মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী। আলেম, লেখক, গবেষক ও সমাজ পরিবর্তনের নেশায় ডুবে থাকা এক ব্যক্তি। ছাত্র জীবন থেকেই যিনি ভাবছেন সমাজ নিয়ে। মুসলিম উম্মাহর কাছে ইসলামের আধুনিক চিন্তার প্রসার ও হজরত আলী মিয়া নদভীর চেতনা মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন নিরলস। কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পর দারুল উলুম দেওবন্দ ও লখনৌ হয়ে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন। বর্তমানে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষণায় লিপ্ত রয়েছে। অধ্যপনাও করছেন সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। থেমে নেই দেশ ও এলাকা উন্নয়নের কাজেও। কুষ্টিয়া উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যানারে করছেন সমাজসেবা আর রিসালাতুল ইনসানিয়া বাংলাদেশের ব্যানারে ইসলাম, মানবতা ও শিক্ষার প্রসারে অবিরাম কাজ করেছে চলেছেন।স্বপ্নজয়ী এ তরুণের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের নির্বাহী সম্পাদক রোকন রাইয়ান
আওয়ার ইসলাম: আপনার শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক অবস্থা থেকে শেষ পর্যন্ত জানতে চাই?
মাওলানা ফারুকী: পারিবারিকভাবে আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর প্রথম শ্রেনি থেকে তৃতীয় পর্যন্ত গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়াশুনা করি। আপাতত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্তই স্কুলে লেখাপড়া করি। এরপর আব্বা-আমার আগ্রহে মাদরাসায় ভর্তি হই। পাশের গ্রামের স্বরূপদহ দারুল উলূম ইসলামিয়া মাদারাসায় নূরানী পদ্ধতিতে মকতব থেকে কুরআনুল কারীমের নাজেরা সমাপ্ত করি। উল্লেখ্য, এই মাদরাসার আমিই সর্বপ্রথম ছাত্র ছিলাম এবং আমার সর্বপ্রথম উস্তাজ ছিলেন মাওলানা আব্দুল্লাহ ওমর ফারুক। তিনি এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তারপর হুজুরের নির্দেশনায় চলে আসি রাজধানী ঢাকায়। সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদপুরস্থ ঐতিহ্যবাহী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় ‘জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়ায়’ ‘তাহফীযুল কুরআন’ থেকে শুরু করে ‘সানুভিয়া উল্ইয়া’ (উচ্চ মাধ্যমিক) পর্যন্ত লেখাপড়া করি। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যাই বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দ, ভারত-এ। সেখানে জালালাইন, মিশকাত ও তাকমিল ফিল হাদিস সমাপ্ত করি। এরপর ভারতে আরেক বিখ্যাত আরবি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা, লখনৌ ‘আরবি ভাষা ও সাহিত্য’ নিয়ে উচ্চতর লেখাপড়া করি। পরবর্তীতে ঢাকার দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (অনার্স) ও এমএ (দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ) এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে ‘এমফিল’ করি। এমফিলে আমার থিথিসের বিষয় ছিলো ‘বাংলায় ইসলামী বিশ্বকোষ সংকলন ও ইসলামী চিন্তা-চেতনা সম্প্রসারণে মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী রহ.-এর অবদান’। বর্তমানে আমি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ায় পিএইচডি করছি। পিএইচডিতে আমার থিথিসের বিষয় হলো ‘আল-মানহাজুন নববি ফি তাজকিয়াতিন নফস: দিরাসা তাহলিলিয়্যাহ’ (তাজকিয়াতুন নফসের নববি পদ্ধতি: একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা)। থিসিসটি আরবি ভাষায়। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ল্যাংগুয়েজ এন্ড প্রি-ইউনিভার্সিটি একাডেমিক ডেভেলপমেন্ট’ থেকে আমি ‘আরবি ও ইংরেজির উপর পৃথক দু’টি ভাষাকোর্স সম্পন্ন করি। একইভাবে আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ায় ‘ওয়ামি’র অধীনে ‘থিথিস লেখা ও গবেষণা পদ্ধতি’র উপর একটি বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করি। এছাড়া ইসলামি ব্যাংকিং, দাওয়াহ, সাহিত্য ইত্যাদির উপর বিভিন্ন কোর্সে অংশ গ্রহণ করেছি।
আওয়ার ইসলাম: আপনার লেখালেখি জীবন কিভাবে শুরু হলো, কোন পত্রিকায় সর্বপ্রথম লেখা ছাপা হলো?
মাওলানা ফারুকী: ছাত্র জীবন থেকেই আমার লেখালেখি শুরু। জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়ায় পড়াশোনার সময় আমার উস্তাজগণের প্রায় সবাই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মাওলানা নোমান আহমদ রহ., মাওলানা মুশতাক আহমদ শরীয়তপুরী, মাওলানা রুহুল আমীন যশোরী রহ., মুফতি মিযানুর রহমান কাসেমী প্রমুখ উস্তাগণ সবাই লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন। কিছুদিন পরপরই তাদের নতুন নতুন বই প্রকাশ পেত। আমরা সেগুলো কিনতাম এবং লেখালেখির অনুপ্রেরণা লাভ করতাম। অনেক উস্তাযের লেখালেখিতে আমি সহায়তা করতাম। কিছু অংশ অনুবাদ করে দেয়া এবং অগোছালো লেখাগুলো নতুন করে গুছিয়ে লিখে দেয়া ইত্যাদি। এভাবে লেখালেখির প্রতি আকর্ষিত হই। তারপর উস্তাজদের পরামর্শে দেয়ালিকার জন্য লেখালিখি। এভাবে লেখালেখি শুরু। আমার সর্বপ্রথম লেখা প্রকাশিত হয় মাসিক রহমানী পয়গামে ‘আদর্শ সমাজ গঠনে মহানবী সা.’ শিরোনামে ১৯৯৬ সালে।
[caption id="attachment_16646" align="aligncenter" width="561"] মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ ও মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভীর সঙ্গে একটি লাইব্রেরিতে মাওলানা ফারুকী[/caption]
আওয়ার ইসলাম: এ পর্যন্ত কতগুলো বই ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আপনার? সম্পাদনা করেছেন কয়টি পত্রিকা?
মাওলানা ফারুকী: বিভিন্ন দৈনিক, মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকা ও জার্নালে সমসাময়িক বিষয়াবলীর ওপর এ যাবত প্রায় শতাধিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি, ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জীবনবোধ সম্পর্কীয় মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে প্রায় ২০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মৌলিক গ্রন্থাবলী’র মধ্যে রয়েছে ০১. ইসলামের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক হামলা: প্রতিরোধের কর্মপন্থা, ০২. একবিংশ শতাব্দীর ইসলামী পুনর্জাগরণ: পথ ও কর্মসূচী, ০৩. তথ্য সন্ত্রাসের কবলে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ : প্রতিরোধের কর্মকৌশল, ০৪. মহানবী সা. যাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে মামলা দায়ের করবেন, ০৫. ছিলাহুল মুসলিম, ০৬. ইসলাম প্রতিষ্ঠায় যুগে যুগে নারীর অবদান।
অনূদিত গ্রন্থাবলী’র মধ্যে ০১. বিশ্বায়ন: সাম্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্র্যাটেজি, ০২. পশ্চিমা মিডিয়ার স্বরূপ, ০৩. ইসলামের দৃষ্টিতে মহানবীর সা. সাহাবীগণ, ৪. কুরআন হাদীসের আলোকে আদর্শ মুসলমান, ০৫. দীনি দাওয়াত: পথ ও পদ্ধতি, ০৬. মুসলিম নারীদের কীর্তিগাঁথা, ০৭. সংক্ষিপ্ত মুনাজাতে মকবূল, ০৮. মাহে রমাযান: অর্জনের এই তো সময়, ০৯. অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রম: একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয, ১০. মাওলানা সাঈদ আহমদ খান রহ.: জীবন ও কর্ম, ১১. মানবতার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করুন, ১২. মানবতার পয়গাম, ১৩. রিসালাতুল ইনসানিয়াহ সম্পর্কে একটি সাক্ষাতকার, ১৪. সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.: দাওয়াত ও চিন্তাধারা।
বিভিন্ন সময়ে আমি তিনটি পত্রিকার সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলাম। সেগুলো হলো মাসিক আর-রাশাদ, মাসিক কুরআনের আলো, মাসিক দেশজগত। এছাড়া অনেকগুলো স্মারক, বুলেটিন ও বই-পুস্তকও সম্পাদনা করেছি। আমি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্পাদনা বোর্ডের একজন সদস্য।
ঘর পুড়েছে বলে দিয়াশলাই উৎপাদন নিষিদ্ধ করা কোনো সুচিন্তার লক্ষণ নয়। আজকের অনৈসলামী দুনিয়া মুসলমানদের চৈতন্য আবেগকে বশীভূত করার জন্য সংস্কৃতির যে দিকগুলো বেছে নিয়েছে যেমন- রেডিও, টিভি, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে নয়, বরং সেগুলোকে পুরোপুরি আয়ত্ত করে, সেখান থেকে ইসলাম বিরোধীদের হটিয়ে দিয়ে সেগুলোকে ইসলামের এবং মানব কল্যাণের কাজে লাগানো তথা ইসলামের সুস্থ্য সুন্দর সংস্কৃতির প্রচার প্রসারে আরো বেশি মনোযোগী হওয়াই হবে মুসলমানদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ।
আওয়ার ইসলাম: আপনার লেখালেখি জীবনের অনন্য কৃতিত্ব হলো ‘বিশ্বায়ন : সাম্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্র্যাটেজি’ এবং ‘পশ্চিমা মিডিয়ার স্বরূপ’ নামক যুগান্তকারী দুটি বইয়ের অনুবাদ, যা আপনি একেবারে কর্মজীবনের সূচনায় অনুবাদ করেছেন, খালেস কওমি মাদরাসার ছাত্র হয়ে এত অল্প বয়সে কিভাবে আপনি এই বিষয়বস্তু আত্বস্থ করতে পারলেন?
মাওলানা ফারুকী: আসলে আমি ছাত্রজীবন থেকেই চোখ কান খোলা রাখার চেষ্টা করেছি। যেসব মহামনীষীর সান্নিধ্য লাভ করেছি তারা সবাই চোখ কান খোলা ওয়ালা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাদের কাছ থেকেই বিশ্ব সম্পর্কে জানার প্রেরণা লাভ করেছি। চলমান পৃথিবীর গতি প্রকৃতি না জানলে এই সমাজে পরিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচার করা সম্ভব নয়। তাই দাঈর জন্য দাওয়াতের স্বার্থেই চলমান সমাজের গতি প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগিত লাভ করতে হবে। একজন দাঈ হিসেবে আমি ছাত্র জীবনেই এসব বিষয় অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছি। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর ‘মাযা খাসিরাল আলাম বিন হিতাতিল মুসলিমীন’-(মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো?) গ্রন্থটি আমার চোখ খুলে দিয়েছে। যাইহোক, বই দুটি সময়ের প্রেক্ষাপটে অতীব প্রয়োজনীয়। একুশ শতকে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংস করার পশ্চিমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘মিডিয়া’। ক্রুসেডের পতাকাবাহক এবং যায়নবাদের মুখপত্র ইউরোপ ও আমেরিকা জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, জবরদখল, সাম্রাজ্যবাদ ও অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে মূলনীতি একুশ শতকে বিশ্ববাসী ও মানবতার সামনে পেশ করেছে তা হলো, ‘বিশ্বায়ন ও নতুন বিশ্বব্যবস্থা’। এই ‘বিশ্বায়ন’ একটি বিশ্বপ্লাবী আদর্শ ও মতবাদ এবং ‘মিডিয়া’ সেটা বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় শক্তি। পৃথিবীর বুক থেকে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে নির্মূল করার জন্য যুগে যুগে বহু ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছে, কিন্তু বিশ শতকের শেষ দশকে ‘বিশ্বায়ন’ নামে যে ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছে, তা এতই ভয়ানক ও সর্বগ্রাসী হয় যে, এর লক্ষ্য শুধু ইসলাম ও ইসলামী উম্মাহ-ই নয়, বরং গোটা মানবতাই তার টার্গেট। মানবতাকে পরাধীনতার শৃঙ্ঘলে আবদ্ধ করা এবং বিশ্বের তাবৎ সভ্যতা-সংস্কৃতিকে নির্মূল করে একক জীবন ব্যবস্থা হিসেবে পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থাকে বিশ্ববাসীর উপর চাপিয়ে দেওয়াই এর মূল লক্ষ্য। এর মৌলিক উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী ইসলামের পুনর্জাগরণ আন্দোলনকে নির্মূল করা, ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ক্ষেত্র ও পরিবেশ তৈরি করা এবং বিশেষভাবে মুসলিম বিশ্ব ও অন্যান্য বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা ও তার ওপর ইজারাদারী প্রতিষ্ঠা করা। এটি ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে একটি সুসংগঠিত, সুবিন্যস্ত ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য এত বড় ষড়যন্ত্র ইতোপূর্বে আর কখনো রচিত হয়নি। বিশ্বায়ন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে সরাসরি আগ্রাসন। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এ আগ্রাসন সর্বগ্রাসী। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নের আড়ালে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে কী কী ষড়যন্ত্র হাতে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তা সবারই জানা দরকার। আর তা হলো
০১. মুসলমানদের দীনি আকিদা-বিশ্বাসের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করে দেয়া, যাতে মুসলিম উম্মাহ তাদের দীন-ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধর্মনিরপেক্ষবাদী হয়ে যায় এবং ধর্মের আশ্রয় নিতে না পারে। কারণ ধর্মই মুসলমানদের শক্তির উৎস।
০২. পশ্চিমা বস্তুবাদ, জড়বাদ ও ধর্মহীন চিন্তা-চেতনাকে অধিকতর বিকাশ ও বিস্তৃত করা, যাতে ভূ-পৃষ্ঠে এমন কোনো লোক বাকি না থাকে, যার মস্তিষ্কে পশ্চিমা নীতির বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন ও অভিযোগ খাড়া করার চিন্তা-প্রয়াস চলতে পারে এবং কারও মুখ দিয়ে জায়নবাদী ও তার মদদদাতা খৃস্টবাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে কোনো শব্দ বের হতে পারে।
০৩. মুসলিম উম্মাহর পবিত্র স্থানগুলোকে পশ্চিমা শক্তির প্রভাবাধীন নিয়ে আসা, যাতে মুসলিম উম্মাহর কাছে প্রেরণার কোনো উৎসকেন্দ্র অবশিষ্ট না থাকে।
০৪. প্রতিটি দেশে ইসলামি আকিদা-বিশ্বাসের স্থলে বস্তুবাদী দর্শনকে চাপিয়ে দেয়া, যাতে মুসলিম উম্মাহ ইসলামি আকিদা-বিশ্বাস থেকে আলো গ্রহণ করতে না পারে।
০৫. ইসলামকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করা এবং তার স্থলে পশ্চিমা মূল্যবোধের আলোকে প্রতিষ্ঠিত সেক্যুলার দর্শনের ওপর সরকার গঠন করা।
০৬. ইসলামি বিশ্বের শক্তিশালী নেতৃত্বকে সরিয়ে দুর্বল ও অযোগ্য নেতৃত্বকে ক্ষমতার মসনদে বসানো এবং মার্কিন স্বার্থের পক্ষে কর্মরত সকল নেতৃত্বকে শক্তিশালী ও রক্ষা করা।
০৭. আঞ্চলিক ক্ষমতাকে দুর্বল করা, তার প্রভাব-প্রতিপত্তিকে খর্ব করা কিংবা শেকড় থেকেই তাকে নির্মূল করে দেয়া এবং জনগণের হৃদয় হতে তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সম্পূর্ণ মিটিয়ে দেয়া।
০৮. ইসলামি শরিয়াহ, ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুন এবং ইসলামি আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিক ব্যবস্থাই প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্যের সবচে’ বড় আতঙ্ক। পাশ্চাত্য একথা ভাল করেই জানে, যদি বিশ্বায়নের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে ইসলামকে মূল টার্গেট বানিয়ে তাকে দুর্বল করে দিতে হবে এবং মুসলিম উম্মাহর হৃদয় হতে নির্মূল করে দিতে হবে তাদের দীনি শ্রেষ্ঠত্ববোধ, দীনি চেতনা ও মর্যাদাবোধ। যাতে মুসলিম ক্ষমতা ধ্বংসের পাশ্চাত্যের লালিত স্বপ্ন পূরণ হতে পারে এবং বিশ্বের কোণায় কোণায় তাদের শাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
০৯. অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্থানীয় সরকারের শক্তি ও কর্তৃত্ব খতম করে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ওপর মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা।
১০. গোটা বিশ্বে একই ধরনের ভোগবাদীব্যবস্থা, কৃষ্টি-কালচার ও একই প্রকারের সভ্যতা-সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া এবং ভূ-পৃষ্ঠে বসবাসকারী লোকদের স্যাটেলাইট, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে জুড়ে দেয়া, যাতে একটি বিশেষ জাতি-গোষ্ঠী যখন ইচ্ছা তার চিন্তাধারা, কৃষ্টি-কালচার ও দৃষ্টিভঙ্গি এ সমস্ত যন্ত্রের মাধ্যমে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলশ্রুতিতে প্রতিটি জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ পৃথক পৃথক না হয়ে যাতে এক ও অভিন্ন হয়ে যায়। পুরো বিশ্বের চিন্তা-চেতনা যাতে এভাবে এক ও অভিন্ন হয়ে যায়। লোকদের গবেষণা ও চিন্তা-মনন একই ধারায় আবর্তিত হয়। তাদের ইচ্ছা, কামনা-বাসনা, চাহিদা, আচার-আচরণ, কথাবার্তার আদব ও ওঠা-বসা সব কিছুই যেন এক, অভিন্ন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর গোটা বিশ্বের সেই অভিন্ন সভ্যতা-সংস্কৃতি হবে আল্লাহ বিমুখ পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার, চিন্তা, ধ্যান-ধারণা এবং তাদের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। এটাই হবে গোটা বিশ্বের একক ও যৌথ সভ্যতা-সংস্কৃতি। অন্য কোনো জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি সেখানে বরদাশত করা হবে না। তাদের বর্তমান মানসিকতা হলো, এই একক ও অভিন্ন সভ্যতা-সংস্কৃতি বিশ্ববাসী সহজে গ্রহণ করলেতো ভালই, না হয় এটা বাস্তবায়ন করতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতেও কুণ্ঠাবোধ করা হবে না।
আজ প্রতিটি মুসলিম দেশে এমন কিছু সংগঠন-সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে, যারা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে ইসলামি শরিয়তের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত। এসব সংগঠন-সংস্থার প্রতি চিন্তা-চেতনা ও বস্তুগত দিক দিয়ে সরাসরি পাশ্চাত্যের সমর্থন রয়েছে। এসব সংগঠন-সংস্থার উদ্দেশ্য ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুনের বিরুদ্ধাচারণ করা এবং ইসলামি আইন-কানুনের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছাড়ানো এবং এর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে দেয়া। সবচে বিপজ্জনক কথা হলো, বিশ্বায়নের নেতৃবর্গ সরাসরি ইসলামের পরিচায়ক বিষয়াবলী, ইসলামি মূলনীতি ও মূলবোধ্যের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। তারা ইসলামের সর্বজন স্বীকৃত আকিদা-বিশ্বাসের অস্তিত্বকে নির্মূল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করছে, যাতে ভূ-পৃষ্ঠে ইসলামের অনুসারী বলতে কেউ না থাকে। এক কথায় বিশ্বায়ন ও গ্লোবালাইজেশন পাশ্চাত্যের কোনো দর্শন নয়, বরং বিশ্বব্যাপী ইসলামি রেনেসাঁ ও পূনর্জাগরণ আন্দোলনকে প্রতিহত করার একটি হাতিয়ার, যাকে প্রোপাগা-া ও প্রতারণার মাধ্যমে একটি দর্শন ও আইন হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করা হচ্ছে।
যাইহোক, ‘বিশ্বায়ন : সাম্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্যাটেজি’ ও ‘পশ্চিমা মিডিয়ার স্বরূপ’ গ্রন্থদ্বয়ে একুশ শতকের সবচেয়ে বড় ফিতনা ‘বিশ্বায়ন ও মিডিয়া’ সম্পর্কে জাতিকে সাবধান করা হয়েছে এবং এর মোকাবেলায় ওলামায়ে কিরামকে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
[caption id="attachment_16647" align="aligncenter" width="579"] ইন্দোনেশিয়ায় আন্তর্জাতিক ফিকাহ বিষয়ক সেমিনারে অতিথিদের সঙ্গে[/caption]
আওয়ার ইসলাম : শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি আপনি সমাজ সেবায় বেশ অগ্রসর, এ চেতনা আপনি কিভাবে পেলেন এবং এ পর্যন্ত কী কী সেবাধর্মী কাজ করেছেন?
মাওলানা ফারুকী : সমাজ সেবায় আমি অগ্রসর কি না বলতে পারব না। তবে ইদানিং অনেক আলেমকে দেখি তারা সামাজিক ময়দানে বেশ কাজ করছেন। এগুলো দেখে খুব ভালো লাগে এবং অনুপ্রাণিত হই। সমাজ ও মানুষের সেবা আমাদের পুর্বসূরীদের মিশন ছিলো। সে মিশন আমরা ভুলে গেছি। ফলে আমরা আজ সমাজের মানুষের কাছে লাঞ্চিত। সমাজ ও মানব সেবার এ চেতনা আমি প্রথমত আমার আব্বার কাছ থেকে লাভ করেছি। তিনি অত্যন্ত পরোপকারী মানুষ ছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষ হয়েও সমাজের গরিব-দু:খী মানুষদের নিয়ে ভাবতেন। সুযোগ পেলেই তাদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বিশেষ করে আলেম ও তালিবে ইলমদের খুব ভালোবাসতেন। বহু আলেম ও তালিবে ইলমকে তিনি অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন। মানুষকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। তার এই চেতনা ছোটকাল থেকেই আমি লাভ করেছি। এরপর শিক্ষা জীবনে জগদ্বিখ্যাত বহু মনীষীর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছে। তাদের কাছ থেকেও আমি এই প্রেরণা লাভ করেছি। তাছাড়া মানবতার সেবা ইসলামের একটি আলোকোজ্জ্বল দিক। হযরত খাদিজা রা. রাসূলূল্লাহ সা. সম্পর্কে বলেছেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সা.! আল্লাহ আপনাকে কখনোই লাঞ্চিত করবেন না। কারণ আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখেন, সদা সত্য কথা বলেন, সমাজের গরিব-দু:খী মানুষের বোঝা বহন করেন, অথিতিদের সেবা করেন এবং দুর্যোগকবলিত মানুষের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন।’ রাসূলুল্লাহ সা. এর এই আদর্শ আমাকে এ পথে আরো অনুপ্রাণিত করেছে। তাই আমি শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি সমাজ ও মানবতার সেবাকেও নিজের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছি। বেশি কিছু এ পর্যন্ত আমি করতে পারিনি। তবে লেগে আছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি। গ্রামীণ অঞ্চলে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করি, সাধ্যানুযায়ী গরিব-দু:খী মানুষের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া, এতিম ও গরিব তালিবে ইলমদের শিক্ষা সহায়তা, গ্রামের গরিব মানুষদের টিউবওয়েল, কুরবানির সময় কুরবানির পশু বিতরণ করা, রমজানে গরিবদের মাঝে সাধ্যানুযায়ী ইফতারি বিতরণ, বন্যার সময় ত্রাণ, কুষ্টিয়ায় আমার নিজ বাড়িতে এক একর জায়গার উপর একটি মসজিদ-মাদরাসা কমপ্লেক্স করেছি, পৃথকভাবে দুই বিঘা জায়গার উপর একটি মহিলা মাদরাসার কাজ চলছে এবং একটি হাসপাতালের প্রস্তুতি চলছে। এভাবে আমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আলেমদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের একটা ধারণা হলো তারা নিতে জানে দিতে জানে না। এই ধারণা কিভাবে পাল্টানো যায় সব সময় আমার মধ্যে এই চিন্তা কাজ করে।
আজ প্রতিটি মুসলিম দেশে এমন কিছু সংগঠন-সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে, যারা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে ইসলামি শরিয়তের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত। এসব সংগঠন-সংস্থার প্রতি চিন্তা-চেতনা ও বস্তুগত দিক দিয়ে সরাসরি পাশ্চাত্যের সমর্থন রয়েছে। এসব সংগঠন-সংস্থার উদ্দেশ্য ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুনের বিরুদ্ধাচারণ করা এবং ইসলামি আইন-কানুনের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছাড়ানো
আওয়ার ইসলাম : অনেক আলেমের মধ্যে তৃণমূলের সেবার বিষয়টি থাকে না। থাকে না কেন এবং আপনার ভেতর কিভাবে এলো?
মাওলানা ফারুকী : আসলে যে কোনো কাজ করার জন্য চেতনার প্রয়োজন। আর চেতনা লাভ হয় চেতনাওয়ালাদের কাছ থেকে। যারা দেশ, জাতি ও উম্মাহ নিয়ে ভাবেন তাদের সান্নিধ্যের মাধ্যমেই উম্মাহর জন্য কিছু করার চেতনাসৃষ্টি হয়। আমি এমন কিছু ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য লাভ করেছি যারা দেশ, জাতি ও উম্মাহকে নিয়ে ভাবেন। আমি দারুল উলূম দেওবন্দে অনেক উস্তাযকে দেখেছি যাঁরা দারস-তাদরিসের বাইরে তৃণমূল জনগণকে নিয়ে ভাবেন। আমি তাদের সান্নিধ্যে গিয়েছি। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিুজল হক রহ. এর দীর্ঘ ১১ বছর সোহবত লাভ করেছি। তিনি তৃণমূল উম্মাহকে নিয়ে সারাজীবন ভেবেছেন। আমার শায়খ ও মুরশিদ দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার রেক্টর মুরশিদুল উম্মাহ সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে’ হাসানী নদভী হাফিযাহুল্লাহ সব সময় তৃণমূল উম্মাহকে নিয়ে ভাবেন। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. তৃণমূল উম্মাহর চিন্তায় সব সময় অস্থির থাকতেন। উস্তাযে মুহতারাম সাইয়েদ সালমান হুসাইনী নদভী এবং মাদরাসা দারুর রাশাদের প্রিন্সিপাল আমার মুরব্বী মাওলানা মুহাম্মদ সালমান তৃণমূল মানুষকে নিয়ে ভাবেন। এসব মহামনীষীর সোহবত ও সান্নিধ্যে থেকে আমি তৃণমূল মানুষ নিয়ে ভাবার চেতনা পেয়েছি। আর মনে রাখতে হবে, তৃণমূলের পরিবর্তন ছাড়া ইসলামের বিজয় সম্ভব নয়। শুধু মাদরাসার চার দেয়ালের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ থাকলে কিয়ামত পর্যন্তও সমাজের পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই আলেমদের তৃণমূল জনগণের চিন্তা বেশি বেশি করা উচিত।
আওয়ার ইসলাম : আপনি কওমি মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন আবার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার একজন পিএইচডি গবেষক। আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কওমি মাদরাসা শিক্ষায় কোনো সংস্কারের প্রয়োজন আছে কিনা?
মাওলানা ফারুকী : ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই প্রাগৈতিহাসিক, ইসলামিক, বৃটিশ ও পাক আমলে ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় মূল বিষয়াদী অক্ষুন্ন রেখে সময়ের চাহিদানুসারে যথেষ্ট পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এটা একটা খুবই স্বাভাবিক চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান প্রেক্ষাপট আর দেড়শ’ বছর আগের প্রেক্ষাপট এক নয়। কুরআন হাদীসের মৌলিক বিষয়াবলী সব যুগেই এক ছিলো তাতে পরিবর্তন ও সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই। পরিবর্তন ও সংস্কার শুধু ইসলামি জ্ঞানবিদ্যা মানব জীবনের বৈষয়িক দিকগুলোতে প্রয়োগ করার জন্য এবং সমকালীন সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবেশের গতির সাথে ইসলামের প্রায়োগিকতা প্রমাণের মতো প্রয়োজনীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে। বর্তমান কওমি শিক্ষায় মানবীয় জ্ঞানসমূহ এবং স্থানীয় ও সমকালীন আন্তর্জাতিক ভাষা নেই। অথচ আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের সব বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে নতুন কাঠামো অনুযায়ী। সেখানে কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে সামগ্রিক উন্নতির ক্ষেত্রে জাতি এসব মেধাবী সন্তানের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এজন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ইসলামি শিক্ষার এ ঐতিহ্যবাহী ধারার সাথে আধুনিক জাগতিক জ্ঞান বিদ্যার সমন্বয় সাধন করা এবং শিক্ষার্থীদের কুরআন-সুন্নাহর গভীর জ্ঞানের পাশাপাশি প্রচলিত বিষয়সমূহেও উপযুক্ত করে তোলা, যাতে তারা রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রেই কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন।
দ্বিতীয়ত: কওমি মাদরাসার নি¤œস্তরের সিলেবাসে বেশ পরিবর্তন এবং উচ্চস্তরের সিলেবাসে বিন্যাস প্রয়োজন। নি¤œস্তরের সিলেবাসের উদ্দেশ্য উচ্চস্তরের বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে পারা। কওমী মাদরাসার উচ্চস্তরের বিষয়গুলো আরবী ভাষায় প্রণীত হলেও নি¤œস্তরের বুনিয়াদী কিতাবগুলো উর্দূ-ফার্সিতে হওয়া এবং নিম্নস্তরে আরবির প্রতি গুরুত্ব না দেয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা মৌলিক ও বুনিয়াদী যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। ফলে কুরআন-সুন্নাহ ও তার ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থাদি এবং আধুনিক আরবি ভাষায় রচিত কিতাবাদি থেকে সরাসরি উপকৃত হতে শিক্ষার্থীদের বেগ পেতে হয়। এজন্য নিম্নস্তরে আরবির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এবং বেসিক ইংলিশ বাধ্যতামূলক করা উচিত। আরবি সাহিত্যের যেসব কিতাবাদি পড়ানো হয় তা পুরাতন আমলের। তখনকার সাহিত্য আর এখনকার সাহিত্যে বিরাট পার্থক্য আছে। আরবি সাহিত্যের পুরাতন গ্রন্থগুলোর জায়গায় নতুন গ্রন্থ সংযোজন করা। এ ক্ষেত্রে আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. রচিত আরবি সাহিত্যের গ্রন্থগুলোকে গ্রহণ করা করা যেতে পারে।
বর্তমান কওমি শিক্ষায় মানবীয় জ্ঞানসমূহ এবং স্থানীয় ও সমকালীন আন্তর্জাতিক ভাষা নেই। অথচ আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের সব বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে নতুন কাঠামো অনুযায়ী। সেখানে কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে সামগ্রিক উন্নতির ক্ষেত্রে জাতি এসব মেধাবী সন্তানের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
শিক্ষাদানের জন্য দক্ষ ও চরিত্রবান শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। মাদরাসাগুলোতে খোঁজ-খবর নিলে দেখা যায়, অনেক জায়গায় এমন শিক্ষক দরস দেন যিনি নিজেই ওই কিতাব বুঝেন না। ছাত্রদের সাথে আচরণবিধিও তার জানা নেই। ছাত্রদের সাথে এমন আচরণ করেন, যা দেখে একটা ভদ্র ফ্যামিলীর ছেলে লজ্জা পায়। মানুষের সাথে তার কথাবার্তা ও আচার-আচরণ অসামাজিক। এজন্য কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের জন্য বিএড কোর্স বা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স থাকা জরুরি। এই কোর্স করা ছাড়া কাউকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া তালিমের পাশাপাশি তারবিয়তের খুব বেশি প্রয়োজন। শুধু তালিম যথেষ্ট নয়, তারবিয়াত আরো বেশি প্রয়োজন। ইসলামি নৈতকতা ও সামাজিকতার বাস্তব প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। ব্যঙের ছাতার মতো অলিতে গলিতে এতো ফতোয়া বিভাগ না খুলে মাদরাসাগুলোতে মানসম্পন্ন ‘গবেষণা সেন্টার’ খোলা আবশ্যক অথবা ফতোয়া বিভাগগুলোকে গবেষণাগারে পরিণত করা, যেখানে সমকালীন বিষয়াবলীর উপর গবেষণা করানো হবে। মাকাসিদুশ শরীআহ, মুকারানাতুল আদইয়ান বা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ইসলাম ও বিজ্ঞান, ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং, ইসলামি দাওয়াতের ইতিহাস, মূলনীতি ও আধুনিক প্রেক্ষাপট, ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক প্রচলিত চিন্তাধারাসমূহ, সমকালীন মুসলিম দাঈগণ ও তাঁদের দাওয়াত পদ্ধতি, দাওয়াহ ও মিডিয়া, ইস্তিশরাক ও প্রাচ্যতত্ত্ববিদ্যা, আল-গাযবুল ফিকরি বা ইসলামের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন, বিশ্বায়ন ও নতুন বিশ্বব্যবস্থা, গবেষণা পদ্ধতি, ভাষা-সাহিত্য, ইংরেজি ও কম্পিউটার ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন সচেতন আলেমের জন্য এসব জ্ঞান অপরিহার্য।
আওয়ার ইসলাম : আপনি বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন, কোন দেশে ইসলাম সবচেয়ে নিরাপদ ও মজবুত দেখেছেন?
মাওলানা ফারুকী: আল্লাহ পাক এ পর্যন্ত আমাকে বিভিন্ন দেশে ঘুরার সুযোগ করে দিয়েছেন। ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্পোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশ ঘুরার সুযোগ আমার হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে কোনো দেশেই ইসলাম নিরাপদ ও মজুবত নেই। সব দেশেই ইসলাম ও মুসলমানরা বিপদের সম্মুখিন। গোটা বিশ্বেই আজ ইসলাম ও মুসলমানরা বিপদের সম্মুখিন। প্রতিটি দেশেই মুসলমানরা ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার। আর এসব দেশের কোনটিতেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত নেই। আমার মনে হয় তুলনামূলক সৌদি আরবে কিছুটা রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত আছে। তাছাড়া আর কোথাও নেই। অন্য্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মুসলমানরা বেশ নিরাপদ।
আওয়ার ইসলাম: আপনার সারাদিন কিভাবে কাটে? প্রিয় কাজ কী?
মাওলানা ফারুকী: আমার সারাটা দিন কাটে ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে। আমি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্য্যালয়ে গবেষণারত আছি। তাই গবেষণা ও লেখাপড়ার কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। পাশাপাশি টিচিংও দেই। তাছাড়া নিজের দেশে অনেকগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক কাজের সাথে জড়িত আছি। দারুল উলূম সাবীলুর রাশাদ কুষ্টিয়া, দারুত তারবিয়াহ মহিলা মাদরাসা কুষ্টিয়া, রিসালাতুল ইনসানিয়াহ বাংলাদেশ, কুষ্টিয়া উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ-খবর প্রতিদিনই নিতে হয়। এক কথায় মালয়েশিয়ায় বসে এ প্রতিষ্ঠানগুলো আমাকে নিয়মিত পরিচালনা করতে হয়। ছোটখাটো বিষয়গুলোও আমাকে দেখতে হয়। সব ফোনে ফোনেই করি। বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু জনসেবার কাজ চলছে, সেগুলো মনিটরিং করতে হয়। এভাবে সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে দিন যায়। সকালে সালাত, তিলাওয়াত, ওয়াজিফা ও অল্পস্বল্প লেখাপড়া করি আর রাতে লেখালেখি ও গবেষণার কাজ করি। ফাঁকে ফাঁকে ছেলেদের লেখাপড়ার কাজে সহযোগিতা করি। যদিও ছেলেদের লেখাপড়াসহ সার্বিক বিষয় ওদের আম্মুই সামাল দেয়। আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো লেখালেখি, গবেষণা ও মানবতার সেবা।
আওয়ার ইসলাম: কোন বইটি পড়ে ভালো লেগেছে এবং মানুষকে অবশ্যই পড়তে বলবেন?
মাওলানা ফারুকী: জীবনে কত বই যে পড়েছি তার হিসাব রাখা সম্ভব হয়নি। বই পড়া আমার নেশা। কোথাও গেলে আগে সেখানে বইপত্র আছে কিনা তা দেখি। কোথাও বইপুস্তকের স্তুপ নজরে পড়লে আর সামনে বাড়তে পারি না ওইগুলো একজন দেখা ছাড়া। দারুল উলূম দেওবন্দের সুবিশাল লাইব্রেরি, দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার আল্লামা শিবলী নোমানী লাইব্রেরি, আলীগড় ইউনিভার্সিটির মাওলানা আযাদ লাইব্রেরি, জামিয়া মিল্লিয়া দিল্লীর ড. জাকির হোসেন লাইব্রেরি, মক্কার হেরেম শরিফের লাইব্রেরি, মসজিদে নববির লাইব্রেরি, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ব বিদ্যালয়ের দারুল হিকমাহ লাইব্রেরি ইত্যাদিতে বছরের পর বছর, মাসের পর মাস, সপ্তাহের পর সপ্তাহ এবং দিনের পর দিন কাটিয়েছি কিতাবের ভেতর। অনেক সময় খাওয়া দাওয়ার কথাও মনে থাকেনি। দিন শেষ হয়ে গেছে। এক কথায় পড়া, লাইব্রেরি ওয়ার্ক ও গবেষণা করা আমার নেশা। মুসলমানদের শিক্ষিত শ্রেণীর জন্য আমি বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর বইগুলো এবং সাধারণ শ্রেণীর জন্য হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর রচনাবলী পড়ার পরামর্শ দিবো।
আমি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্য্যালয়ে গবেষণারত আছি। তাই গবেষণা ও লেখাপড়ার কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। পাশাপাশি টিচিংও দেই। তাছাড়া নিজের দেশে অনেকগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক কাজের সাথে জড়িত আছি। দারুল উলূম সাবীলুর রাশাদ কুষ্টিয়া, দারুত তারবিয়াহ মহিলা মাদরাসা কুষ্টিয়া, রিসালাতুল ইনসানিয়াহ বাংলাদেশ, কুষ্টিয়া উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ-খবর প্রতিদিনই নিতে হয়। এক কথায় মালয়েশিয়ায় বসে এ প্রতিষ্ঠানগুলো আমাকে নিয়মিত পরিচালনা করতে হয়। ছোটখাটো বিষয়গুলোও আমাকে দেখতে হয়। সব ফোনে ফোনেই করি। বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু জনসেবার কাজ চলছে, সেগুলো মনিটরিং করতে হয়। এভাবে সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে দিন যায়।
আওয়ার ইসলাম: কওমী মাদরাসার স্বীকৃতির দাবি উঠেছে আবারো, আপনি কি এ দাবি সমর্থন করেন?
মাওলানা ফারুকী: কওমি মাদরাসার স্বীকৃতির দাবিকে আমি শুধু সমর্থনই করি না, বরং মনে করি এটা আমাদের অধিকার। লাখ লাখ মানুষ কওমি মাদরাসায় পড়ছে কিন্তু তারা রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষিত হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। তাই অবশ্যই কওমি মাদরাসা শিক্ষার স্বীকৃতি দিতে হবে। তবে আমি কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে স্বীকৃতির পক্ষে। কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে কোনো স্বীকৃতির পক্ষে আমি নই এবং উলামায়ে কিরামও গ্রহণ করবেন না। দীর্ঘ দেড়শ’ বছর ধরে দেওবন্দ মাদরাসার পদাংক অনুসরণ করে কওমি মাদরাসাসমূহ দেশ ও জাতির কল্যাণে সহিহ দীনি ইলমের যে খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে-তারা ভবিষ্যতেও দেওবন্দ মাদরাসার উসূল অনুসারেই চলবে ইনশাআল্লাহ। সরকারের কোনো ধরনের দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক সম্পৃক্ততা ছাড়া দেওবন্দ মাদরাসার শিক্ষা সনদকে যেভাবে ভারত মান দিয়েছে, যেভাবে পাকিস্তানে কওমি মাদরাসার সনদকে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক সকল ক্ষেত্রে স্বীকৃতি ও মান প্রদান করা হয়েছে, সেভাবে যদি আমাদের দেশেও সরকারের সাথে কোনো দাপ্তরিক ও সাচিবিক সম্পর্ক ছাড়াই শতভাগ নিয়ন্ত্রণমুক্তভাবে কওমি মাদরাসার শিক্ষা সনদের মান প্রদান করা হয় তাহলে আমরা তা গ্রহণ করবো। অন্যথায় স্বীকৃতির নামে কোনো ফাঁদে উলামায়ে কিরামের পা দেয়া উচিত হবে না। কারণ সরকার যেভাবে আইন তৈরি করে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে, তাতে সরকার আমাদেরকে একটি আইনী কাঠামোর মধ্যে বেঁধে দিতে চাচ্ছে। সরকার যদি আইন করে স্বীকৃতি দেয় এবং নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রাখে তাহলে দু’ চার পাঁচ বছরে হয়তো সরকার কিছু করবে না, কিন্তু এক সময় এই আইন পরিবর্তন করবে এবং সংশোধন করবে। ধীরে ধীরে কওমী মাদরাসা নিউ স্কিম ও আলিয়া মাদরাসার ভাগ্য বরণ করবে। তাই সরকারি কাঠামোর মধ্যে কোনোভাবেই স্বীকৃতি নেয়া যাবে না। স্বীকৃতি হতে হবে দারুল উলূম দেওবন্দের আদলে তথা সরকারের সাথে কোনো প্রকার দাপ্তরিক ও সাচিবিক সম্পর্ক ছাড়া। সরকার শুধু শিক্ষা ও সনদের মান দিবে। যাতে কওমীর ছাত্ররা ইচ্ছা করলে সাধারণ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে।
[caption id="attachment_16648" align="aligncenter" width="573"] কুষ্টিয়ায় নিজ এলাকার সাধারণ মানুষদের সঙ্গে[/caption]
আওয়ার ইসলাম: আপনি আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. প্রতিষ্ঠিত ‘রিসালাতুল ইনসানিয়াহ বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের আমীর। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বলুন?
মাওলানা ফারুকী: অস্থির এই সময়ে পৃথিবীজুড়ে বাহ্যিক উপায়-উপকরণের কোনো কমতি নেই। সভ্যতার চোখ ধাঁধাঁনো উন্নতি আমাদের কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। এক সময় মানুষ যা চিন্তা করারও সাহস করেনি এখন এর অনেক কিছুই বাস্তব। সভ্যতার উৎকর্ষের গতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু তবুও পৃথিবীতে কিসের যেন অভাব। একটি অপূর্ণতা কুরে কুরে খাচ্ছে মানবসভ্যতাকে। এগিয়ে যাওয়ার সব সরঞ্জামই আছে, কিন্তু নেই মানবতাবোধ। বাহ্যিকভাবে মানুষের কোনো কমতি নেই; কিন্তু মনুষ্যত্ববোধের অভাব। আকারে-প্রকারে মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও বাড়ছে না মানবতাবোধ। সবার মধ্যে খাই খাই ভাব। ‘আরও চাই’, ‘আরও চাই’ এর অসম প্রতিযোগিতা। কে কত ভোগ করতে পারে এটাই যেন এখন মানবজন্মের পরম সার্থকতা! সভ্যতার নৈরাজ্যময় এই পরিস্থিতিতে পরের কথা ভাববে; সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার স্লোগানকে ধারণ করবে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ খ্যাত আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. ছিলেন বিরলপ্রজ সেই মানুষদের একজন। জীবনভর মানবতাবাদকে সমুজ্জ্বল করার মহান মিশন নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৭৪ সালে ‘রিসালাতুল ইনসানিয়াহ’ বা ‘মানবতার ডাক’ নামক সংগঠনটির গোড়াপত্তন করেন তিনিই। এটি গতানুগতিক কোনো সংগঠন নয়। পদ-পদবি, নেতৃত্বের টানাপোড়েন আর সস্তা খ্যাতির পেছনে কখনও ছুটেনি এই সংগঠন।
রিসালাতুল ইনসানিয়াহ’র মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের ভেতরে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা, পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসা, ঐক্য ও সংহতি, মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো। আর্ত-মানবতার সেবা, মানবজন্মের প্রকৃত উদ্দেশ্যের সঙ্গে পরিচিত করানো। সামাজিক অসমতা, অঙ্গতি, অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করা। জুলুম ও নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপদাপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো; আর্তের সেবায় এগিয়ে আসা। নতুন প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষাদান, বিপথগামিতা থেকে রক্ষার কৌশল অবলম্বন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা; হিংসা-হানাহানির অবসান।
তিনটি কর্মসূচি সামনে রেখে পরিচালিত হয় রিসালাতুল ইনসানিয়ার কার্যক্রম। প্রথমটি হলো দাওয়াহ। এর আওতায় ঈমানবঞ্চিত মানুষদের কাছে ঈমানের দাওয়াত পৌঁছানো; ইসলামবিচ্যুত মানুষদের ইসলামে ফিরিয়ে আনা; মুসলমানদের মধ্যে সংস্কারমূলক কার্যক্রম পরিচালনা; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঈমান-আকিদা সংরক্ষণে কুরআনি মকতব ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা; নতুন প্রজন্মের মধ্যে দীনি চেতনা জাগ্রতকরণের কাজ আঞ্জাম দেয়া হয়। দ্বিতীয়টি হলো তাযকিয়া। এর মাধ্যমে মুসলমানদের আমল-আখলাক বিশুদ্ধকরণ; উন্নত চরিত্র ও নৈতিকতায় বলিষ্ঠ করতে বিভিন্ন কর্মসূচি এবং নগ্নতা ও অবক্ষয়ের রোধে কার্যকরী পদক্ষেপমূলক কাজ আঞ্জাম দেয়া হয়। তৃতীয়টি হলো খিদমাহ। এর আওতায় সুবিধাবঞ্চিত-অসহায় মানুষদের সহযোগিতা; এতিম প্রতিবন্ধী ও নওমুসলিমদের পুনর্বাসন; গরিব-দুস্থ শিশুদের শিক্ষা সহায়তা এবং যৌতুকমুক্ত বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. প্রতিষ্ঠিত ‘রিসালাতুল ইনসানিয়াহ’ ভারতে বেশ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আল্লামা নদভী রহ.-এর সুযোগ্য উত্তরসূরিরা সংগঠনটি দ্বারা ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। তারা বাংলাদেশে এই সংগঠনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন এ অধমকে। ২০১১ সালে আমরা এদেশে সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করি।
আওয়ার ইসলাম: রিসালাতুল ইনসানিয়াহ বাংলাদেশ এ পর্যন্ত কী কী কাজ করেছে?
মাওলানা ফারুকী: আসলে রিসালাতুল ইনসানিয়াহ যখন থেকে বাংলাদেশে তার কার্যক্রম শুরু করেছেন, তখন থেকেই বাংলাদেশে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। যেই অস্থিরতার মধ্যে মাঠে ময়দানে কাজ করা খুবই কঠিন। তারপরও আমরা বসে থাকেনি। আল্লাহর উপর ভরসা করে মুরব্বীদের দুআ ও পরামর্শ নিয়ে দাওয়াতী কাজ অব্যাহত রেখেছি। অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াতি কাজ, বই-পুস্তক ও লিটারেচার প্রকাশ ও প্রচার, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা,দাওয়াহ প্রশিক্ষণ কর্মশালা, ইসলাহি প্রোগ্রাম ও ব্যাপক জনসেবামূলক কার্যক্রম আমরা আঞ্জাম দিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও রিসালাতুল ইনসানিয়াহ’র কার্যক্রম এখন দৃশ্যমান। সচেতন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা আসতে পেরেছি আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমত এবং মুরব্বীদের দুআ ও পরামর্শে। আপনাদের সহযোগিতাও কম নয়।
আওয়ার ইসলাম: আমাদের মুসলিম সমাজে যেভাবে ধর্মহীনতা ও নাস্তিকতার বিস্তার ঘটছে, তার প্রতিরোধে আপনার দৃষ্টিতে ওলামায়ে কিরামের করণীয় কী?
মাওলানা ফারুকী: এ সম্পর্কে মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. মনে করেন, ‘রাজপথে লড়াই-আন্দোলন এ সমস্যার সমাধান নয়। এর জন্য গণমত ও জনমত তৈরির চিন্তাও সঠিক নয়, জবরদস্তি ও চাপের মাধ্যমে এর সমাধান কোনোদিন হবে না; বরং চাপ প্রয়োগে হিতে বিপরীত হবে। এ ফিতনা আরো চাঙ্গা হবে। নাস্তিকদের অনুসন্ধান করে তাকে দমন করবে- প্রচলিত কোনো আদালত এমন স্বীকৃতি দেয় না; বরং এসব আদালত তো জুলুম ও জবরদস্তির পৃষ্ঠপোষক। এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন কৌশল, দৃঢ়তা ও চরম সহিষ্ণুতা। কিভাবে এই রিদ্দাতুন ফিকরিয়্যাহ’রপথ রুদ্ধ করা যায় এবং ধর্ম বর্জনকারী শ্রেণীকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা যায় তার জন্য প্রয়োজন গভীর চিন্তা-ভাবনা ও প্রচুর অধ্যয়ন। এ অবস্থাকে আমাদের হিম্মত ও দৃঢ়তা, হেকমত ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা মোকাবেলা করতে হবে।
ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এই ‘মানসিক ধর্মান্তর’ থেকে মুসলিম শিক্ষিত শ্রেণিকে রক্ষা করতে হলে সর্বপ্রথম তাদেরকে নবতর ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে। তাদের ভেতর নতুন ঈমানি শক্তি, জীবন্ত ইয়াকিন ও নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। তাদের হৃদয়রাজ্যে ঈমানের বীজ দ্বিতীয়বারের মতো বপন করতে হবে, বপনের প্রয়াস চালাতে হবে, তাদের ধর্মীয় জোশ-জযবা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা পুনরায় সক্রিয় ও গতিশীল করতে হবে এবং প্রাথমিক যুগের ইসলামের দাওয়াতের মূলনীতি ও কর্মপন্থা মুতাবিক মুসলমানদের ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে এবং আল্লাহ, তদীয় রাসূল ও পারলৌকিক জীবনের আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি সমগ্র শক্তি দিয়ে পুনর্বার তাবলীগ ও তালকীন করতে হবে, শেখাতে হবে এবং প্রচার চালাতে হবে। এজন্য সেসব পন্থাই কাজে লাগাতে হবে যেসব পন্থা ইসলামের প্রথম দিককার দাঈগণ গ্রহণ করেছিলেন। অধিকন্তু সেসব উপায়-উপকরণ ও শক্তি কাজে লাগাতে হবে যা বর্তমান যুগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
আজ সময়ের বড় প্রয়োজন মুসলমানদের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ইসলামি চেতনা ও দীনি মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের চেতনাবোধ তৈরি না হবে ততদিন এই বিপদাশংকা থেকেই যায় যে, তারা অন্য কোনো আহবান বা আন্দোলনের হাতিয়ারে পরিণত হবে এবং দেখতে না দেখতেই শত শত বছরের শ্রম ও সাধনাকে ব্যর্থ ও নিষ্ফল করে দেবে। এ সময়ে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো, মুসলিম জাতির শিক্ষিত শ্রেণি ও জনগণের মধ্যে দীনের সঠিক চেতনাবোধ জাগ্রত করা, এমন চেতনা যা কোনো রকমের জুলুম ও বেইনসাফি বরদাশত করে না, ধর্ম ও নৈতিকতার বিকৃতি সহ্য করে না, অপরাধী ও অন্যায়কারী তার অসন্তোষ ও ক্রোধের হাত থেকে বাঁচতে না পারে এবং সে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সমস্যা-সংকট ও বিষয়াদির ক্ষেত্রে একজন বুদ্ধিমান ও পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে এবং ফয়সালা করার সামর্থ্য রাখে। যতদিন এই চেতনাবোধের উন্মেষ না ঘটবে, কোনো মুসলিম দেশ ও জাতির কর্ম-প্রেরণা, কাজের সামর্থ্য ও যোগ্যতা, ধর্মীয় আবেগ ও মাযহাবী জীবনের প্রদর্শনী ও দৃশ্যাবলী খুব বেশি একটা গুরুত্ব বহন করে না।
মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ‘মানসিক ধর্মান্তর’-এর প্রেক্ষাপটে বর্তমানে ওলামায়ে কিরামের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা। শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে নতুন করে ঢেলে সাজানো যা ইসলামের রূহ ও তার পয়গামের সঙ্গে সঙ্গতিশীল হবে। এক সময় মুসলিম বিশ্ব প্রাচীন পৃথিবীর ওপর তার জ্ঞানগত নেতৃত্ব কায়েম করেছিল এবং দুনিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সভ্যতা-সংস্কৃতির অস্থি-মজ্জায় মিশে গিয়েছিল। সে দুনিয়ার সাহিত্য ও দর্শনের হৃৎপিন্ডে তার বাসা বানিয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী সভ্য দুনিয়া তার বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করেছে, তার কলম দিয়ে লিখেছে এবং তারই ভাষায় লেখালেখি করেছে, গ্রন্থ প্রণয়ন করেছে। কিন্তু আজ তারা জ্ঞান-গবেষণা ও শিক্ষার ময়দানের পেছনের সারিতে অবস্থান করছে। তাই ওলামায়ে কিরামকে বর্তমান পৃথিবীতে তার জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হলে একদিকে ওহীর জ্ঞানে পৃথিবীকে আলোকিত করতে হবে, অপরদিকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
চলমান নাস্তিক্যবাদী আগ্রাসন মোকাবিলা করতে হলে ওলামায়ে কিরামের মধ্যে এমন চিন্তাবিদ, গবেষক ও তথ্যানুসন্ধানীর আবির্ভাব হতে হবে, যারা চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-গবেষণা ও লেখার ময়দানে আত্মনির্ভরশীল হবেন এবং এর সাহায্যে পাশ্চাত্য সভ্যতার গোটা ভিত্তিমূলকেই ধ্বসিয়ে দিতে সক্ষম হবেন। এ প্রসঙ্গে আল্ল¬ামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বলেন, ‘বর্তমান সময়ে ওলামায়ে কিরাম ও মুসলিম রিসার্চ স্কলারদের দায়িত্ব হলো, চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-গবেষণা ও লেখার ময়দানে আত্মনির্ভরশীল হওয়া, ইলমী বিষয়ে গবেষণাসমৃদ্ধ প্রামাণ্য গ্রন্থাবলী রচনা করা এবং ইসলামী বিশ্বকে সঠিক নির্ভরযোগ্য জ্ঞান-গবেষণা ও ইসলামের নির্ভেজাল সঠিক পরিকল্পনা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করানো- ওইসব সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্রের প্রতি লক্ষ্য রেখে, যেগুলো ওরিয়েন্টালিস্টদের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য, বরং ইলমী পদ্ধতি, গবেষণার নীতিমালা, গভীর বিশ্লেষণ, সুগভীর দৃষ্টি, ব্যাপক অধ্যয়ন, নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স, তথ্যসূত্র ও শক্তিশালী দলীল-প্রমাণের ক্ষেত্রে তাদের থেকেও অগ্রগামী হওয়া এবং ওইসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ইলমী দূর্বলতাগুলো থেকেও নিরাপদ থাকা, যেসব ক্ষেত্রে সাধারণত ওরিয়েন্টালিস্টরা পদস্খলনের শিকার হয়েছে।
এ যুগ ভাষা-সাহিত্যের যুগ। ভাষা-সাহিত্যের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি ধর্মহীনতা ও নাস্তিকতা মুসলিম মানসে প্রসার লাভ করছে। সুতরাং ওলমায়ে কিরামকে ভাষা-সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে। এ লক্ষ্যে পরিকল্পিত উপায়ে একটি দীর্ঘমেয়াদী ইসলামী সাহিত্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তর্ক দিয়ে যুগের গতিকে বদলানো যাবে না, যুগের জোয়ারের মুখে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব নয়। হয় স্রোতের মুখে ভেসে যেতে হবে, নয়তো পূর্ণ বিক্রমে স্রোতের গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে হবে। পশ্চিমা সাংস্কৃতিক যুদ্ধের শত শত মিসাইল এসে আমাদের বর্তমান বংশধরদের ইসলামী চেতনা বিশ্বাসকে চুরমার করে দিচ্ছে। প্রচার মিডিয়ার সব ক‘টি সেক্টর আজ অরক্ষিত। অথচ স্যাটেলাইট মিডিয়ার প্রযুক্তিকে আলেম সমাজ শয়তানের আস্তানা বলে দূরে ঠেলে রেখেছেন। অর্থাৎ বর্তমান দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে তারা নিজেরাই নিজেদের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ঘর পুড়েছে বলে দিয়াশলাই উৎপাদন নিষিদ্ধ করা কোনো সুচিন্তার লক্ষণ নয়। আজকের অনৈসলামী দুনিয়া মুসলমানদের চৈতন্য আবেগকে বশীভূত করার জন্য সংস্কৃতির যে দিকগুলো বেছে নিয়েছে যেমন- রেডিও, টিভি, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে নয়, বরং সেগুলোকে পুরোপুরি আয়ত্ত করে, সেখান থেকে ইসলাম বিরোধীদের হটিয়ে দিয়ে সেগুলোকে ইসলামের এবং মানব কল্যাণের কাজে লাগানো তথা ইসলামের সুস্থ্য সুন্দর সংস্কৃতির প্রচার প্রসারে আরো বেশি মনোযোগী হওয়াই হবে মুসলমানদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। এর জন্য প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
শত্রু যে পদ্ধতিতে অগ্রসর হবে তার জবাব সে পদ্ধতিতে দেয়াই যুক্তিযুক্ত। শত্রু আজ মিডিয়া ও তথ্য-প্রযুক্তির ছিদ্র পথ দিয়ে দিন দুপুরে আমাদের ঈমান-আকীদার ওপর হামলা চালাচ্ছে। সুতরাং তার জবাবও সেই তথ্য-প্রযুক্তি ও মিডিয়ার পথ ধরেই দিতে হবে। সে লক্ষ্যে আমাদেরকে শক্তিশালী ও কার্যকর ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়া গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রচলিত ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় আমাদের লোকজনদের ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এমনিভাবে ইসলামের ধারক-বাহকদেরকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তিতে শক্তি অর্জন করতে হবে এবং সেগুলো ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
এ মুহূর্তে ইসলামি দুনিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো এক নতুন ইসলামী দাওয়াতের ও মেহনতের। এ দাওয়াত ও মেহনতের শ্লোগান হবে- এসো, আবার নতুন করে ইসলামের ওপর ঈমান আনি, তবে শুধু শ্লোগানই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রথমেই ভাবতে হবে, বুঝতে হবে কোন রাস্তায় ইসলামী দুনিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ও ক্ষমতাবান শ্রেণীর মন-মগজে পৌঁছা যাবে এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনা যাবে। আর এর জন্য প্রয়োজন দাওয়াতী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এসব প্রতিষ্ঠান পাশ্চাত্যের নাস্তিক্যবাদী হামলার ছিদ্রপথগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো প্রতিরোধের কার্যকর পথ বের করবে। ইসলামের ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগের দাঁতভাঙ্গ জবাব দেবে। মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ নিত্য-নতুন সমস্যাসমূহের ইসলামী সমাধান পেশ করবে। পাশ্চাত্যের নাস্তিক্যবাদী হামলা মোকাবেলার জন্য ব্যাপকভাবে দাওয়াতী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা নতুন ইসলামী সভ্যতার জন্ম দেবে। যে সভ্যতা আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীকে ইউরোপীয় জীবনধারার নাগপাশ থেকে ছিনিয়ে পুনরায় ইসলামের দিকে, সার্বজনীন ইসলামী আদর্শের দিকে ফিরিয়ে আনবে। যে সভ্যতা যুবকদের চেতনায় নতুনভাবে ইসলামের বুনিয়াদকে প্রতিষ্ঠিত করবে, তাদের হৃদয় ও আত্মার খোরাক হবে। এ কাজের জন্য ইসলামী দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে এমন দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন যারা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এ লড়াইয়ে ময়দান থেকে পিছু হটবে না।
আওয়ার ইসলাম: আপনি কেমন বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখেন?
মাওলানা ফারুকী: আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই পারি। আমি একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। যেখানে সকল ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম কর্ম পালন করতে পারবে, লেবাস পোশাক নিয়ে চলতে পারবে এবং শিক্ষা দীক্ষা পরিচালনা করতে পারবে। যেখানে থাকবে না কোনো রাজনৈতিক হানাহানি, নৈরাজ্য ও খুনাখুনি। যেখানে একজন গবেষক নিরাপদ পরিবেশে তার গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। যেখানে কোনো ধর্ম সম্পর্কে অবমাননা হবে না। যেখানে মানুষ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না। মানুষ মানুষকে হত্যা করবে না। মানুষ মানুষের ক্ষতি করবে না। যেখানে ইসলামের কল্যাণ ও সাম্যনীতির আলোকে সকলেই কল্যাণ ও অধিকার লাভ করবে।
আওয়ার ইসলাম: আমাদের সময় দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ
মাওলানা ফারুকী: আপনাকেউ অনেক ধন্যবাদ।