মাওলানা আবু হানিফা
তার নাম আবদুল জব্বার, পিতার নাম শেখ নাসিরুদ্দীন। তিনি ১৯৩৭ সালে বর্তমান খুলনা বিভাগের অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার সহবত কাঠি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পাঁচ ভাই ও এক বোন। দেখতে সুন্দর এই ছোট শিশুটি ছোট বেলা থেকেই ছিল সবার আদরের পাত্র। মেধা ও পরিশ্রমের নিশানটা তার ছোট বেলা থেকেই ছিল। পরিবারের তার সমবয়সী অন্য কাউকে অর্পণ করা একটা দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে যদি সময় লাগতো আধঘণ্টা ছোট্ট আবদুল জব্বার তা করে দিত পনের মিনিটের মধ্যে। বেশ চঞ্চল ও নিরলস ছিলেন তিনি সেই ছোট বেলা থেকে।
ইসলামের প্রথম ডাকটি সত্যিকার অর্থেই বোধয় তিনি পেয়েছিলেন জন্মের পর তার কানে দেয়া আযানের মাধ্যমেই। যেন তখন থেকেই তিনি চিনতে ও বুঝতে পেরেছিলেন আল্লাহ ও তার প্রিয় রসুলকে। অবশ্য গতানুগতিক ভাবে তার পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়েছিল তার পরিবার থেকেই। অ, আ, ও আলিফ, বার শিক্ষা তিনি প্রথমে পরিবারের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন । তারপর গ্রাম্য মকতব পরে বাগেরহাটে বেশকিছু দিন পড়াশুনা করেন। তারপর ঢাকায় এসে তিনি বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষালাভ ও বড়বড় মনিষীদের সান্নিধ্য অর্জন করেন। তিনি দাওরা ফারেগ হন ঢাকার বড় কাটারা মাদরাসা থেকে।
এই মহা মনিষী জীবনে অনেক বড়বড় আলেমদেরকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন। তখনকার সময়ের কালজয়ী অনেক আলেমদের আস্থাভাজনও ছিলেন তিনি। তাদের মধ্যে রয়েছে, ১. প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উম্মাহর জন্য নববী আদর্শের প্রতিচ্ছবি, তৎকালীন খেলাফত মজলিসের আমীর হযরত মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.। ২. হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ এর খলিফা ঢাকার কওমি মাদরাসার জনক হযরত শামছুল হক ফরিদপুরী রহ ৩. শায়খুল হাদীস আল্লামা আযিযুল হক রহ ও ৪. পিরজী হুজুরের মত উস্তাদ ও রাহবার তিনি পেয়েছিলেন।
তার কর্মজীবন ছিল সত্যিই খুব ব্যাপৃত। অবশ্য তিনি কর্মজীবনের এক গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছেন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে। বেফাকের প্রায় শুরুলগ্ন থেকেই তিনি জড়িত বেফাকের সাথে। আর এই বেফাকের অসামান্য জনপ্রিয়তার জন্য তার প্রচেষ্টা ও ত্যাগ কোনভাবেই অস্বীকার করার মত না। বাংলদেশে ছোটবড় প্রায় ১৮ টি কওমি শিক্ষাবোর্ড এর মধ্যে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়াই সবচে বেশি প্রসিদ্ধ। এর অফিসিয়াল কার্যক্রম প্রথমে চলেছে ফরিদাবাদ মাদরাসা তারপর নয়াপল্টন বর্তমানে ডেমরার কাজলা ভাঙ্গাপ্রেসে চলছে। এই সবগুলো দফতরেই তিনি দায়িত্বপালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশে অনেক মাদরাসা ও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন ও আন্দোলনেও তার অসামান্য ভূমিকা আছে। বিশেষভাবে কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিক উন্নয়নে তার প্রচেষ্টা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এই মুখলেস নিরলস কর্মবীর মানুষটির চিন্তাচেতনার প্রায় পুরোটায় বেষ্টিত ছিল কওমি মাদরাসার উন্নতি সাধন নিয়ে। শিক্ষাব্যবস্থা, পরীক্ষার মান উন্নয়ন, সনদ প্রদান, প্রকাশনা উন্নয়ন শিক্ষণীয় বিভিন্ন সেমিনারসহ কওমি মাদরাসা ও বেফাক নিয়ে সর্বত্র ছিল তার উন্নয়ন চিন্তা। বর্তমান সময়ে কওমি মাদরাসার সবচে আলোচিত বিষয় হলো কওমি মাদরাসার সরকারী মান নির্ণয় ইস্যু। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সবখানেই চলছে এর আলোচনা সমালোচনা। এই কওমি সনদের সরকারী স্বীকৃতির প্রথম বাক্যটি বেফাকের প্রথম সভাপতি আল্লামা নূরুদ্দিন গওহরপুরি রহ. এর অনুমতিক্রমে তিনিই উচ্চারণ করেন। এবং সকলের উদ্দেশ্যে এর অবস্থান স্পষ্ট করতে তিনি ”কওমি মাদরাসার সরকারি স্বীকৃতি আমরা কেন চাই” নামে একটি স্বতন্ত্র বই লিখেন। সরকারী দপ্তরে কওমি সনদের জন্য তিনিই সর্বপ্রথম কাগজপত্র জমা দেন সাথে সাথে কওমির অবস্থানটাও সরকারের কাছে স্পষ্ট করে দেন। সুতরাং এ কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায় যে, তিনিই কওমি সনদের স্বীকৃতির পহেলা জনক।
গবেষণা ও লেখালেখিতে তার ছিল প্রচুর দক্ষতা। বিশেষভাবে কওমি সিলেবাসের আধুনিকায়নের প্রায় সকল বই তার সম্পাদনার কাটাছেড়া পেরিয়ে ছাত্রদের হাতে পৌঁছেছে। তার লেখা প্রবন্ধ নিবন্ধ ও কবিতা ছড়া দিয়ে বহু শিক্ষার্থীই পাচ্ছেন পথের দিশা। তার গবেষণাও ছিল খুবই ফলপ্রসূ যা আমরা এখন চোখ বন্ধ করলেও দেখতে পাই। তার গবেষণার ফসল হিসেবে অনেক বই পাঠকের হাতে পৌঁছেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলও, ১. ইসলাম ও আধুনিক প্রযুক্তি ২. মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ৩. ইসলামে নারীর অধিকার ৪. পাশ্চাত্যের অধিকার বঞ্চিত লাঞ্ছিতা নারী। এছাড়াও তার অনেক বই রয়েছে পাঠাকের হাতে।
এই কর্মবীর মানুষটি গতকাল ১৮ নভেম্বর সকাল ১০ টা ১০ মিনিটে ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলে ৭৯ বছর। মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী রহ. বেশ কিছু দিন ধরে কিডনি হার্ট ও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ভুগছিলেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে মারাত্মকভাবে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। এরপর থেকে তিনি ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন। তার মৃত্যুর সংবাদে পরিবার পরিজন, আলেমসমাজসহ সকল ভক্তবৃন্দ ও সাধারণ মানুষের হৃদয়ে শোকের ছায়া নেমে আসে।
এফএফ