সৈয়দ মবনু
কবি ও কলামিস্ট
বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার ১৮নভেম্বর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে জানি ছোটবেলা থেকে। তিনি সিলেট সফরকালে আমাদের বাসায় বেশ ক’বার এসেছেন। আমার বাবা আলহাজ্ব সৈয়দ আতাউর রহমানের সাথে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো।
সিলেট শহরের বালুচরে জামিআ সিদ্দিকিয়া প্রতিষ্ঠার পর তাঁকে একবার দাওয়াত করে নিয়ে এসেছিলাম। কথা হয় জামিআ সিদ্দিকিয়া বিষয়ক চিন্তা সম্পর্কে। অতঃপর আমি বেশ ক’বার গিয়েছি বেফাকের অফিসে। মূলত ইচ্ছে ছিলো বেফাক বোর্ডের সাথে মিলিয়ে জামিআ সিদ্দিকিয়ার সিলেবাস তৈরি করা।
আলোচনার একটি পর্যায়ে তিনি স্বীকার করে নিলেন, আমাদের চিন্তার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত অভিন্নতা থাকলেও বিভিন্ন কারণে তিনি ভিন্ন থাকতে বাধ্য। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কতটুকু মোকাবেলার মধ্যদিয়ে বেফাকের সেলেবাসে ইংরেজি, বাংলা এবং অংককে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যসূচী করতে পেরেছেন। তাঁর মতে, মাদরাসাগুলো থেকে উর্দুর প্রভাব হ্রাস করতে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমার সাথে তাঁর অনেক বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। আমি প্রস্তাব করলাম, বেফাকের জন্য পৃথক বাংলা, ইংরেজি, অংকের বই না করে সরকারী মাদরাসার জন্য তৈরিকৃত বই ব্যবহার করলে ভালো হয় এবং ছাত্ররা বেশি উপকৃত হবে। বিশেষ করে প্রাইমারী পর্যায়ে। কারণ, সরকার একটি বই তৈরিতে যে শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে, তা বেফাকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে প্রাইমারী পর্যায়ের বই তৈরিতে শিশুর চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে ধারণা থাকা খুবই জরুরী। এই ধারণা অর্জনের জন্য সরকারকারি লোকেরা দেশ-বিদেশে অনেক প্রশিক্ষনে যোগ দিয়ে থাকেন। যা বেফাকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আমি তৎকালিন বেফাকের ইংরেজি দেখিয়ে বললাম, এগুলো শিশু উপযোগি নয়। তিনি খুব সরলভাবে স্বীকার করলেন তাঁর অপারগতার কথা। তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুমি একা একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করছো। ফলে যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু আমি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করছি, উর্দুকে হ্রাস করতে গেলে তারা আমাকে বলেন, আমি নাকি সরকারি মাদরাসার মতো সব করে নিচ্ছি। আমি উর্দু থেকে বাংলাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি দেখে হাটাজারি-মেখলসহ বাংলাদেশের অনেক মাদরাসার কর্তৃপক্ষ আমার উপর খুব নারাজ হলেন। এখন যদি এখানে সরকারি মাদরাসা বোর্ডের বাংলা, ইংরেজি, অংক নিয়ে আসি তবে তো আর কথা নেই। তারা আমার উপর খুব রেগে যাবেন। বেফাক থেকে বেরিয়েও যেতে পারেন। আপনারা জানেন না, আজকে যে কওমী মাদরাসাগুলো বেফাকের অধিনে রয়েছে ওদেরকে ধরে রাখতে আমার অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। ওরা অনেকে মনে করেন আমি কিছু বুঝি না। তারা সবই বুঝেন। তাদের কাছে অনেক ছোট হয়েও আমি ঐক্য ধরে রাখতে চেষ্টা করেছি। আমি নিজে অনেক কিছু বুঝেও অবুঝের মতো চলছি শুধু ঐক্যের জন্য। বেফাকের নিজস্ব তেমন তাহবিল নেই। জায়গা খরিদ করা হয়েছে কিন্তু বিল্ডিং তৈরি করতে পারছি না। ষ্টাফকে সঠিক বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার-এর সাথে এ কথাগুলো হয়েছে ২০০৫খ্রিস্টাব্দে। জামিআ সিদ্দিকিয়ার জন্ম ২০০২ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ আমাদের যাত্রার তিন বছর পর। জামিআ সিদ্দিকিয়ার যাত্রা যখন হয় তখন চারদিকে সবাই পশ্চিমা হাওয়ায় দেহ ভাসিয়ে ইসলামের সাথে আধুনিকতার সমন্বয়ের একটা চেষ্টা করছিলেন। আকিদার দিকে বিষয়টি খুবই মারাত্মক। ইসলাম একটি আদর্শ আর যদি আধুনিকতা আরেকটি আদর্শ হয় তবে এই সমন্বয়ের অধিকার কে কাকে দিলো? নবী রাসুল ছাড়া কি অন্য কারো কাছে ওহি আসে? হযরত মুহাম্মদ সা. আখেরি নবী ও রাসুল, তাঁর পরে আর কেউ আসবেন না, তা হলে এখন আবার কার ওহিতে এই সমন্বয়? মির্জা কাদিয়ানি যদি ভণ্ড হয় তবে অবশ্যই যারা এমন সমন্বয় করে তারাও ভণ্ড। আর আধুনিকতা যদি বর্তমান কিংবা প্রগতি বুঝায় তবে ইসলাম থেকে বর্তমান কিংবা প্রগতি আর কে বেশি হতে পারে, এখানে সমন্বয়ের কি প্রয়োজন? এই চিন্তাগুলো থেকে জামিআ সিদ্দিকিয়া ঘোষণা করলো, ইসলাম ও জাতীয় শিক্ষার সমন্বয়ে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। এথেকে স্পষ্ট হয়, আমাদের জাতীয় শিক্ষা ইসলামিক নয়, তাই এর সাথে ইসলামকে সমন্বয় করা হচ্ছে। আমরা অনেকটা কওমী মাদরাসা রেখেই জাতীয় সেলেবাস নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি।
যদি বেফাকের সেলেবাসে একটু পরিবর্তন এনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো তবে আমাদের ইচ্ছে ছিলো বেফাকের অধিনে পূর্ণাঙ্গ জামিআ সিদ্দিকিয়াকে নিয়ে যাওয়ার। বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার-এর সাথে সেদিন কিংবা পরে আলাপ করে শেষ পর্যন্ত মনে হলো, আমাদের পক্ষে বেফাকের সাথে চলা সম্ভব হবে না। আমরা কওমী মাদরাসা রেখেও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চিন্তা-চেতনায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। বেফাকের পক্ষে সেদিকে যাওয়া সম্ভব নয় যদি লোকে কিছু বলে, সেই ভয়ে। আমি আর কোনদিন অনুভব করিনি বেফাক মহাসচিবের সাথে কওমী মাদরাসা বিষয়ক আলোচনা করার। তাঁর সাথে এরপরও ক’বার দেখা হয়েছে, কিন্তু পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনা করিনি আর কোনদিন। কারণ কেউ যখন তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকারোক্তি দিয়ে ফেলে তখন আর তাঁকে সেবিষয়ে কষ্ট দেওয়া অনুচিৎ। আর তিনি যদি বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার-এর মতো বুজুর্গ হয়ে থাকেন, তবে অবশ্যই তা বেয়াদবি।
বেফাক-এর পূর্ণাঙ্গ নাম হলো, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাসমূহের সবচে বৃহত্তম বোর্ড। বেফাক ছাড়াও বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা সমূহের ছোট-বড় আরো প্রায় আঠারোটি শিক্ষা বোর্ড আছে। তবে সবগুলো থেকে বেফাকের শিক্ষার রূপরেখা ভিন্ন। বেফাকুল মাদারিস তাদের নিবন্ধিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, উন্নয়ন, বিভিন্ন স্তরভেদে পরীক্ষা গ্রহণ এবং সনদ প্রদানের কাজ করে। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের অধীনে বিশ হাজারেরও বেশি কওমি মাদরাসা রয়েছে।
বেফাকের শিক্ষার রূপরেখা
ক. ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত দ্বীন-বিজ্ঞানসহ ও বাকি ৬ বছর অর্থাৎ মাষ্টার ডিগ্রি পর্যন্ত শুধু ধর্মীয় শিক্ষা।
খ. ধর্মীয় শিক্ষার বিষয় সমূহ : ০১. আরবিভাষা, নহব, সরফ, বালাগাত ও আরুয। ০২. ফিকহ ও উছুলে ফিকাহ। ০৩. তাফসির ও উছলে তাফছির। ০৪. হাদীস ও উছুলে হাদীস। ০৫. তাজবীদ। ০৬. ফারাইয ০৭. ইসলামের রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও সিরাত। ০৮. ইসলামের অর্থনীতি। ০৯. ইসলামের সমাজ বিজ্ঞান ও সিরাত। ১০. ইসলামের দর্শন। ১১. পরিবার বিজ্ঞান।
বৈষয়িক জ্ঞান-বিজ্ঞান সমূহ : ০১. বাংলা এবং বাংলা ব্যকরণ। ০২. ইংরেজি এবং ইংরেজি গ্রামার। ০৩. উর্দূ ও উর্দূ কাওয়ায়েদ। ০৪. ফারসি ও ফারসি কাওয়ায়েদ। ০৫. গনিত ও জ্যামিতি। ০৬. ইতিহাস। ০৭. ভূগোল। ০৮. বিজ্ঞান। ০৯. মানতিক। ১০. মুনাযারা। ১১. পশ্চ্যাত্যের দর্শন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধারণ ধারা হচ্ছে দাওরায়ে হাদিস তথা মাস্টর্স ডিগ্রি পর্যন্ত। তারপর রয়েছে ডিপ্লোমা কোর্স। যেমন : হাদিস, তাফসির, ফিকহ, আরবিভাষা, ইসলামের অর্থনীতি, ইসলামের রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামি রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও মুকারানাতুল আদইয়ান প্রভৃতি।
বেফাকের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা : বেফাক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা ব্যবস্থা তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত, প্রথম পর্যায় এ রয়েছে দু'টি স্তর, ক. প্রাথমিক শিক্ষা । খ. নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা।
প্রথমস্তর-এ প্রথমিক শিক্ষা : কোরআন তিলোওয়াত ও ইসলামিয়াতসহ গনিত, বাংলা, ইংরেজী ও সমাজ বিজ্ঞান প্রভৃতি ৫ম শ্রেনীর মান পর্যন্ত। একে বলা হয় ‘আল মারহালাতুল ইবতিদাইয়্যাহ বা কওমী প্রাইমারি/ প্রাইমারি মাদরাসা।’
দ্বিতীয় স্তর-এ সাধারন শিক্ষা সহ ইসলামিক শিক্ষা : আরবিভাষা, আরবি ব্যকরণ ও ফিকাহশাস্ত্র, গনিত, বাংলা, ইংরেজি এ সমাজ বিজ্ঞান শিক্ষা। একে বলা হয় মারহালাতুল মুতাওয়াসসিতাহ। এর মধ্যে রয়েছে ৩ বছর। অর্থাৎ: ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ৪টি স্তর, ১ম ‘আল - মারহালাতুস সানাবিয়াতুল (মাধ্যমিক স্তর)। এতে রয়েছে দু'বছর (৯ম-১০ম)।
২য় স্তর : আল-মারহালাতুস সানাবিয়াহ্ আল উলইয়া (উচ্চ মাধ্যমিক স্তর): এতে রয়েছে দু'বছর (একাদশ শ্রেনী থেকে দ্বাদশ শ্রেনী)।
৩য় স্তর : মারহালাতুল ফজিলাত (স্নাতক ডিগ্রি)। এতে রয়েছে দু'বছর (১৩শ শ্রেণি থেকে ১৪শ শ্রেনী)।
৪র্থ স্তর:- মারহালাতুল তাকমিল (মাস্টার্স ডিগ্রি)। এতে রয়েছে দু'বছর। এ স্তরকে দাওরায়ে হাদিস বলা হয়।
তৃতীয় পর্যায় : এ পর্যায়ে রয়েছে বিষয় ভিত্তিক ডিপ্লোমা ও গবেষনামূলক শিক্ষাকোর্স। যথা : হাদীস, তাফসির, ফিকহ, ফতওয়া, তাজবিদ, আরবিসাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি, উর্দূ ও ফারসি ভাষা, ইসলামের ইতিহাস ও সীরাত, ইলমুল কালাম, ইসলামি দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্টবিজ্ঞান, পৌর বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান, ইত্যাদি বিষয়ের গবেষণামূলক শিক্ষা।
মাওলানা আব্দুল জব্বার তাঁর ত্যাগ ও নিরলস পরিশ্রমে বেফাক-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে পেরেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানকে গড়তে এবং ধরে রাখতে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সুদূর গ্রামে-গঞ্জে দৌঁড়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিলো, ৭৯ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি সমস্যা, ডায়বেটিকস ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তবু তিনি ছিলেন কর্মব্যস্থ একজন মানুষ। নভেম্বরের প্রথম সাপ্তাহে তাঁকে প্রথমে খিলগাঁওয়ের খিদমাহ হাসপাতালে, পরে ডাক্তারদের পরামর্শে হলি ফ্যামেলি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। ১৮নভেম্বর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার সকাল দশটা দশ মিনিটে তিনি মারা যান।
আমার বাবার সাথে সম্পর্কিত বলে কিংবা একজন মুখলিস মানুষ হিসেবে মাওলানা আব্দুল জাব্বারকে আমি সর্বদাই শ্রদ্ধা করি। আমি এই মানুষটির সাথে যতদিন মিলেছি ততদিন অনুভব করেছি দ্বীনি শিক্ষার প্রসার এবং উন্নয়নে তাঁর হৃদয়ের স্পন্দন। তিনি পরিশ্রমি মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একটি খরস্রোতা নদী। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে যেন নিজের কর্মের পূর্ণাঙ্গ ফল দান করেন।
আরআর