শান্তা মারিয়া
হাসপাতালেও রেহাই নেই। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের টয়লেটে এক নারীর ছবি তোলার চেষ্টা করছিল ওই প্রতিষ্ঠানেরই এক কর্মচারী। পাশের টয়লেট থেকে মোবাইল দিয়ে নারীর ছবি ভিডিও করার চেষ্টা করছিল লোকটি। নারীর চিৎকারে আশপাশের লোকজন তাকে ধরে। পরে পর্নোগ্রাফি আইনে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃত কর্মচারী সুমন জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে সে অনেক দিন ধরেই এই কাজ করছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের টয়লেট ব্যবহারকারী নারীদের দৃশ্য সে গোপনে মোবাইলে ধারণ করতো। পরে সেটা ম্যাসেঞ্জারে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতো। কতখানি বিকৃত মানসিকতা হলে এই জঘন্য অপরাধ করা সম্ভব!
এর আগেও বিউটি পার্লার এবং পোশাকের দোকানে গোপনে ক্যামেরা দিয়ে দৃশ্য ধারণের অভিযোগ উঠেছিল। তার মানে সুমন একা নয়। এমন বিকৃত মানসিকতার মানুষ সমাজে আরও অনেক রয়েছে। যারা পর্নোগ্রাফি ধারণ করে বিকৃত আনন্দ পাচ্ছে। পর্নোগ্রাফির ভাইরাস যে কীভাবে ছড়াচ্ছে, তা ভাবলে আতঙ্ক জাগে। যে কোনো অফিসের পিসিতে ব্রাউজ হিস্ট্রি চেক করলে দেখবেন সেখানে কেউ না কেউ পর্নো দেখেছে। স্কুলের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার লোক মোবাইলে এসব দেখছে। কেউ কেউ আবার দেখেও সন্তুষ্ট হচ্ছে না। নিজেরাও ভিডিও তোলার চেষ্টা করছে।
সমাজটার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে পর্নোগ্রাফি নামের এক অতি কুৎসিত নেশায়। যে কোনো স্থানে, যে কোনো জায়গায় অশালীন ছবি তোলার হিড়িক পড়েছে যেন। প্রখ্যাত লেখক নীরোদচন্দ্র চৌধুরী তার ‘বাঙালি জীবনে রমণী’ বইতে লিখেছিলেন প্রথম যখন বাঙালি পুরুষের হাতে ক্যামেরা আসে, বিশেষ করে পাড়ার বখাটে ছেলে-ছোকরার হাতে যখন ক্যামেরা যায়, তখন নারীর ছবি তোলার দিকেই ছিল তাদের মূল ঝোঁক। এই ছবি তোলার মাধ্যমে অনেক নারী হয়রানির শিকার হয়েছেন সে সময়। ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বাঙালির হাতে ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল আসার পর। এবং এখন আর নিছক হয়রানি নয়, এটা পরিণত হয়েছে গুরুতর অপরাধে।
রাস্তাঘাটে, বাসে, হাটে-বাজারে যদি কোনো নারী একটু অসতর্ক থাকেন বা তাদের ওড়না বা আঁচল একটু সরে যায় বা কোনোভাবে তার দেহের কোনো অংশ দেখা যায় -সেটাও মোবাইলে ধারণ করছে এক শ্রেণির বিকৃত রুচির পুরুষ। শুধু তাই নয়, সেই ভিডিও ইন্টারনেটের বিশেষ কতগুলো পর্নোসাইটে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আবার নারীকে ধর্ষণ করার দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করে সেটার মাধ্যমে ভিকটিম ও তার পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করার ঘটনা অহরহ ঘটছে। গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়েছে। প্রযুক্তির প্রসার খুবই ভালো বিষয়। কিন্তু হায়, ‘সার্জারি নাইফ’ দিয়ে আমরা অপারেশন করে মানুষ বাঁচানোর পরিবর্তে খুন করতে শিখেছি আগে। গ্রামে-গঞ্জে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের সুফলটা প্রসারের আগেই এর মাধ্যমে মানুষকে হয়রানি করার শিক্ষা আমরা পেয়ে গেছি। ইন্টারনেটে জ্ঞানের কথা পড়ার আগে আমরা পর্নোগ্রাফি দেখতে ব্যস্ত হয়েছি। ফটোশপের মাধ্যমে নগ্ন ছবির সঙ্গে একজন নিরপরাধ নারীর ছবি যুক্ত করে সেটা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে ভিকটিমকে।
দেশি-বিদেশি যে কোনো ধরনের পর্নোগ্রাফিই সমাজের জন্য চরম ক্ষতিকর। কারণ এতে নারী ও শিশুকে (এবং পুরুষকেও) যৌন বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। মানুষের মর্যাদা এতে ক্ষুণ্ন হয়।
চীনের মতো প্রযুক্তিতে অগ্রসর দেশেও পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ। সেখানে কোনো সার্চইঞ্জিনে পর্নোগ্রাফিক সাইট বা এ ধরনের যৌনগন্ধী কোনো শব্দ খুঁজলেই পেইজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্লক হয়ে যায়। আমাদের দেশে কি সেটা করা সম্ভব নয়? সাইবার অপরাধ আমাদের দেশে ক্রমাগত বাড়ছে। এইসব সাইবার অপরাধের মধ্যে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন অপরাধের মাত্রা অনেক বেশি। এটা যে শুধু আমাদের দেশে ঘটছে তা নয়, বিশ্বজুড়েই এই অশুভ প্রবণতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোতে সমাজ এখনও কোনো নারীর মর্যাদাহানি ঘটলে প্রকারান্তরে তাকেই দায়ী করে। কেউ রেপ ভিকটিম হলে বা কারও অশালীন চিত্র প্রচারিত হলে সমাজে সেই নারীকেই অপরাধী সাব্যস্ত করার একটা পশ্চাৎপদ প্রবণতা দেখা দেয়।
বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশেই গ্রামে-গঞ্জে এখনও ধর্ষণের শিকার নারীকে একঘরে ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি বিবিসি এটা নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট করেছে। সেখানে দেখা গেছে, মোবাইলে বেশ কয়েকজন রেপ ভিকটিমের ভিডিও ধারণ করে কিভাবে তাকে দিনের পর দিন অধিকতর নির্যাতন করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন পূর্ণিমা নামের একজন ভিকটিম। ২০০০ সালের নির্বাচনের পর কিশোরী পূর্ণিমা বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। পরে তিনি জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে যখন বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন, সেই সময় আবার তার ওপর নির্যাতনের আঘাত নেমে আসে। তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে সেখানে অশালীন ছবি ও পোস্ট দেয়া হতে থাকে। তাকে হয়রানি করার জন্য এইসব করা হয়। একজন নিরপরাধ নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করার জন্য যা কিছু করা সম্ভব -তা এই বিকৃত মানুষগুলো করেছে।
ফেসবুক আইডি হ্যাক করে অনেক মেয়ের ছবি পর্নোসাইটে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ভিকটিম ও তার পরিবারের মান-সম্মান, ভিকটিমের পেশাগত জীবন -সবকিছুই তছনছ করে দেয়ার জন্য দুর্বৃত্তরা এই পথ বেছে নিচ্ছে। অনেক মেয়ে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হচ্ছেন -এসব সাইবার আক্রমণের কারণে।
কিশোর-তরুণরা এইসব পর্নোগ্রাফি দেখে বিকৃত মানসিকতায় ভুগছে। তারা বেড়ে উঠছে বিকৃত শিক্ষা নিয়ে। এটা সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে এবং নারী ও শিশুর জীবনকে আরও বেশি অনিরাপদ করে তুলছে।
পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া ছাড়া এই বিকৃত পথ থেকে সমাজকে রক্ষার কোনো উপায় নেই। কোনো নারী বা শিশুর পর্নোছবি তোলা বা প্রচারের কারণে অপরাধীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পর্নোগ্রাফির ভূত চেপেছে সমাজের কিছু মানুষের মাথায়। এই ভূত তাড়ানোর জন্য ঝাঁটাপেটা করতে হবে শক্ত হাতে। দুই-দশটা অপরাধীকে চৌদ্দ শিকের ভেতরে ১৪ বছরের জন্য ঢোকাতে পারলে বাকি শয়তানগুলোর শিক্ষা হবে। এমন কড়া শাস্তি দিতে হবে যেন শিশু ও নারীকে পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে নির্যাতন করার কথা চিন্তা করতেও ভয়ে অপরাধীদের বুক কেঁপে ওঠে।
সূত্র: জাগো নিউজ
এফএফ