
এমন পরিস্থিতিতে বৃটিশরাও তাদের প্রতি সুবিচার করলো না। তারা রোহিঙ্গাদের সাথে করলো চরম বিশ্বসঘাতকতা। তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতি গোষ্টির তালিকা তৈরি করে। সেখানে রোহিঙ্গাদের নামও রাখেনি। সেই থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের নিজদেশে পরবাসী হওয়ার দাস্তান। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন মিয়ানমার ছেড়ে চলে গেলে রোহিঙ্গাদের জন্য নেমে আসে কালোরাত। স্বাধীন বার্মায় রোহিঙ্গারা বসবাস করেন উদ্বাস্তুর মত । তাদের নিষিদ্ধ করা হয় সেনাবাহিনীতে। পুলিশেও তাদের পথ হয় রুদ্ধ। সরকারি চাকরির দরজাও বন্ধ করে দেয়া হয়।
আরআর