যুবায়ের আহমাদ
বাংলাদেশে কওমি ও আলিয়া এ দু‘ধরণের মাদরাসা চালু আছে। আলিয়া মাদরাসাগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও স্বীকৃত হলেও আমাদের কওমি মাদরাসাগুলোর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। আছে সামাজিক স্বীকৃতি। যেহেতু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া সামাজিক স্বীকৃতি অপূর্ণ আর ৯০ ভাগ মুসলমানের এ দেশে সামাজিক স্বীকৃতির মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও কওমি শিক্ষার্থীদের অধিকার তাই দাবি ওঠে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির। স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে বলেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) মুক্তাঙ্গণে অবস্থান করেছিলেন স্বীকৃতির দাবিতে। হজরত পীর সাহেব চরমোনাইও (রহ.) ছুটে গিয়েছিলেন স্বীয় উস্তাদের দাবির প্রতি সমর্থন নিয়ে। রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)। সর্বশেষ ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল সরকার কর্তৃক ১৭ সদস্য বিশিষ্ট ‘কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠিত হলে আবারো আলোচনায় আসে ‘স্বীকৃতি’। কিন্তু একদিকে স্বীকৃতির অধিকার অন্যদিকে ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা বিসর্জনের প্রশ্ন। স্বীকৃতি নিলে স্বকীয়তা নষ্ট হবে এমন ধারণায় কওমির অনেক শুভাকাঙ্খী এর বিরোধিতা করছেন। প্রস্তাবনার কোন কোনে ধারাগুলো, সিলেবাসের কোন কোন বিষয়গুলো স্বকীয়তা বিরোধী তা কিন্তু তারা বলছেন না। প্রণীত সুপারিশ এবং সিলেবাস নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পড়ে দেখলে খুব সাংঘর্ষিক কিছু পাওয়া যাবে না বলেই মনে হয়। প্রশ্ন হলো স্বীকৃতির জন্য প্রণীত সুপাশি ও সিলেবাসে যদি খুব সাংঘর্ষিক কিছু না থাকে তবু কি আমরা এর বিরোধিতা করব? যারা স্বীকৃতি বিরোধী তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, স্বীকৃতির জন্য প্রণীত সুপারিশ এবং সিলেবাসের কোন কোনে বিষয়গুলো কওমির ঐতিহ্যে ও স্বার্থের পরিপন্থি তা চিণ্হিত করে এর বিকল্প প্রস্তাবনা আপনারা পেশ করুন।
একাডেমিক ও প্রাশাসনিক ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন আনতে হবে না এমন শর্তেই স্বীকৃতি দিলেই তা হবে আন্তরিকতার প্রকাশ। স্বীকৃতি এবং স্বকীয়তা উভয়টি সামনে রেখে স্বীকৃতি নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা। কওমির স্বার্থে যে কেউ এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন।
১. স্বীকৃতি হবে বিশেষায়িত ইসলামী শিক্ষা (Specialized Islamic Education) হিসেবে। যদি বিশেষায়িত না হয়ে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে হয় তাহলে সেখানে সরকারি সিলেবাসের বাধ্যবাধকতা আসা স্বাভাবিক। এ স্বীকৃতি কেবল ধর্মীয় কর্মক্ষেত্রের পরিম-লেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সনদ দিয়ে মাদরাসা (কওমি ও আলিয়া) ও স্কুল-কলেজে (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিষয়ে) শিক্ষকতা, সেনাবাহিনীর ধর্মীয় শিক্ষক (Religious Teacher), ইমাম-মুআজ্জিন এবং মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রারের (কাজী) মতো কেবল ধর্মীয় ক্ষেত্রেই চাকরি বা খেদমতের সুযোগ রাখা হবে।
২. স্বীকৃতি হবে স্তরভিত্তিক। কারণ স্তর ভিত্তিক না হলে যে ছাত্রটি মিশকাত জামাত (স্নাতক পর্যায়) পড়ার পর কোনো কারণে আর তার লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে পারল না, মাত্র একটি বছরের কারণে তার দ্বীর্ঘ ১৫-১৬ বছরের ছাত্রজীবন কোনো স্বীকৃতিই পাবে না। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার এ সময়েও এ ছাত্রটি ১৬ বছর লেখাপড়া করেও প্রাথমিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত নয় বলে বিবেচিত হবে। ৫টি স্তরে বিন্যসিত হবে এ শিক্ষাধারা। ৫ বছরের ইবতেদাইয়্যাহ (প্রাথমিক), ৫ বছরের মুতাওয়াসসিতা (মাধ্যমিক), ২ বছরের সানাবিয়্যাহ উলইয়া (উচ্চ মাধ্যমিক), ৪ বছরের ফজিলত (স্নাতক) এবং ১ বছরের তাকমিল (স্নাতকোত্তর)। এ স্তরগুলোর মধ্যে শুধু ইবতেদাইয়্যাহ (প্রাথমিক) স্তর উত্তীর্ণরা আলিয়া মাদরাসা/স্কুল-কলেজে ৬ষ্ঠ শেণিতে ভর্তি হতে পারবে। কিন্তু মুতাওয়াসসিতাহ (মাধ্যমিক) পাশ করে কোনো ছাত্র আলিয়া মাদরাসা/কলেজে আলিম বা উচ্চমাধ্যমিক (ইন্টারমেডিয়েট)-এ ভর্তি হতে পারবে না এবং সানাবিয়্যাহ উলইয়া (উচ্চ মাধ্যমিক) পাশ করেও কোনো ছাত্র আলিয়া মাদরাসা/কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাজিল অথবা ডিগ্রি/অনার্সে ভর্তির সুযোগ পাবে না। তবে ধর্মীয় যেসব চাকরির ক্ষেত্রে আলিম বা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ লোকেরা চাকরির আবেদন করার সুযোগ পান সানাবিয়্যাহ উলইয়া পাশকৃতরাও সেসব চাকরিতে আবেদনের সুযোগ পাবেন এবং যেসব চাকরির ক্ষেত্রে ফাজিল/অনার্স (ইসলামিক স্টাডিজ) পাশ হতে হয় সেসব ক্ষেত্রে ফজিলত (মিশকাত) পাশ করে আবেদন করতে পারবেন। অর্থাৎ কওমি মাদরাসার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতকের সনদ চাকরির ক্ষেত্রে সমমান হবে কিন্তু ভর্তির ক্ষেত্রে সমমান হবে না। কেননা যদি তাদেরকে আলিয়া/কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয় তাহলে ছাত্ররা ইলমের একনিষ্ঠ চর্চা ছেড়ে দিয়ে আলিয়া/বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচেষ্টায় লিপ্ত হবে। মাহরূম হবে ইলমে নববী থেকে। আর এভাবে দলে দলে ছাত্ররা আলিয়া মাদরাসা/কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে কওমি ধারার ইমেজ নষ্ট হবে। ফজিলত ও তাকমিলের ক্লাসগুলোর ছাত্র কমে যাবে। যেমনটি বর্তমানে আলিয়া মাদরাসার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ছাত্ররা আলিম পাশ করে আর মাদরাসায় থাকছে না। চলে যাচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে ফাজিল ও কামিলে ছাত্র সংখ্যা একেবারেই কম। তবে কওমির প্রাথমিক স্তর থেকে পাশ করা ছাত্রদেরকে স্কুল-কলেজে ভর্তির সুযোগ দেয়া হবে এজন্যই যেন কোনো এলাকার প্রতিটি শিশুই চাইলে তার প্রাথমিক শিক্ষার চাহিদা কওমি থেকে পূরণ করতে পারে। তাহলে গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক কওমি মাদরাসা চালু হবে। প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি বাধ্যতামূলক দ্বীনি শিক্ষাটাও নিশ্চিত হবে। তাছাড়া স্তরভিত্তিক স্বীকৃতি হলে কোনো ছাত্র মুতাওয়াসসিতাহ (মাধ্যমিক) পাশ না করে সানাবিয়্যাহ উলইয়া মারহালাতে (উচ্চ মাধ্যমিক) যেমন ভর্তি হতে পারবে না তেমনি ফজিলত পাশ না করেও তাকমিলে ভর্তি হতে পারবে না। ফলে মাধ্যমিক স্তর থেকে (মাঝখানের ক্লাসগুলো না পড়েই) লাফ দিয়ে তাকমিলে (স্নাতকোত্তর) ভর্তির প্রবণতা বন্ধ হবে। এতে শিক্ষার মানটাও ভালো হবে।
কওমি মাদরাসায় শিক্ষিত আদর্শ ও মেধাবী জনশক্তিকে গণমানুষের কল্যাণে আরো কাজে লাগাতে সরকার একান্তই তাদেরকে জেনারেল শিক্ষার সুযোগ দিতে চাইলে তাকমিল (দাওরায়ে হাদিস) সনদকে ভর্তির ক্ষেত্রে মাধ্যমিকের মান দিতে পারে। অর্থাৎ যদি কোনো ছাত্র তাকমিল (দাওরায়ে হাদিস) পাশ করার পর জেনারেল (স্কুল-কলেজের সাধারণ) শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত হতে চায় তাহলে যেন উচ্চ মাধ্যমিকে (ইন্টারমেডিয়েটে) ভর্তি হতে পারে। তা হবে সরকারের আন্তরিকতার প্রকাশ।
৩. কওমি মাদরাসা থেকে তাকমিল (স্নাতকোত্তর) পাশ করার পর শিক্ষার্থীরা যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী বিষয়ে এমফিল ও পিএইচডি (ডক্টরেট) গবেষণার সুযোগ পাবেন। পিএইচডি করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতারও সুযোগ পাবেন।
৪. সিলেবাস প্রণয়নের সর্বময় ক্ষমতা থাকবে কওমি মাদরাসার উলামায়ে কেরামের হাতে। এ ক্ষেত্রে কোনো সরকরি-বেসরকারি হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হবে না। সবগুলো কওমি মাদরাসার জন্য প্রাথমিক স্তরে বাংলা, ইংরেজি এবং গণিত রেখে আঞ্চলিক বোর্ডগুলো প্রাথমিক সিলেবাস প্রণয়ন করবে। মূল কিতাবগুলোর পাশাপাশি মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধু ১০০ নম্বরের বাংলা এবং ১০০ নম্বরের ইংরেজি; স্নাতক পর্যায়ে (প্রতি বছর) ১০০ নম্বর করে ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী পৌরনীতি, লোকপ্রশাসন এবং ‘দেওবন্দ আন্দোলনের’ মতো বিষয় এবং স্নাকোত্তর পর্যায়ে ইসলামী রাষ্ট্রনীতি রাখা যায়।
৫. শিক্ষাধারাকে স্বাধীন ও হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে কওমি মাদরাসাগুলো কোনোরকমের এমপিওভুক্তি (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) বা সরকারি বেতনভাতা গ্রহণ করবে না। শিক্ষক নিয়োগ এবং অব্যহতি প্রদানেরও নীতিমালা প্রণয়ন করবে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড। শিক্ষকদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আঞ্চলিক বোর্ডগুলো করতে পারে।
৬. কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, মহাসচিব এবং সদস্যদেরকে অবশ্যই কওমি মাদারাসা শিক্ষিত হতে হবে এবং স্বনামধন্য কওমি মাদরাসার মুহতামিম/শীর্ষ উস্তাদ হতে হবে। কওমি শিক্ষিতদের বাইরের কাউকে বোর্ডের সদস্য করা যাবে না। মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচন ও অব্যাহতি প্রদানের ব্যাপারেও কওমি মাদরাসার মুহতামিমদের পরামর্শই চুড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে কাওকে চেয়ারম্যান/মহাসচিব হিসেবে চাপিয়ে দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
অনুরোধ: আমাদের ইসলামী অঙ্গণে বিভক্তির শেষ নেই। বিভিন্ন দলীয় বিভক্তির মধ্যেও জাতীয় একটি ঐক্যের প্রতীক কওমি মাদরাসা। কওমি মাদরাসা ও দেবন্দিয়্যাত কেন্দ্রিক এ ঐক্য বিনষ্ট করে ‘বিভক্তির ষড়যন্ত্র হচ্ছে’- এমন ধারণাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। একদিকে স্বীকৃতির অধিকার অন্যদিকে ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা বিসর্জনের প্রশ্ন। উভয়টি সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। স্বীকৃতি নেয়া না নেয়া উভয়টিই ঐক্যবদ্ধভাবে হওয়া প্রয়োজন। স্বীকৃতি নিলে কওমির জাতীয় ঐক্য অটুট রেখেই। সন্দেহ নেই, যারা স্বীকৃতির পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলছেন, কওমির স্বার্থেই বলছেন। একতরফাভাবে বিরোধিতা না করে সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশনের প্রস্তাবনায় আদৗ কোনো সমস্যা আছে কিনা, কোন কোন ধারা কওমি স্বার্থের পরিপন্থী এবং কমিশন প্রণীত সিলেবাসে কী কী সমস্যা আছে তা পর্যালোচনা করে সমস্যাগুলোর এর বিকল্প প্রস্তাবনা ও সিলেবাস প্রণয়ন করার দাবি রাখছি। ‘আমার মতের বিপক্ষে গেলেই অমুকের দালাল’-এমন ধারণায় বিভক্তির পক্ষে যুক্তি দিয়ে প্রতিশোধপ্রবণ না হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পারষ্পরিক ক্ষমা ও শ্রদ্ধাবোধের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বুক ভরা দরদ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেবেন সেই প্রত্যাশা করছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী।
লেখক: খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ, বোর্ড বাজার (আ. গণি রোড), গাজীপুর
শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
এফএফ