সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক রহমান
ধর্ম অবমাননার বিষয়ে ফেসবুকে যা এসেছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে তো তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। যারা এমনটি করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় নিরীহ সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর যারা আক্রমণ করেছে তারা আরও বড় অপরাধী। কারণ কোরআন শরীফে আছে, একজনের অপরাধে অন্যজনের উপর দায় চাপানো যায় না- দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ।
তিনি বলেন, এই যে গ্রামের অসহায়, নিরীহ সংখ্যালঘু মানুষ তারা তো কোনো অপরাধ করেননি। তাহলে তাদের বাড়িঘর কেন পোড়ানো হয়েছে? কেন লুণ্ঠন করা হয়েছে? এটা অত্যন্ত নিন্দনীয়, গর্হিত ও জঘন্য অপরাধ, তা যারাই করে থাকুক। ইসলামের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। যারা শান্তিকামী নাগরিক তাদের প্রত্যেকেরই জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া তাদের প্রতিবেশীদের জন্য অবশ্যই কর্তব্য। সে মুসলিম কিংবা হিন্দু যেই হোক। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এতদিন শুনতাম ওহাবিরা উগ্রবাদী। এখন তো দেখি সুন্নিরা আরও বেশি উগ্রবাদী। উগ্রবাদীতা অত্যন্ত নিন্দনীয়। সীমালঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। এমনকি যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়ার সময়ও আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা কেউ কোনো ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করবে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংখ্যালঘু বা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর আক্রমণকারীরা তো সীমালঙ্ঘন করেছে।
তিনি আরও বলেন, রাসূলে কারীম সা. বলেছেন, ‘কেউ যদি নিরীহ মুসলিম বা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন বা হয়রানি করে, কষ্ট দেয় তাহলে বেহেশত তো দূরের কথা, বেহেশতের গন্ধও পাবে না তারা।’ সামনে কোনো অন্যায়-অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে দেখেও যখন কেউ চুপ করে থাকে তাহলে তাদেরকে বোবা শয়তান বলা হয়। সুতরাং আমাদের সবারই উচিত- এই ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া। প্রতিবাদ করা। সমাজে বসবাসকারী সংখ্যালঘু বা অমুসলিম ভাইদেরকে আশ্বস্ত করছি- এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনায় যেন তারা বিভ্রান্ত না হন, আতঙ্কিত না হন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের সঙ্গেই রয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ বলেন, এই দেশ শান্তির দেশ। এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। শান্তিতে বসবাস করতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সব বয়সের মানুষই শান্তি চায়। কিন্তু ইদানিং কিছু তরুণকে বিপথে যেতে দেখছি আমরা। বিভিন্ন জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। তরুণদের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য, জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করার জন্য আলেম-ওলামাদের দায়িত্ব ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা। জিহাদ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে বিভ্রান্তি দূরীকরণে সচেষ্ট হওয়া।
তিনি বলেন, আলেম-ওলামাদের জন্য এ ক্ষেত্রটি অনেক বড়, অনেক বিস্তৃত। যা অন্য অনেকের সামনে নেই। আলেম-ওলামারা মসজিদে খুতবা দেন, জলসায় ওয়াজ করেন, তারা মিলাদ-দোয়া পরিচালনা করেন। তাদের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। জনসচেতনায় আলেম-ওলামারা যেন সবক্ষেত্র ব্যবহার করেন সেই আহ্বান আমি জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, এদেশে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। স্বাধীনতাবিরোধী এ সংগঠনটি আমাদের জন্য শুধু সমস্যাই নয়, রাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি। তাদের আদর্শ তো ইসলামের আদর্শ নয়। তারা মানবসভ্যতার জন্যই হুমকি, ইসলামের জন্য তো হুমকি বটেই। সুতরাং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি, রাজনৈতিক দর্শনÑ দেশের জন্য, সমাজের জন্য, ধর্মের জন্যও অনেক বড় হুমকি।
এক প্রশ্নের জবাবে মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ বলেন, রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কর্তব্য রাষ্ট্রকে রক্ষা করা, জনগণকে রক্ষা করা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রধানতম একটি দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে- জামায়াত-শিবিরকে বে আইনি ঘোষণা করা ও রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া। জামায়াতের যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা কেন্দ্র করে তাদের রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে, এই রক্ত সঞ্চালনকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান জনগণের মালিকানায় নিয়ে আসতে হবে। তাদের যে প্রকাশনাগুলো ইসলামের নামে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তা মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিচ্ছে। এসবকে বাজেয়াপ্ত করে ধ্বংস করে দেওয়া। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের সদা সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে রাষ্ট্র দায়িত্বহীনতার কাজ করবে।
তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির বা তাদের কর্মী-সমর্থকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কেন অবকাশ নেই? কারণ একাত্তরে যে দর্শন নিয়ে তারা বীভৎস কাজগুলো করেছিল, একই দর্শন সংক্রমণ করেছে তাদের নব্য চেলাদের উপরে। একই ঘৃণা, একই বিদ্বেষ নিয়ে জামায়াত-শিবিরের নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে। এখানেও এড়িয়ে যাওয়া, কাকের মতো মাথা গুজে থাকার কোনো উপায় নেই। এখন যা হচ্ছে তা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। আরেকটি হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে যে হুমকি তার বিচার। মানবিকতার প্রতি, মানবিক আদর্শের প্রতি তাদের আদর্শ তো একটা হুমকি। আগে যেমন হুমকি ছিল, এখনো তাই রয়েছে। তাই এখনো যারা এই আদর্শকে গ্রহণ করছে, তাদেরকে মূল আদর্শের দিকে আসা উচিত। না পারলে তাদের বিচার করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, তরুণদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, সে যেন ইসলামের নামে বিভ্রান্ত না হয়। ইসলামকে বোঝার জন্য কোরআন, হাদিস পড়ার যেন চেষ্টা করে। এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক সংগঠন থেকে যেন তারা নিজেদের রক্ষা করে। আর যারা বিভ্রান্তিমূলক সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তাদেরকে বলব, হে তরুণ এখনো সময় আছে তোমরা তওবা করে শান্তির পথে ফিরে আসো।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট এই ইসলামি চিন্তাবিদ বলেন, দেশপ্রেম হচ্ছে মানুষের প্রকৃতিগত, স্বভাবগত একটি বিষয়। ইসলাম যেহেতু স্বভাবধর্ম, মানুষের এই স্বভাবকে আল্লাহ তৈরি করেছেন। মানুষের এই স্বভাবকে ইসলাম স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দেয়। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। এর গুরুত্ব অপরিসীম। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ কখনোই ইসলাম সম্মত বিষয় নয়। কোনো মানুষকে হত্যা করা অনর্থক। কে মুসলিম, কে মুসলিম নয় সেটা বড় প্রশ্ন নয়। ডাকাতি করা যেমন ইসলামে হারাম, লুটতরাজ যেমন ইসলামে হারাম, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদও ইসলামে হারাম। সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাস করে বলে জিহাদ। এর সঙ্গে আসলে জিহাদের কোনো সম্পর্কই নেই।
তিনি বলেন, ইসলাম প্রতিটি মানুষকেই দায়িত্বশীল করে। হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তোমাদের এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। এক হাদিসে বলা আছে, যে তোমরা যদি ক্ষমতার অধিকারী হও তাহলে ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যায়কে প্রতিহত করো। আর তোমরা যদি সুশীল সমাজের আলেম-ওলামা হও তাহলে তোমরা আশায়, জবানে একে তোমরা প্রতিহত করো। আর যদি একেবারে তোমার প্রতিবাদ করার কোনো শক্তি না থাকে তাহলে অন্যায়কে তুমি ঘৃণা করো। মুখে বলতে না পারলে মনে মনে ঘৃণা জানাবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের প্রত্যেককেই দায়িত্বশীল হতে হবে। আলেম-ওলামাদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আলেম-ওলামাদেরই দায়িত্ব অনেক বেশি। যেহেতু এই মুহূর্তে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ইসলামের নামে হচ্ছে। এ বিষয়ে জনসাধারণ যাতে ভুল পথে না যায় সেজন্য ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা তাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এটা করা আলেম-ওলামাদের দায়িত্ব।
সূত্র: আমাদের অর্থনীতি