ইসমাঈল আহসান; সাংবাদিক
মাওলানা আব্দুর রহীম রহ. এর ইসলামি বিষয়ের ওপর বিস্তর লেখালেখি ছোটবেলায় পড়ার চেষ্টা করতাম কিন্তু উচ্চমার্গের সাহিত্য ভাষার জন্য বারবার থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হতাম। কারণ, ছোট মন-মগজে এত কঠিন শব্দচয়ন ঠিক বুঝে আসতো না। অনেক পরে বড়দের মুখে শুনতে পাই, কেউ যেন কোনদিন বলতে না পারে আলিমরা বাংলা জানে না-এই কথা ভেবেই মরহুম মাওলানা সাহিত্যিক বাংলায় লেখালেখি করতেন। তারপর তো অনেক পথ পাড়ি দেওয়া আর শপথ নেওয়া, যত কষ্টই হোক লেখালেখির অঙ্গনে টিকে থাকার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
উর্দু-ফার্সির প্রবল প্রতাপের সেই সময়ে বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চা করার জন্য যে তিনজন ব্যক্তিত্বের নাম না নিলে নয়, তাঁরা হচ্ছেন মাওলানা আবদুর রহিম, অধ্যাপক আখতার ফারুখ ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য সাহিত্যের শাখায় ব্যাপক কাজ করেছিলেন প্রখ্যাত চার মণীষী সৈয়দ আলী আহসান, কবি ফররুখ আহমদ, কবি বেনজির আহমদ ও কবি তালীম হোসেন। তরুণ মুহিউদ্দীন খান ছিলেন এই ধারার আলিম প্রতিনিধি। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিগত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। এমন কোনো ঐক্যপ্রয়াস ছিল না, যার নেপথ্যে মাওলানা খান সক্রিয় ছিলেন না। জাতির মন, মনন ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আত্মস্থ করে সেটা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে মুহিউদ্দীন খান সংগঠক হিসেবে একাই ভূমিকা পালন করেছেন। ফিক্বহ শাস্ত্রে মাওলানার পাণ্ডিত্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতে স্বীকৃত। অনেক বিতর্কিত ধর্মীয় ইস্যুতে এমিকাস কিউরি হিসেবে তিনি জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। যার কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থা রাবেতা আলমে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চার এই অগ্রপথিক ১৯৩৫ সালের ১৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার ছয়চির গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মরহুমের পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার আনসার নগরে। পাঁচবাগ মাদরাসা থেকে ১৯৫১ সালে আলিম ও ১৯৫৩ সালে স্কলারশিপসহ ফাজিল পাস করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে হাদিস বিষয়ে কামিল ও ১৯৫৬ সালে ফিকহ বিষয়ে কামিল ডিগ্রি লাভ করেন। আলিয়া ধারায় লেখাপড়া করলেও খান সাহেব কওমি ধারার সাথে বেশি সম্পর্ক রেখে চলতেন। সারাটি জীবন দেওবন্দী চিন্তা-চেতনাকে লালন করেন। দেওবন্দী ওলামা মাশায়েখদের লিখিত গ্রন্থ বাংলায় তরজমা করেন। দেওবন্দী ধারার সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ প্রসঙ্গে ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের প্রাক্তন মুহতামিম আল্লামা ক্বারী তাইয়েব রহ. ‘মাসলাকে ওলামায়ে দেওবন্দ’ গ্রন্থে লিখেন ‘দরসে নিজামি পড়া ও পড়ানোর নাম দেওবন্দিয়ত নয়; এটি একটি বোধ ও চিন্তাধারার নাম যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদার উপর প্রতিষ্ঠিত’। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান তার উজ্জ্বল নিদর্শন। গোটা জীবন মাদরাসায় পড়েও দেওবন্দী হতে পারেননি এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আবার তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল ও আধুনিক চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ ইসলামি বিশেষজ্ঞ। যেকোনো প্রান্তিক চিন্তাই তিনি পরিহার করতেন। আকিদা সচেতন থেকে এতটা সর্বজনীন, সর্বজনগ্রাহ্য ও ঐক্যপ্রয়াসী আলিম সাধারণত চোখে পড়ে না। আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আত্মস্থ করেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক উদারমনা; কিন্তু নিপাট আমলদার মানুষ। যেরকম উদারমনা আলিম খুব একটা পাওয়া যায় না বাংলাদেশের বহুধা বিভক্ত আলিম সমাজের মধ্যে, যেখানে প্রত্যেক ধারারই দাবি, তাঁরাই সেরা এবং একমাত্র ইসলাম।
এই আলিমে দীন রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ রেখে চলতেন; কিন্তু রাজনীতিবিদ হতে চাইতেন না। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে, তাঁর সংগঠক সত্ত্বা তাঁর অনন্য সাধারণ লেখক সত্ত্বাকে ছাড়িয়ে গেছে-তবুও তিনি লেখালেখির ভূবন কখনো ছেড়ে যাননি। যে ভুলটি লেখকদের মধ্যে আমরা অনেকেই করে থাকি। আমরা ভুলে যাই, রুটি-রুজির জন্য যে পেশাই অবলম্বন করে থাকি না কেন-একজন লেখকের মূল পরিচয় সে লেখক। এ ক্ষেত্রে মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন তার প্রেরণা। যদিও চিন্তাগত দিক থেকে তিনি তার শতভাগ অনুসারী ছিলেন না। আবুল মনসুর আহমদ, খন্দকার আবদুল হামিদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, সানাউল্লাহ নূরী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আখতার উল আলমসহ প্রথম কাতারের সাংবাদিকদের সাথে মরহুমের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তারা সবাই মাওলানার ভাষাজ্ঞানের প্রশংসা করেছেন। মরহুমের গদ্যচর্চার ধরন ছিল সাবলীল।
মাসিক মদীনা মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ.-এর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এ পত্রিকাটির জন্য তিনি অনেক মেহনত করেন। এমনকি মাথায় নিউজপ্রিন্ট বহন করে প্রেসে নিজে পৌঁছে দিতেন। তাঁর সম্পাদিত ‘মাসিক মদীনা’র প্রশ্নোত্তর বিভাগটি ছিল পাঠকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পাঠকদের আগ্রহে প্রশ্নোত্তর সঙ্কলন ‘সমকালীন জিজ্ঞাসার জবাব’ ২০ খণ্ডে মদীনা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সমকালীন ও আধুনিক অনেক মাসআলা মাসায়েলের দালিলিক জবাব রয়েছে এতে। যার অনুনণন হিসেবে অঅজকে প্রায় সব গণমাধ্যমেই ইসলামি প্রশ্নোত্তর বিভাগ তুমুল জনপ্রিয়। এক কথায় তিনি বিজ্ঞ অনুবাদক, প্রাজ্ঞ সীরাত গবেষক, স্বার্থক লেখক, দূরদর্শী ইসলামি চিন্তাবিদ, তুখোড় বক্তা ও দক্ষ সংগঠক।
মরহুম মাওলানা বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে স্থায়ী কাজ করে গেছেন। প্রায় শতাধিক গ্রন্থ তিনি উর্দূ থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত করেন। এর মধ্যে তাফসির, সীরাতে রাসূল ও ইতিহাসনির্ভর গ্রন্থ সবচেয়ে বেশি। আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ. বিরচিত ৮ খণ্ডের কালজয়ী তাফসির গ্রন্থ ‘মাআরিফুল কুরআন’ তিনি উর্দূ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেন। ইসলামিক ফাউণ্ডেশন থেকে এটি প্রকাশিত হয়। ১৪১৩ হিজরিতে মদীনাস্থ বাদশাহ ফাহদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্পের উদ্যোগে ‘মা’আরিফুল কুরআন’ সংক্ষিপ্তাকারে ১ খণ্ডে বাংলায় ছেপে সারা দুনিয়ায় বাংলাভাষীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। ইমাম গাজালির ‘ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদের ‘ইনসানিয়ত মওত কে দরওয়াযে পর’ (জীবন সায়াহ্নে মানবতার রূপ) গ্রন্থের স্বার্থক অনুবাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ.। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মদীনা পাবলিকেশন্স ১৯৫৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত কুরআন, হাদিস, সীরাতে রাসূল, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অভিধান বিষয়ক প্রায় হাজারের কাছাকাছি মানসম্মত গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এসব গ্রন্থ বাংলাদেশে এবং বিদেশের বাজারে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
আজ থেকে ৬৫ বছর আগে ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে তিনি ঢাকা আলিয়ায় হাদীস ও ফিক্বহ্ শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য এসেছিলেন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সাহিত্য রচনা করেছেন, জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দিক নির্দেশনা দিয়েছেন ও আশার বাণী শুনিয়েছেন। অবশেষে ঢাকাকে বিদায় জানিয়ে ২৬ জুন গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে গেলেন চিরদিনের জন্য। গফরগাঁও উপজেলার আনসারনগরে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর শেষ ঠিকানা। কা’বার মহান অধিপতি আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চতর মাকাম নসিব করেন, আমিন।
এক্ষেত্রে একটি ছোট্ট ঘটনা বলে শেষ করবো। ঘটনাটি হলো, মাহফুজ আনাম (মহাত্মন আবুল মনসুর আহমেদের ছেলে ও ডেইলি স্টার সম্পাদক) যখন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুস সামাদ’র (সম্ভবত:, আমার নাম ঠিক মনে নেই) সাথে কাজ করছিলেন, তখন তিনি পত্রিকার ব্যবস্থাপনার কাজে খুব ব্যস্ত সময় পার করছিলেন, এতে তার নিজস্ব লেখালেখি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। একদিন সম্পাদক সাহেব তাঁকে ডেকে বললেন, ‘পত্রিকার ব্যবস্থাপনার জন্য যত কাজ করবেন-সেগুলোর জন্য বাহবা পাবেন কিন্তু আপনি যত কাজই করেন না কেন-সেগুলো কিন্তু সময়ের কাছে টিকে থাকবে না। সময়ের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে শুধু আপনার নিজের লেখালেখি। কারণ এটা একান্তই আপনার নিজের সম্পদ। এখানে কেউ ভাগ বসাতে পারবে না এবং অনাগত ভবিষ্যতের কাছে আপনার লেখালেখি দিয়েই আপনি মূল্যায়িত হবেন।’
আমার মনে হয়, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ. এর ঘটনা বহুল জীবন থেকেও প্রত্যেক লেখকের বিশেষ করে আলিম লেখকদের এ বিষয়টা মনে রাখা একান্তই দরকার।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: (উইকিপিডিয়া বা এ রকম কোন সূত্রে মাওলানার গোছানো কোন জীবনি না পাওয়াতে নিম্নোক্ত প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিকের লেখা থেকে সহযোগিতা নেয়া হয়েছে)
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, মাসুদ মজুমদার ও মুফতি এনায়েতুল্লাহ
আরআর