মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক প্রকাণ্ড ব্যাপার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তার চেয়ে প্রকাণ্ড আর কোথাও কিছু নেই। সেখানে যেসব বোমা তৈরি হয় সেগুলো যেমন প্রকাণ্ড, সেখানকার জোড়া দালানে কোনো এক অলৌকিক বিমানঘাঁটি থেকে উড়ে এসে যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়, তা–ও প্রকাণ্ড। পৃথিবীর কোথায় যুদ্ধ বাধবে আর কোথায় গৃহযুদ্ধে শান্তিপূর্ণ জনপদ বিধ্বস্ত হবে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া কারও পক্ষে শুরু করা সম্ভব নয়। সেখানে যে নির্বাচন হয়, তা–ও প্রকাণ্ড ব্যাপার। সেই নির্বাচনের যে প্রচারণা চলে বছর খানেক ধরে, তা–ও এক বিশাল আয়োজন।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ভবিষ্যদ্বক্তারা। তাতেও কুলাচ্ছে না। বানর, টিয়া পাখি, মাছ প্রভৃতি প্রাণীকে পর্যন্ত আমেরিকার চার বা আট বছরের জন্য কে নেতা হবেন, তা বলে দেওয়ার জন্য করজোড়ে উৎসাহীরা অনুরোধ করছে। একই বিষয়ে তিনজন যদি তিন রকম বলে, তার একটা না-একটা ফলবেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি চরম উন্নতির সময়ে এ-জাতীয় কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রমাণিত হয়, মানুষ আসলে আদিম সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
আমেরিকা দেশটি যেহেতু সেরা এবং এই গ্রহের ভাগ্যবিধাতা, তাই সে দেশের যিনি নেতা হবেন, তাঁর থাকবে প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও উঁচু মানবিক গুণাবলি—এমনটিই পৃথিবীর মানুষ প্রত্যাশা করে। গোঁয়ার ও স্বেচ্ছাচারী প্রকৃতির লোক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন এই জন্য যে পারমাণবিক বোমার চাবিটি তাঁর হাতেই থাকে। গত কয়েক দশকে পৃথিবীর বহু দেশের নির্বাচনী ফলাফলের রায় আমেরিকার শাসকেরা অগ্রাহ্য করেছেন। কোথাও অনেকে বিজয়ী হয়েও ক্ষমতা পাননি। ক্ষমতা পেয়েও অনেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। সবশেষ হতভাগ্য মোহাম্মদ মুরসি এখনো নীলনদের দেশে কোনো কারাগারে পড়ে রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যুবসমাজকে নামিয়ে এক বিক্ষোভ বাধিয়ে সেনাবাহিনীর লোকদের দিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। আরব বসন্তের কথা সবাই জানেন। কিন্তু আমেরিকার নেতারা অনুমান করতে পারেননি আরব বসন্তের পরে আমেরিকার বসন্ত শুরু হতে এক দশকের বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না।
আমেরিকার শাসকশ্রেণি ভেবেছিল, অসন্তুষ্ট ও প্রতিবাদী যুবসমাজ শুধু তিউনিসিয়া বা মিসরেই আছে। ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের পরও তারা আত্মতৃপ্তই ছিল। তারা খুবই ক্ষমতাধর, কিন্তু এই জগতে ক্ষমতাধরেরাও ভুল করে। এবং তাদের ভুলের জন্য চড়া মাশুল গুনতে হয়—তাদের নিজেদের এবং জনগণকে।
নির্বাচনের আগে আমাদের উপমহাদেশে তো বটেই, আমেরিকায়ও প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতারা কঠোর ভাষায় পরস্পরকে সমালোচনা করেন।
ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক বক্তব্যও যথেষ্টই থাকে। কিন্তু এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প পৃথিবীর ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। আমেরিকার বৈদেশিক নীতি যেমন বিশ্বব্যাপী নিন্দিত, তেমনি তার অভ্যন্তরীণ উদার গণতান্ত্রিক নীতির কখনো প্রশংসাও করা হয়। সেই উদার নীতিতে ট্রাম্প করেছেন পদাঘাত। ধর্মীয়, লৈঙ্গিক, জাতিগত প্রভৃতি যতভাবে হিংসার বিষ ছড়ানো সম্ভব, সমাজ ও রাষ্ট্রকে যতভাবে বিভক্ত করা সম্ভব, তার কিছুই তিনি বাদ রাখেননি। তিনি পৃথিবীর বড় বর্ণবাদী। অশ্বেতাঙ্গদের তিনি ঘৃণা করেন। মুসলমানদের প্রতি তাঁর ঘৃণা সীমাহীন। পরাজিত প্রার্থী কারচুপির অভিযোগ আনেনিন বরং তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
কোনো দেশে নেতা নির্বাচিত হলে পৃথিবীর সব দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তাঁদের অভিনন্দন জানিয়ে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। খুব ঘনিষ্ঠ কেউ হলে টেলিফোনেও কথা বলেন। এটাই রীতি। আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরাও অভিনন্দনবার্তা পাঠান। অধিকাংশ সময় সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারাই এ কাজটি করে থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ কেউ মারা গেলেও তাঁদের বার্তা ওভাবেই পাঠানো হয় বা প্রেসে জানানো হয়। সাধারণত এসব বার্তা প্রথাগতই বা গৎবাঁধাই হয়ে থাকে, কখনো ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম ঘটে। তাতে যোগ হয় অপ্রথাগত কিছু কথা। সেটা বিরল ব্যতিক্রম।
ট্রাম্পের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার পর মুহূর্ত দেরি না করে আমাদের সরকার ও বিরোধী দল থেকে অভিনন্দন জানানোর তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। স্তাবকতা বা চামচামি যে আমরা শুধু দেশের মধ্যেই করি তা নয়, তা ছড়িয়ে দিয়েছি বিশ্বব্যাপী। কোনো নির্বাচনে দশমিক শূন্য শূন্য এক (.০০১) শতাংশ ভোট পান না এমন নেতাও ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বার্তায় ট্রাম্পকে তাঁর তৃতীয় স্ত্রী মেলানিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাঁর বার্তায় বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ই আপনার অনন্যসাধারণ নেতৃত্বগুণ এবং আমেরিকার জনগণ ও বিশ্বমানবতার সেবা করার যোগ্যতার প্রমাণ।’ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বশান্তি ও মানবজাতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন’ এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
যেসব কর্মকর্তা নেতাদের বাণী রচনা করেন, তাঁদের শব্দচয়নে সতর্ক হতে হয়। কোনো কিছুই মানুষের চোখ এড়ায় না। বাংলাদেশের নেতাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসামূলক বার্তা বাইরের দুনিয়ার মানুষের চোখে পড়েছে। সস্ত্রীক ট্রাম্পকে বাংলাদেশে দাওয়াত দেওয়ার কথাটিও। ব্রিটেনের দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট‘মহামান্য’ ট্রাম্পের বিজয়ে বিশ্বের চতুর্থ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অভিনন্দনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলেছে, ‘মুসলমানদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রশংসাপূর্ণ বার্তায় আমেরিকার জনগণ ও বিশ্বমানবতার সেবায় তাঁর অনন্যসাধারণ নেতৃত্বের তারিফ করেছেন।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলমানদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে থাকলেও তা তাঁকে বাংলাদেশের অভিনন্দন জানাতে বাধা হয়নি। অতি দ্রুত পাঠানো বার্তায় মুসলমানবিদ্বেষ নিয়ে ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্য প্রসঙ্গেও কিছু ছিল না। ব্রিটিশ দৈনিকটি কিছু পুরোনো প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছে।
নতুন প্রেসিডেন্ট তাঁর কাজকর্ম ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা সফরে আসবেন বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখতে, সে আশা যদি না–ও করি, তাহলেও বলতে হয়, ওই আমন্ত্রণ তিনি একটু থিতু হয়ে বসলে করলেই ভালো হতো। এখন তিনি আছেন টালমাটাল অবস্থার মধ্যে। আরব বসন্ত নয়, আমেরিকা বসন্তের শুরু কেবল। তাঁকে নিয়ে উত্তাল তাঁর নিজের দেশ। রাস্তায় কালো ও মুসলমান নয়, সাদাই বেশি।
আমাদের কর্মকর্তাদের রচিত অভিনন্দনবার্তা শুধু নয়, ১৪-দলীয় বিশ্লেষকদের ট্রাম্পের বিজয়ে আনন্দের অন্ত নেই। ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশের ‘মৌলবাদবিরোধী’ সরকারের জন্য আশীর্বাদ। তাঁর জয়কে ‘স্বাগত’ জানিয়ে এক সরকারপন্থী বিশ্লেষক বলেছেন, ‘এ রায় জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে। বিশ্বের প্রত্যাশা থেকে নিজেদের পৃথক করে এ রায়ে আমেরিকার জনগণের প্রত্যাশাকে বড় করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করবেন ট্রাম্প। জঙ্গিবাদ সম্পর্কে দুই দেশের অভিন্ন নীতি স্বভাবতই ট্রাম্প প্রশাসনকে বাংলাদেশের কাছে নিয়ে আসবে।’ [বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ নভেম্বর]
এই মন্তব্য যখন ঢাকার ছাপাখানায় মধ্যরাতে ছাপা হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দিনের বেলা আমেরিকার রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে তাঁদের প্রত্যাশা পূরণে। ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ ঘোষণা করেছেন স্বাধীনতার, যে ক্যালিফোর্নিয়াকে মেক্সিকো থেকে যুদ্ধ করে ১৮৪০-এর দশকে আমেরিকা দখল করে নেয়। পৃথিবীর বহু দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বাধীন হতে দুই হাত উজাড় করে সাহায্য দেয় আমেরিকা। এখন ট্রাম্প কী করবেন? একদিকে মুসলিম অভিবাসীদের বিতাড়িত করবেন, অন্যদিকে বাংলাদেশের ১৪-দলীয় মহাজোটের সরকারের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ পাতবেন।
বাংলাদেশ সরকারের পাশে ভারত ও রাশিয়া ছিল। তাদের সঙ্গে গত মাসে এসে যোগ দিয়েছে বন্ধু চীন তার অর্থভান্ডার নিয়ে। আগামী জানুয়ারিতে বাংলাদেশকে কাছে টেনে নেবে ট্রাম্পের আমেরিকা। একই সঙ্গে চীন ও আমেরিকা কোনো দেশের পাশে থাকলে তার পাশে অন্য কোনো দেশের না থাকলেও কুচ পরোয়া নেই।
ঘটনাক্রমে বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রবল প্রগতিশীল কেউ এ সত্য অস্বীকার করতে পারবে না। মুসলমান আর মৌলবাদী মুসলমান এক জিনিস নয়, যেমন ভাত আর পচা ভাত এক নয়। নীতিনির্ধারকদের সমীকরণ এ রকম: বাংলাদেশ ইসলামি জঙ্গিতে ভরে গেছে, তাদের দমনে সরকার কঠোর, তাই মুসলিমবিদ্বেষী ট্রাম্পের সহানুভূতি পাওয়া যাবে। এই হিসাবনিকাশ হবে সবচেয়ে বড় ভুল।
৩০ লাখ অভিবাসীকে ট্রাম্প বিতাড়িত করবেন। তাঁদের মধ্যে হাজার হাজার বাঙালিও থাকতে পারেন। তাঁরা আমেরিকায় হাওয়া খাচ্ছেন না। সেখানকার অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। অভিবাসী তাড়ানো প্রভৃতি নিয়ে বহু দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর শুধু আমেরিকার জন্য নয়, তা তাঁর পশ্চিিম মিত্রদেশের জন্য বিপজ্জনক, সে কথা জার্মান অর্থমন্ত্রী ভলফগ্যাঙ শায়েবুল বলেছেন: ‘হিজ ডেমাগগিক পপুলিজম ইজ নট অনলি আ প্রবলেম ইন আমেরিকা, এল্সহোয়ার ইন দ্য ওয়েস্ট, টু।’ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ট্রাম্পকে পাঠানো বাণীতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি কাজ করতে চান ‘অন দ্য বেসিস অব শেয়ার্ড ভ্যালুজ’—মূল্যবোধের ভিত্তিতে। সে মূল্যবোধগুলোর নামও তিনি উল্লেখ করেন তাঁর বার্তায়। তা হলো—গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং গোত্র, ধর্ম ও লিঙ্গের সমঅধিকার। জার্মান টেলিভিশন জেডএফডি এক জরিপে বলেছে, ৮২ শতাংশ জার্মান মনে করেন, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া পৃথিবীর জন্য শুধু খারাপ নয়, অতি খারাপ—নট অনলি ব্যাড, ভেরি ব্যাড ফর ওয়ার্ল্ড।
শপথ গ্রহণের আগেই তাঁর অভিশংসনের দাবি উঠেছে। তাঁকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেও তাঁর দেশবাসী এখন তাঁকে চাইছে না। নজিরবিহীন আন্দোলন। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রক্ষা করাই কঠিন। তবে বাংলাদেশই রোল মডেল, পৃথিবীকে পথ দেখায়। খালেদা জিয়ার বাড়ির সামনে যেমন বালুভর্তি ট্রাক রাখা হয়েছিল, সেই বালুবোঝাই ট্রাক দিয়ে ‘ট্রাম্প টাওয়ার’ বিক্ষুব্ধ জনতার রোষ থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। আমরা তাঁর মঙ্গল কামনা করি।
এবিআর
সূত্র: প্রথম আলো