মাহমুদ আজহার : বিরোধী দলে থাকতে ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে কাউন্সিল করেছিল আওয়ামী লীগ। ওইদিনই সভানেত্রী-সাধারণ সম্পাদক, প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ বেশ কয়েকটি পদে নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ গত শনি ও রবিবার দুই দিনব্যাপী ২০তম কাউন্সিলেও ঘোষণা করা হয়েছে সভানেত্রী-সাধারণ সম্পাদকসহ উল্লেখযোগ্য পদে নির্বাচিতদের নাম। এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটিও দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। অন্যদিকে বিরোধী দলে থেকে বিএনপির সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়ে গেল গত ১৯ মার্চ। ওইদিন শুধু চেয়ারপারসন আর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণা করা হয়। দলের ভিতরে-বাইরের দাবি থাকলেও নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নাম ঘোষিত হয়নি। এরও অন্তত ১১ দিন পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব ও অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভীকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ঘোষণা করা হয় যেদিন মির্জা ফখরুল কারাগারে যান। ওই ঘোষণাও ছিল অনেকটা ‘রহস্যময়’। বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় আরও অন্তত পাঁচ মাস পর। এর আগে দলের ভিতরে নানা হিসাব-নিকাশে প্রায় পাঁচ বছর ঝুলন্ত ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ছিলেন মির্জা আলমগীর। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানালেন, ‘এটাই হলো আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক পার্থক্য। বিএনপি অনেক কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। নানা কিছু ভাবতেই লম্বা সময় পার হয়ে যায়। এ কারণেই কাউন্সিল হলেও এখনো চূড়ান্ত গঠনতন্ত্র প্রকাশই করতে পারছে না। এটাও দলের এক ধরনের দুর্বলতা। অন্যদিকে লোক দেখানোর জন্য হলেও আওয়ামী লীগ একটি নিয়ম মেনে চলে। গঠনতন্ত্র ফলো করে। যদিও দলীয় প্রধানের একক সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল। স্বাভাবিকভাবে তারা যতটা অর্গানাইজড, বিএনপি ততটা নয়। তা ছাড়া বিএনপি বিভিন্ন মতের দল। সেখানেও সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সমস্যা হয়। বিগত সময়ে ঝড়ও কম যায়নি দলটির ওপর। তার পরও আমি বলব, সামনের নির্বাচনের জন্য তাদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি কাম্য নয়।’ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কাউন্সিল হলেও ক্রমেই নির্জীব হয়ে পড়ছে বিএনপি। কমিটি ঘোষিত হলেও দলটিতে নেই কোনো উচ্ছ্বাস। তৃণমূল বিএনপিও এখন নীরব। অবশ্য সর্বস্তরের নেতা-কর্মী মামলা-হামলায় কাবু। তবে দলের কেউ কেউ বলছেন, সদিচ্ছা থাকলে প্রতিকূলতার মধ্যেও অনেক কিছু করা যায়। বিগত ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারা দেশেই ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। এখন তো পরিবেশ অনেক ভালো। দলের সিনিয়র সব নেতাই এখন বাইরে। তারা প্রকাশ্যেই ঘোরাফেরা করতে পারছেন। পার্টি অফিসও খোলা। জানা যায়, গঠনতন্ত্রে থাকলেও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উপকমিটি এখনো ঘোষণা হয়নি। এ নিয়ে কাজ চলছে বলে জানা গেছে। নিয়ম অনুযায়ী জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও বিএনপিতে উল্টো। কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের পর বিএনপি এখন হাত দিয়েছে তৃণমূল পুনর্গঠনে। দলের ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ১৩টিতে কমিটি হয়েছে। সেখানেও আংশিক কমিটি রয়েছে। অধিকাংশই আবার কাউন্সিল ছাড়াই কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া কমিটি। স্থায়ী কমিটিসহ কয়েকটি সম্পাদকীয় পদ শূন্য রয়েছে। অঙ্গসংগঠন যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল আজ হবে কাল হবে করতে করতে কয়েক মাস অতিক্রম করেছে। এ নিয়েও নীতিনির্ধারকরা দোটানায় রয়েছেন। এদিকে যুবদলে নিরব-টুকু কমিটি হবে না এ্যানি-টুকু কমিটি হবে, না টুকু-মজনু কমিটি হবে— তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তাই দলের হাইকমান্ডও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। স্বেচ্ছাসেবক দলেও প্রায় একই অবস্থা। বাবু-জুয়েল কমিটি না সপু-বাবু কমিটি তা নিয়েও দোটানায় দলের শীর্ষ নেতারা। ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি নিয়ে নেতাদের মধ্যে নানা বক্তব্য পাওয়া গেছে। দুই ভাগ না চার ভাগ, নাকি এক ঢাকার কমিটি হবে— তা নিয়েও দলের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে। দুই ভাগে বিভক্ত কমিটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কবে নাগাদ কমিটি হবে, কেউ বলতে পারছেন না। এদিকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব কমিটি কবে হবে, কেউ বলতে পারছেন না। বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা জানান, সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। কিন্তু বিএনপি এখনো সংগঠনের মধ্যেই পড়ে আছে। কাউন্সিলের সাত মাস হলেও দল গোছাতে পারেনি। দলের মূল ভিত্তি বিশেষ করে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের কমিটিও নেই। আন্দোলনের মূল ক্ষেত্র ঢাকা মহানগরীও নাজুক অবস্থায়। এসব কমিটি কবে হবে, কেউ নিশ্চিত নন। চলতি বছরের মধ্যেই দলের সব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শেষ করে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। অগোছালো দল নিয়ে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনেও তেমন সুবিধা করতে পারবে না বিএনপি। দলকে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নূরুল আমিন বেপারি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনোটাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচন করে না। তবে তুলনামূলক আওয়ামী লীগ একটু গণতান্ত্রিক। কারণ, এই দলের একসময় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছিল। তাই তারা কাউন্সিলে কমিটি এখনো দিতে পারছে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কমান্ডিং পাওয়ারও বেশি। অন্যদিকে ওয়ান-ইলেভেন থেকে ক্রমেই দুর্বল হওয়া বিএনপির কমান্ডিং পাওয়ার অনেকটাই দুর্বল। তাই অনেক কিছুতেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে দলটি। তার পরও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিকে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে আরও শক্তিশালী হওয়া জরুরি।’
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন