রিকু আমির, নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনের সংসদ সদস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাড. ছায়েদুল হকের বিরুদ্ধে উঠা হিন্দুদের উদ্দেশ্য করে ‘মালাউনের বাচ্চা’ উক্তি করেছেন এর পক্ষে সাক্ষ্য পাওয়া গেছে দৈনিক আমাদের অর্থনীতির গভীর ও ব্যাপক অনুসন্ধানে। ছয়জন প্রত্যক্ষদর্শীর (প্রাইমারি সোর্স) মুখ থেকে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের পাওয়া গেছে ৪ জনের কাছ থেকে। এই ৪ জন (সেকেন্ডারি সোর্স) বিভিন্নভাবে ছয় প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে আপত্তিকর কথাটি জানতে পারেন। তবে ওই শব্দ প্রয়োগ সময়কার ছায়েদুল হকের কণ্ঠের কোনো রেকর্ডিং বা ভিডিও পাওয়া যায়নি।
যেভাবে অভিযোগ উঠে এবং অভিযোগ ভিত্তি লাভ করে : নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা রসরাজ দাসের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কাবা শরিফের বিকৃত ছবি পোস্ট কেন্দ্র করে ৩০ অক্টোবর দুপুরে নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের ৫টি পাড়ার হিন্দু বসতঘর ও মন্দিরে তা-ব চালায় দুর্বৃত্তরা। এ খবরের ভিত্তিতে ১ নভেম্বর দিবাগত রাতে মন্ত্রী ছায়েদুল হক এসে ওঠেন উপজেলা সদরের লংগন নদী তীরস্থ ডাকবাংলোতে। এ সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রবীণ থেকে তরুণ নেতাকর্মী ও বর্তমান-সাবেক জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন পেশার নেতৃবৃন্দ, ক্ষতিগ্রস্ত-ক্ষতিগ্রস্ত নন- এমন সাধারণ হিন্দুসহ শত শত মানুষ উপস্থিত ছিলেন ডাকবাংলায়। অভিযোগ উঠে- ডাকবাংলার একটি কক্ষে পরিস্থিতি নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে ছায়েদুল হক বলে উঠেন- ঘটনা কিছুই না, পরিস্থিতি স্বাভাবিক, মালাউনের বাচ্চারা বাড়াবাড়ি করতাছে। এ সময় তিনি গণমাধ্যমের উপরও ঝাল মেটান বলে অভিযোগ আছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সে সময় পরিস্থিতি বেগতিক থাকায় উপস্থিত কোনো স্তরের হিন্দুরা অশালীন শব্দ প্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাননি। কিন্তু উপস্থিত সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা কানাঘুষা করার পাশাপাশি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে অতি ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে বিষয়টি ভাগাভাগি করেন।
২ নভেম্বর বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. রানা দাশগুপ্ত নাসিরনগরে পা রাখেন আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনের উদ্দেশে। এ সময় বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে জানানো হয়, মন্ত্রী ছায়েদুল হক হিন্দুদের মালাউনের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছেন। এই অশালীন কথা প্রয়োগ ও হিন্দুদের বসতবাড়ি-মন্দিরে হামলার প্রতিবাদে ৪ নভেম্বর সারাদেশে নিজ সংগঠন ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন আহ্বান করেন রানা দাশগুপ্ত। মূলত: এ কর্মসূচি ঘোষণার পরই অবাঞ্ছিত উক্তিটি নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় দেশজুড়ে।
আমাদের অর্থনীতির অনুসন্ধানে যা ও যেভাবে পাওয়া যায় : প্রথমে ৪জন (সেকেন্ডারি সোর্স), যারা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে আপত্তিকর কথাটি জেনেছেন, তাদের কাছ থেকে মন্তব্য গ্রহণ করা হয়, নাম-পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখার শর্তে। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা হয়, গত ৮ নভেম্বর দুপুরে উপজেলা সদরের একটি সরকারি অফিসে বসে, একজন কথা বলেন ৯ নভেম্বর দুপুরে তার ব্যক্তিগত অফিসে বসে, দুজন কথা বলেন তাদের বাসায়। সরকারি অফিসে বসে এবং ব্যক্তিগত অফিসে বসে যার সঙ্গে কথা হয় তারা জানান, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ১ নভেম্বর রাতেই (ঘটনার দিন) প্রত্যক্ষদর্শীরা (দুজন প্রত্যক্ষদর্শী ওই দুজনকে পৃথকভাবে) তাদের বিষয়টি জানান ঘটনাস্থল থেকেই। বাসায় বসে যাদের সঙ্গে কথা হয় তাদের একজন জানান, তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে একটি স্থানে বসে সম্মুখ আলাপে নিজ কানে শুনেছেন সে রাতের ঘটনা। আরেকজন মোবাইল ফোনে জানতে পারেন ঘটনা সম্পর্কে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে এবং ঘটনাস্থল থেকে। এছাড়া আরও দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পাওয়া যায় তাৎক্ষণিকভাবে। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগের মাঝারি মানের নেতা হিসেবে এলাকায় পরিচিত, তিনি হিন্দু ধর্মের অনুসারী। বাকিরা সাধারণ হিন্দু।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে চালানো অনুসন্ধানে ৬ নভেম্বর দুপুরে প্রথম, ৮ নভেম্বর রাতে নাসিরনগরের একটি পাড়ায় দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ (একসঙ্গে তিনজনকে পাওয়া যায়) ও ১১ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে পঞ্চম, ষষ্ঠ প্রত্যক্ষদর্শীকে (একসঙ্গে দুজনকে) সরাসরি পাওয়া যায়। এ সময় গোপন রাখা হয় আমাদের অর্থনীতির পরিচয়। প্রথম সাক্ষাতের তারিখ ওইসব।
দ্বিতীয় দফায় মোট ছয়জন প্রত্যক্ষদর্শীর (প্রাইমারি সোর্স) মধ্যে ৫জনের সাক্ষাৎ পাওয়া গেলেও প্রথম দফায় সবার সঙ্গে সাক্ষাতেই প্রত্যেকের মুখ থেকে শোনা গেছে, ছায়েদুল হক ওই অশালীন শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। কেউ শব্দটি এ প্রতিবেদকের কানে কানে, অতি নিঃশব্দে উচ্চারণ করেছেন। কেউ শব্দটি উচ্চারণ না করে আকারে-ইঙ্গিতে নানা ধরনের কথাবার্তা বলে বুঝিয়েছেন এ প্রতিবেদককে। দ্বিতীয় দফা সাক্ষাতে আরও পরিষ্কার হওয়া গেছে অশালীন শব্দ প্রয়োগের সত্যতা সম্পর্কে।
সাংবাদিক পরিচয় প্রকাশ করে আমাদের অর্থনীতির হিসাবে পাওয়া প্রথম প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ঘটে ৭ নভেম্বর। শর্ত আরোপ করে তার ইচ্ছামতো স্থানে নাসিরনগর ঋষিপাড়ার একটি ঘরে যাওয়া হয় ৭ নভেম্বর দুপুরে। বলার পূর্বে তিনি আমাদের অর্থনীতিকে আভাস দেন- তিনি এটা প্রকাশ করলে তার কী কী সমস্যা হতে পারে। তিনি যদি এসব বলেন, তবে আমাদের অর্থনীতি গোপন রাখবে কি-না এবং কোনো ধরনের রেকর্ডিং করা যাবে না, মোবাইল ফোনসহ অন্য কিছু থাকলে সব বন্ধ করে তার কাছে জমা দিতে হবে। শর্তে রাজি হওয়ার পর তিনি বলেন, ‘আমি নিজের কানে শুনছি, ছায়েদ ভাই আমরারে (হিন্দুদের) মালাউনের বাচ্চা কইছে’। এরপর তার কাছে আরও কিছু প্রশ্ন করা হলে এ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি। একপর্যায়ে তিনি তাড়াহুড়ো করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যান এ প্রতিবেদককে রেখেই। শর্ত থাকায় তাদের কথা অডিও রেকর্ড করা সম্ভব হয়নি। কথা বলার সময় তিনি আমাদের অর্থনীতির ব্যাগ, মোবাইলসহ সব কিছু নিয়ে নেন।
৮ নভেম্বর যাদের কাছ থেকে দুই প্রত্যক্ষদর্শীর কথা জানা যায় সেই একজন প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজ করতে গিয়ে মিলে যায় আরও দুই প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজ। ৮ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে তারা তাদের নিজ পাড়ার একটি গলিতে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচিত শব্দটি নিয়ে কথা বলছিলেন। তাদের বাড়ি নাসিরনগর গাংকূলপাড়া সংলগ্ন লংগন নদী তীরস্থ। সেদিনই তাদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ আমাদের অর্থনীতির। একটি এনজিওর কর্মী পরিচয় দিয়ে তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পরই গল্পের আসর জমানো হয় লংগন নদীর তীরে। গল্পচ্ছলে তারা খুব শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করেন- তারা প্রত্যেকেই নিজ কানে শুনেছেন, মন্ত্রী গালি দিয়েছেন। ১৫ মিনিট গল্পের পরই আমাদের অর্থনীতি সেই জায়গা ত্যাগ করেন তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। একইসঙ্গে ১১ নভেম্বর গল্পের আসর বসানোর জন্য তাদের প্রতি অনুরোধও জানানো হয়। ১১ নভেম্বর রাতে লংগন নদীর তীরে একটি ডিঙি নৌকায় তরুণ বয়সী এ তিনজনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সাক্ষাৎ ঘটলে সাংবাদিক পরিচয় জানানো হয়। কিন্তু তারা ভড়কে যান। তারপরও অনেক চেষ্টার পর তারা শর্ত দেন- নাম-পরিচয় গোপন রাখার এবং কোনো ধরনের রেকর্ডিং করা যাবে না, ছবি তোলা যাবে না। এসব করলে তারা কী কী সমস্যায় পড়বেন, সব বলা হয়। সব শর্তে রাজি হওয়ার পর তারা আমাদের অর্থনীতির কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ব্যাগ এমনকি মানিব্যাগও নিয়ে নেন। সবকিছু মেনে এ সময় তাদের প্রশ্ন করা হয়- আসলে ছায়েদুল হক কী বলেছিলেন। তিনজনের একজন বলেন, আমগোরে ডুবাইয়া দিছে। এ কথা শোনার পর আমার ভিতর কাইপ্পা উঠছিল। মা¹োমা, কেমনে কইল, মালাউনের বাচ্চারা বাড়াবাড়ি করতাছে। বাকি দুজন মাথা নেড়ে কথায় সায় দিচ্ছিলেন। আবার প্রশ্ন করা হয়- আসলে কোন শব্দ ব্যবহার করেছেন মন্ত্রী- মালাউন, মালু, মালাউনের বাচ্চা নাকি অন্য কিছু। এ সময় হুট করে অন্য আরেকজন বলে উঠেন, মালাউনের বাচ্চা কইছে দাদা। আবার প্রশ্ন- হাসিমুখে, ঠা-া মেজাজে, নাকি গরম মেজাজে বলা হয়? প্রথম বক্তা বলেন- দাদা, চিল্লাইয়া কইছে মালাউনের বাচ্চা। আমি উনার থেইক্কা কমছে কম ২০ হাত দূরে আছিলাম। আমার কানে কথাটা বারি (ধাক্কা) মারছে। এরপর তারা আর কিছু বলতে চাননি। শর্ত থাকায় তাদের কথা অডিও রেকর্ড করা সম্ভব হয়নি।
১১ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে আমাদের অর্থনীতির ক্রম অনুযায়ী পঞ্চম, ষষ্ঠ প্রত্যক্ষদর্শীকে (একসঙ্গে দুজনকে) সরাসরি পাওয়া যায় সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে, এটি ছিল এ দুই প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। তারা যেখানে বসে ছিলেন সেটি ছিল একটি দোকান। দুই প্রত্যক্ষদর্শীর একজন এ দোকানে ব্যবসা পরিচালনা করেন। ‘মোবাইলে চার্জ প্রয়োজন’ বলে আমাদের অর্থনীতি এ দোকানে প্রবেশ করে এবং এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। একপর্যায়ে অশালীন কথার ভিত্তি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তাদের কথায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে বিষয়টি। প্রায় আধ ঘণ্টা এ বিষয়ের বাইরেও এলাকার অন্য বিষয় নিয়েও কথা শেষে আমাদের অর্থনীতি তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়। সব আলোচনা গোপনে করা হয় অডিও রেকর্ডিং।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রত্যক্ষদর্শীর মধ্যে পঞ্চম প্রত্যক্ষদর্শীর দ্বিতীয় দফা সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। শুধু ষষ্ঠ প্রত্যক্ষদর্শীর দ্বিতীয় দফা সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। ১২ নভেম্বর দুপুরে ষষ্ঠ প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে দেখা হয়, নাসিরনগর বাজারের একটি সড়কে। এ সময় তাকে জানানো হয় তাদের দুজনের রেকর্ডিং-এর কথা ও সাংবাদিক পরিচয়। এ সময় তিনি এ প্রতিবেদকের ডান হাত চেপে বাজার সংলগ্ন একটি গলিতে নিয়ে যান এবং করজোড় মিনতি করে এ প্রতিবেদককে বলেন, দাদা, সব বলব। কিন্তু আমার জানি কিছু না হয়। আমার নাম-পরিচয় প্রকাশ কইরেন না দাদা। আমরা গরিব মানুষ, দেশই ছাইরা দিতে হইব। তার শর্তে রাজি হওয়ার পরই তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে স্পষ্টভাষায় সব বর্ণনা করেন। তিনি এ প্রতিবেদকের প্রশ্নে বলেন, কইছে কথা ঠিকই, কইয়া আবার অস্বীকার করছে। আবার প্রশ্ন- কী বলছে। তিনি বলেন, মালাউন কইছে কথা ঠিকই। আবার প্রশ্ন- পুরো কথা, বাক্যটা কী বলেছে। তিনি বলেন, হিডা শুনা (শোনা) যানা, দূর তে তো। মালাউন যে কইছে, এইডা একশ একশ। কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে এটা শুনেছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, রুমের দূরেই আছিলাম। মানুষ তো বেশি। রুমের ভিতর মন্ত্রী আইছে। বারান্দা না, অক্করে বাইরে, সাইডে একটা জানালার ধারে। মানুষ টাল (খুব বেশি ভিড়), জানালার ধারে, মন্ত্রী আইসে মানুষ দেখব, মন্ত্রী কী কয়। ভিতরে যেরা আছিল হেরা কইতারব আরও ভালা। অহন আমি তো আর এলহা (একা) না, মানুষ তো শতাশতি গেছে। কইছে, দুইচাইরটা মানুষ কী মরছে, আমি গিয়া দেখতাম। তুসতাছ (রাগ প্রদর্শন) করছে। এরপর আশপাশের লোকজন কী করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরপর তারে (মন্ত্রী) আর কেউ কিছু কইছে? প্রশ্নের এ উত্তর পাইয়া তার কাছে আর কেউ গেছেও না। এছাড়া প্রাসঙ্গিক আরও কিছু কথা বলেন তিনি। এসব কথার অডিও রেকর্ড রয়েছে আমাদের অর্থনীতির কাছে। যা ধারণ করা হয় গোপনে।
১১ নভেম্বর পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রত্যক্ষদর্শীকে যখন প্রথমবারের মতো পাওয়া যায় সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে, তখন পঞ্চম ব্যক্তি তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে বলেছিলেন, আমার ধারে আমার বাচ্চাডা ৫০ কোটি টেহা। আমি ওই কথা (মালাউনের বাচ্চা) জীবনেও কমু না। প্রশ্নে এ প্রতিবেদকের বাম পাশে একটি কাঠের চেয়ারে বসা তিনি খুব মৃদু স্বরে বলেন, আমরা যেইডা কইছি, এইডাই, মালাউন কইছে। এইডাই সঠিক। এ সময় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন করেন- আইচ্চা, আইচ্চা, আমি একটা কথা কই, এই যে নাসিরনগরে যে মালাউন কইছে না (স্বর মোচড় দিয়ে), নাসিরনগরের কেউতো আর ঢাকা গিয়া কইছে না, তাইলে এইডা লইয়া সারাদেশে অতো কুছতা কেমনে হইল? এই ব্যক্তি মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলেন, আমরার মন্দিরো যাওনের আগে কইছে, দুইচাইট্টা (দু’চারটা) মরছেনি। এই কইছে না (পাশে উপস্থিত আরেকজনকে ইঙ্গিত করে)? তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, গৌর মন্দিরে যাওনের আগে অই কইছে, মানুষ তো মরছে না দুই চাইট্টা মরলে এসে ( দু-চারজন মারা যাওয়ার পর) বুঝতাম। অতো তাইস (তাড়াহুড়ো) কেল্লাই¹া (কেন)। তিনি ছায়েদুল হকের সমালোচনা করে বলতে থাকেন- হিন্দু সমাজ তাকে যে বিশ্বাস করত, সেটা উঠে গেছে। এই যে দেহেন, আগে ডাকবাংলায় মানুষ যাইত, অহন যায় কেউ? এছাড়াও তিনি আরও অনেক কথাই বলেন।
সে সময় কে কে উপস্থিত ছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অঞ্জন (উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন কুমার দেব, প্রদীপ সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রদীপ কুমার রায়)। তারা কেউ কিছু বলেননি বলে জানান তিনি। এসব কথারও অডিও রেকর্ডিং রয়েছে আমাদের অর্থনীতির কাছে, ধারণ করা হয় ১১ নভেম্বর রাতে।
পঞ্চম প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয় প্রকাশ করে ও গোপনে ধারণ করা অডিও রেকর্ডের কথা জানিয়ে দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হয় ১২ নভেম্বর রাতে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই। তাকে বলা হয়- আরও ভালো করে পুরো ঘটনা বর্ণনা করতে। কিন্তু তিনি ভয়ে কাঁপতে থাকেন সঙ্গে সঙ্গেই। একটি পর্যায়ে তিনি আমাদের অর্থনীতির হাত চেপে অনুরোধ করে বলেন, আরও পরে (১২ নভেম্বর গভীর রাতে) তার বাসায় যেতে। তার কথা অনুযায়ী তার বাসায় যাওয়া হয়। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের পাওয়া গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি, বন্ধ পাওয়া যায় মোবাইল ফোন নম্বরটিও। বহু খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায়নি ১৩ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত, তার দোকানও বন্ধ পাওয়া যায়।
প্রত্যক্ষ ও যারা প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখ থেকে শুনেছেন, তারা কোন শ্রেণির : ৪জন, যারা প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখ থেকে আপত্তিকর কথাটি শুনেছেন, তারা প্রত্যেকেই স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। এর দুজন ক্ষমতাসীন দলের (একজন ছায়েদুল হক বিরোধী ও একজন ছায়েদুল হকপন্থি), একজন মহাজোটের একটি শরিক দলের ও আরেকজন স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠনের নেতা (আওয়ামী লীগ সমর্থক, ছায়েদুল হকপন্থি)। আর ছয়জন প্রত্যক্ষদর্শীর মধ্যে একজনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের মাঝারি মানের নেতা হিসেবে এলাকায় পরিচিত, তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হিন্দু ধর্মের অনুসারী। বাকিরা সাধারণ হিন্দু। প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখ থেকে শোনা ৪জনের সবাই হিন্দু।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ৫ জন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ, দিন এনে দিন খায়। আওয়ামী লীগ করেন বটে কিন্তু দলীয় কোন্দলের মধ্যে তারা নেই, স্থানীয় রাজনীতিতে তারা পক্ষ-বিপক্ষ অবলম্বন করেন না। সব প্রত্যক্ষদর্শীর বয়স- ২৫ থেকে ৩৫ পর্যন্ত।
মন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ ও আওয়ামী লীগের হুঁশিয়ারি : এ অশালীন কথা প্রয়োগ নিয়ে গত ৬ নভেম্বর নাসিরনগর আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ছায়েদুল হক সংবাদ সম্মেলন করে চ্যালেঞ্জ করেন- কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে তিনি এ গালি দিয়েছেন, তবে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন। এটা প্রমাণিত হলে ছায়েদুলের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও হুঁশিয়ারি আছে।
সূত্র: আমাদের অর্থনীতি
এফএফ