এস এম সাখাওয়াত হুসাইন
২৭ অক্টোবর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের প্রথম খতীব (১৯৬৪-১৯৭৪) মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী (রহ.) -এর ৪২ তম ওফাত বার্ষিকী । ১৯৭৪ সালের এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। ১৯১১ সালের ২৪ জানুয়ারী (১৩২৯ হিজরী ২২ মুহাররম) সোমবার বিহার প্রদেশের মুঙ্গের জেলার অন্তর্গত পাঁচনা নামক গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার নাম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হাকিম আবদুল মান্নান (রহ.) এবং মা সৈয়দা সাজেদা। তিনি চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় ‘ মুহাম্মাদ ’ এবং লকব আমীমুল ইহসান । তার দাদা সাইয়্যেদ নূরুল হাফেয আল-কাদেরিও একজন কামেল সাধক ছিলেন। তিনি কুরআন করীমে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি মাওলানা মোহাম্মদ আলী আল-কাদেরী আল মোজাদ্দেদী আল মুংগেরীর একজন খলীফা ছিলেন। তার বংশ-তালিকা ফাতেমা নবী মুহাম্মাদ পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে তার পূর্ব-পুরুষগণ নামের পূর্বে ‘সাইয়্যেদ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁর পিতা ও চাচার নিকট থেকে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে তাঁর চাচা সাইয়্যেদ আব্দুদ দাইয়্যানের (রহ.) নিকট হতে পূর্ণ ত্রিশ পারা কুরআন খতম করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। তাঁর চাচা তাঁকে ফার্সি ভাষায় বিশেষ জ্ঞান দান করেন। মাত্র দু বছরের ব্যবধানে মুফতী সাহেব হযরত বারকাত আলী শাহ (রহ.)-এর নিকট থেকে আরবী ব্যাকরণের (মীজান মুন্শায়েব) প্রাথমিক জ্ঞান রপ্ত করেন এবং পাশাপাশি উচ্চতর ফার্সী সাহিত্য ও তাজবীদের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। মাত্র দশ বৎসর বয়সে তিনি হযরত সাইয়্যেদ বারকাত আলী শাহ নিকট কুরআন মাজীদের অনুবাদ, ইলমে সরফ, তফসীর, হেসনে হাসিন ও ফার্সি সাহিত্যের উচ্চতর গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন। ১৯২৬ সালে পনের বছর বয়সে মুফতী সাহেব কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি ১৯২৯ সালে আলিম পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন, হাদীস বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে স্বর্ণপদকে ভূষিত হন । ১৯৩১ সালে ফাযিল ও ১৯৩৩ সালে কামিল (হাদীস) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং “মুমতাজুল মুহাদ্দিসিন” উপাধি প্রাপ্ত হন । ১৯৩৪ সালে তিনি তাঁর শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ মাওলানা মুফতী মুশতাক আহমেদ কানপুরী (রহ.) সাহেব এর নিকট থেকে ‘মুফতী’ সনদ লাভ করেন। তখন থেকে তিনি ‘মুফতী’ খেতাবে আখ্যায়িত হন।
কর্মজীবন: ১৯২৭ সালে পিতার ইন্তেকালের পর ছোট ভাই বোনের লালন-পালন ও শিক্ষার দায়িত্ব, পিতার চিকিৎসালয় ও পারিবারিক প্রেস পরিচালনা, গৃহ সংলগ্ন (জালুয়াটুলীস্থ) মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৩৪ সালে তাঁকে কলকাতার বৃহত্তর জামে মসজিদ “নাখোদা মসজিদ” এর সহকারী ইমাম ও মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োাগ দেয়া হয়। ১৯৩৫ সালে ‘নাখোদা মসজিদ’ এর মাদ্রাসার দারুল ইফতার প্রধান মুফতীর দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে প্রায় লক্ষাধিক ফাতওয়া প্রদান করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি নাখোদা মসজিদের ও দারুল ইফতার দায়িত্ব প্রশংসনীয় ভাবে পালন করেন। এইজন্য ১৯৩৫ সালে কলকাতা সরকার তাকে একটি বিশেষ সীলমোহর প্রদান করে যাতে লেখা ছিল গ্রান্ড মুফতী অফ কলকাতা । তখন থেকে তিনি মুফতী-এ-আযম উপাধিতে ভূষিত হন । ১৯৩৭ সালে বৃটিশ সরকার মুফতী আমীমুল ইহসানকে মধ্য কলকাতার কাজী পদে নিয়োাগ দেন। ১৯৪৩ সালে মাদ্রাসা-ই আলিয়ায় অধ্যাপনার কাজে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এইসব কাজ যথারীতি পালন করেন। ১৯৪০ সালে তিনি আঞ্জুমানে কুররায়ে বাংলার (বাংলার ক্বারী সমিতি) সভাপতি নিযুক্ত হন।
১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকতার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সাল থেকে ভারত বিভাগ (১৯৪৭) পর্যন্ত টাইটেল কামিল ক্লাসে হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ এবং ফাযিল শ্রেণীতে উর্দু-ফার্সী শিক্ষা দিতেন। ১৯৪৭ সালে আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। । ১৯৪৯ সালে তৎকালীন সরকার তাকে ধর্মীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত করেন। ১৯৫৫ সালে আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানা, মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী অবসর গ্রহণের পর মুফতী আমীমুল ইহসান অস্থায়ীভাবে সেই পদে নিয়োগ পান। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ীভাবে সেই পদে নিযুক্ত ছিলেন। আলিয়া মাদ্রাসায় কর্মরত অধ্যাপক হিসাবে তিনি ব্যাখ্যাসহ বুখারী শরীফ পড়াতেন। ১৯৬৯ সালের ১ই অক্টোবর উক্ত পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৫৫ সালে আলিয়া মাদ্রাসায় হেড মাওলানার পদে উন্নীত হবার পর তৎকালীন ঢাকার প্রধান ঈদগাহ পুরানা পল্টন ময়দানে ঈদের জামাতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েক বছর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররম প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন কমিটির চেয়ারম্যান ইয়াহিয় বাওয়ানীর অনুরোধে এবং মসজিদ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে মসজিদের খতীব এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত এই দায়িত্ব কৃতিত্ব সাথে পালন করেন। তিনি প্রতি শুক্রবার সেখানে জুমার নামাজ পড়াতেন এবং আরবীতে স্বরচিত খুৎবা পড়তেন। খুৎবার বঙ্গানুবাদ পূর্বেই শ্রোতাদেরকে শোনানো হত। অভিনব পদ্ধতিতে অনর্গল বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় তাঁর খুৎবা প্রদানের অপূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল বিরল । আরবদেশ থেকে আগত অনেক উচ্চশিক্ষিত আলেম ও রাষ্ট্রনায়ক তাঁর খুৎবা শুনে আবেগাপ্লুত হতেন।
তিনি ২০০ এর অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। নিচে তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু কিতাবের নামের তালিকা দেয়া হল।ইলমে তফসীর এবং উসূলে তফসীর ইতহাফুল আশরাফ বি হাশিয়াতিল কাশশাফ,আল ইহসানুস সারী বিত তাওযিহ ই তাফসিরই সহীহিল বুখারী,আত তানবীর ফি উসূলিত তাফসির
আত- তাবশীর ফি শরহিত তানবীর ফি উসূলিত তাফসির, ইলমে হাদীস এবং উসূলে হাদীস, মীযানুল আখবার, আল ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার, মানাহিজুস সুআদা,উমদাতুল মাযানী বি তাখরিজে আহাদীস মাকাতিবুল ইমামুর রাব্বানী, আল আরবাঈন ফিস্ সালাতআল-আরবাঈন ফিল মাওয়াকিত,আল আরবাঈন ফিস্ সালাতি আলান নবী (সা), জামে জাওয়ামেউল কালাম,কানযুল উম্মাল, মুকাদ্দামায়ে সুনানে আবু দাউদ, মুকাদ্দামায়ে মারাসিলে আবু দাউদ,লাইল ওয়ান নাহার, মীযানুল আখবার, মিয়ারুল আসার,হাশিয়ায়ুস সাদী, তোহফাতলি আখিয়ার,তালিকাতুল বারকতী, তালখীসুল মারাসিল,আসমাউল মুদিল্লীন ওয়াল মুখতালিতীন,কিতাবুল ওয়ায়েযীন, মিন্নাতুল বারী, ইলমে ফিকহ এবং উসূলে ফিকহ তরীকায়ে হজ্জ,ফাতাওয়ায়ে বারকাতীয়া,তরীকায়ে হজ্জ, আল কুরবাহ ফিল কুরা, হাদিয়াতুল মুসাল্লীন, আত¦নবীহ লীল ফকীহ,লুববুল উসূল ,মালাবুদ্দা লিল ফকীহ,আত- তারীফাতুল ফিকহিয়্যাহ,উসূলুল কারখী, উসূলুল মাসায়েলীল খিলাফিয়্যাহ,কাওয়ায়েদুল ফিকহ,আদাবুল মুফতী, তুহফাতুল বারকাতী বি-শরহে আদাবুল মুফতী, সীরাত গ্রন্থ: আওজায়ুুস সিয়ার, আনফাউস সিয়ার, সীরাতে হাবিবে ইলাহ রেসালা-হায়াতে আবদুস সালাম,ইলমে তাসাওউফ, রেসালায়ে তরীকাত, আততাশাররুফ লি আদাবিত তাসাওউফ,তারীখ (ইতিহাস), তারীখে ইসলাম,তারিখে আম্বিয়া,তারিখে ইলমে হাদীস,তারীখে ইলমে ফেকাহ,আল হাভী ফি যিকরিত তাহাভী, তারিফুল ফুনুন ওয়া হালাতে মুসান্নেফিন,নাফয়ে আমীমইলমে নাহু ও শরফ (ব্যাকরণবিদ্যা),মুকাদ্দমাতুন নাহু, নাহু ফারসী,ওয়াজ ও মিলাদ, মজুমায়ে খুতবাত,মজুমায়ে ওয়াজ,ওয়াজিফায়ে সাদিয়া বারকাতীয়া,শাজারা শরীফা,সিরাজাম মুনীরা ও মিলাদ নামা, উর্দু সাহিত্য: আদবে উর্দু, শরহে শিকওায়াহ ওয়া জওয়াাবে শিকওয়াহ।
তাঁর অনেক গ্রন্থ মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকাভুক্ত। প্রধান কিতাবসমূহ যেমন ফিকহুস সুনানে ওয়াল আসার, সীরাতে হাবিবে ইলাহ, তারীখে ইলমে ফিকাহ, তারীখে ইসলাম, তারীখে ইলমে হাদীস, আদাবুল মুফতী, কাওয়াাযয়েদুল ফিকাহ, মীযানুল আখবার, মিয়ারুল আসার প্রভৃতি মিসরের জামে আল আজহার, ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দসহ, পাকিস্তান সিরিয়া, মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সকল কওমী, আলিয়া মাদ্রাসা গুলোতে পাঠ্য বই হিসাবে পড়ানো হয়। এছাড়াও তার রচিত “কিতাবুল আওকাত” এর উপর ভিত্তি করেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাঁর রচিত নামাযের সময়সূচি অনুযায়ী বর্তমানে সারা বাংলাদেশে নামাযের স্থায়ী সময় ও ওয়াক্ত নির্ধারণ করা হয়। ইসলামের সেবা ও দাওয়াতি কার্যক্রমে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে তাকে মরণোত্তর স্বর্ণপদক ও সনদ প্রদান করেন। হযরত মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকতী ১৯৭৪ সালের ২৭ অক্টোবর (১৩৯৫ হিজরীর ১০ই শাওয়াল) ইন্তেকাল করেন । ৬০ নং তনুগঞ্জ লেনে অবস্থিত কলুটোলা মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
লেখক: সাংবাদিক
এফএফ