রিদওয়ান হাসান
মানুষের শ্রেষ্ঠ্যত্ব তার দেহের গুণে নয়, সেটি তার চিন্তা-ভাবনা বা দর্শনের গুণে। আর এ গুণটিই মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে। কারণ পশুকে তার দেহের ওপর বশ করে বছরের পর বছর ফায়দা লুফে নেয়া যায়। কিন্তু মানুষের ব্যাপার ভিন্ন। মানবপ্রকৃতি স্বায়ত্তশাসিত। মানবচাহিদার অন্যতম হচ্ছে স্বাধীনতা। এজন্য মানুষকে বশ করতে হলে তাকে স্বাধীনতার তিলক পরিয়ে রাখতে হয়। তাদের মননশীলতায় উচ্চাকাক্সক্ষা ও হীনম্মন্যতার তোকমা গুলিয়ে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে হয়।
ইতিহাস ঘাটলে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। সময়কাল তখন ঊনবিংশ শতাব্দি। সে সময়ে যখন প্রাচ্যের স্বাধীনতাকামী জনগণ পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক কলাকৌশল থেকে মুক্তি পেতে চাইল। পুরোপুরি জাগ্রত হল স্বাধীনতার চেতনা। তখন পাশ্চাত্য কিছু রাষ্ট্রকে স্বাদের এমন কমলালেবু খাওয়াল, যেটির হলদে চামড়া স্বাধীনতার হলেও ভেতরের কোষগুলো ছিল পরাধীনতার। অর্থাৎ, সেখাননকার অধিবাসীদের ‘কথিত স্বাধীনতা’ অনুভব হবে। তারাও স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর মতো গণতন্ত্রের ধুম্রজালের খেলা খেলতে পারবে। কিন্তু এসব রাষ্ট্রে সাম্রাজ্যবাদ, শিক্ষা ও মগজধোলাইয়ের মাধ্যমে সেই স্বাধীনচেতা মানুষের মস্তিষ্ক ইউরোপের তুলনায় হীনম্মন্যতা ও স্নায়ুবিক পর্যদুস্ততার শিকার করে রাখবে। পরিকল্পনার ছক এঁটে ব্যাপারটা এমন দাঁড় করাল, যেন স্বাধীন হয়েও তারা মস্তিষ্কের দাসত্ব থেকে মুক্তি না পায়। আর এ ছক অনুযায়ী বিংশ শতাব্দিতে তারা সাফল্যের দরজায় উপনীত হয়। ফলে রাজনৈতিক ও সামরিক দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ হলেও প্রভাব-প্রতিপত্তি আর স্বার্থসিদ্ধির ব্যবহার এখনো পূর্ববৎ বহাল রয়েছে।
সে সময়ে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদ প্রাচ্যদেশগুলোর ওপর নজরদারি রাখলেও গোটা রাজ্যে তখন মুসলিম শাসন কার্যকর ছিল। তুর্কি শাসন সময়ের নামজাদা শাসন ছিল। গোটা পৃথিবীর মুসলিম শাসনের সেরেতাজ মনে করা হত তুর্কি শাসনকে। কারণ, হারামাইন শরীফের ওপর তুর্কির অভিভাবকত্বের হাত ছিল। এই তুর্কি শাসনের সাথেই ইউরোপের খ্রিষ্ট শাসনগুলো আশতাব্দি লড়াই চলতে থাকে। কিন্তু সবসময়ই তুর্কির কাছে মাথানত ছিল ইউরোপের। ইতিহাস এসব যুদ্ধকে ‘ক্রুসেড’ নামে স্মরণ করে। বারবার পরাজয়ের গ্লানি একটা সময় ইউরোপীয় শক্তির মেরুদ- ভেঙে দেয়। এ কারণে তারা প্রতিশোধের নেশায় রণাঙ্গণে বিজয়মালার আশা ছেড়ে দিয়ে চিন্তাগত আগ্রাসনের পথ অবলম্বন করে। প্রচার মাধ্যম, মিডিয়া, শিক্ষার দাঁত দিয়ে চিরশত্রুর মোকাবিলায় মরণকামড়ের কূটকৌশল গ্রহণ করে। পাশাপাশি প্রাচ্যের ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি গবেষণা করে একে মুসলমানদের মধ্যে মগজধোলাইয়ের হাতিয়ার বানিয়ে নেয়।ইতিহাস এদের নাম দিয়েছে—প্রাচ্যবিদ। অর্থাৎ এ সংগ্রাম পাশ্চাত্যের গবেষকদের প্রাচ্যকে জানার, আবিষ্কার করার এবং এ বিষয়ক জ্ঞানচর্চা করার একটি বিশেষ ধারা। এটি সামাজিক বিজ্ঞানে সর্বাধিক পঠিত, আলোচিত এবং অনুসৃত একটি চিন্তাধারা। যদিও প্রাচ্যবাদ শব্দটি ইংরেজি ডিকশনারিতে প্রবেশ করেছিল ১৭৭৯ সালে। ফরাসী একাডেমির শব্দকোষে ঢুকেছিল ১৮৩৮ সালে। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দিতে। তারপরেও গুগল স্কলারসের হিসাব অনুযায়ী এর সাইটেশন ৩০০০ এর উপরে। প্রাচ্যবাদের ওপর বেশ কিছু একাডেমিক ডিসিপ্লিনও প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে জনমনে। যেমন, পোস্টকলোনিয়াল স্টাডিজ। এটি গবেষককে বুদ্ধিবৃত্তির পথ দেখায়। বিশেষ করে যখন কেউ তার পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে অন্য দল বা সমাজকে পাঠ করতে যায়।
প্রাচ্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার শুরুটা কখন ছিল, তা নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। তবে এতটুকু নিশ্চিত করে জানা যায়, পশ্চিমের কতিপয় সন্ন্যাসী ৮০০ বছরের ইসলামি সাম্রাজ্য আন্দালুসের (এখনকার স্পেন) শৌর্য-বীর্যের সময়ে সেখানে আগমন করে সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নেয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এই সন্যাসী প্রাচ্যবিদরা কুরআন ও আরবি গ্রন্থসমূহ তাদের মাতৃভাষায় অনুবাদ করে আর সময়-সুযোগে মুসলিম বিশেষজ্ঞদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নেয়। কারণ, সে সময়ে একমাত্র ইসলামি জ্ঞানই চর্চা হত। চিকিৎসা, দর্শন, গণিত—এসবই ছিল ইসলামের ব্যানারে। এ সন্ন্যাসীদের প্রথম সারির একজন হলেন, ফরাসি সন্ন্যাসী (জার্বার্ট) Jerbert, সে স্পেন থেকে বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামচর্চা করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার পর ৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে রোমের গির্জার পোপ নির্বাচিত হয়। এছাড়াও মহামান্য পিটার (১০৯২-১১৫৬) ও ক্রেমনা'র জেরার্ড (১১১৪-১১৮৭) ছিল প্রাচ্যবিদদের অন্যতম। এরা নিজ দেশে সর্বপ্রথম আরবদের সংস্কৃতির ও আরবদের প্রসিদ্ধ বিশেষজ্ঞদের রচনাকর্মের প্রচার শুরু করে। আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্য তারা ‘বাদওয়ি’র মতো আরবি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। আর আশ্রম ও বিদ্যালয়গুলোতে আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান অনুবাদ করে পড়াতে থাকে লাতিন ভাষায়। যে ভাষাটি তখন ইউরোপের প্রতিটি দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা হিসেবে স্বীকৃত ছিল। এসব আরবি বিদ্যালয় আরবি গ্রন্থের ওপর নির্ভর ছিল এবং এসব গ্রন্থকে গবেষণার মূল উৎস মান করে অব্যাহত পাঠদান চলতে লাগল প্রায় ছয় শতাব্দি যাবত।
এরপর থেকে এই কর্মক্ষেত্র আর কখনো জনশূন্য হয়নি । নিরবচ্ছিন্নভাবে তারা ইসলাম ও আরবি ভাষার পাঠদান এবং কুরআনের ভাষান্তর, আরবি সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থসমূহ অনুবাদ করতে থাকে। একপর্যায়ে লাউয়ের ডগার মতো তড়তড়িয়ে ১৮ শতক আসে। এ সময়ে পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো প্রাচ্যের ইসলামি দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালাতে শুরু করে। ইসলামি ভূখ-গুলোকে অধিগত করাই ছিল এদের মূল লক্ষ্য। খনিজ ও তরল সম্পদ হাতিয়ে নেয়ারও লোভ ছিল স্পষ্ট। তখন পাশ্চাত্যের কতিপয় গবেষক আশৈশব প্রাচ্যতত্ত্বের ওপর দীক্ষিত হয়ে পশ্চিমের প্রতিটি দেশে প্রাচ্যতত্ত্বের ওপর পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করে। যখন আরব ও ইসলামি দেশগুলোর হস্তলিখিত গ্রন্থগুলোর দিকে তাদের রক্তচক্ষু দেখা দেয়, তখন তারা অপরিণামদর্শী ও সরলমনা বাসিন্দাদের কাছ থেকে তা চড়াদামে কিনে কুক্ষিগত করে। আর না হয় নেহাৎ অনিয়মগ্রস্ত গণগ্রন্থাগারগুলো থেকে তা চুরি করে তাদের দেশে পাচার করে দেয়। ফলে আরবি হস্তলিখিত গ্রন্থের এক ভীতিপ্রদ-সংখ্যা ইউরোপের গ্রন্থাগারে পাচার হয়ে যায়। যে বইয়ের সংখ্যা উনিশ শতকের সূচনালগ্নেই ২লক্ষ ৫০হাজারে গিয়ে পৌঁছে। ১৮৭৩ সালে প্রাচ্যবিদদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসে। পরে নিয়মিত এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে থাকে, যেখানে প্রাচ্য, প্রাচ্যের ধর্ম ও সভ্যতা-সংস্কৃতি বিষয়ে পাঠদান ও গবেষণা উপস্থাপন করা হয়। অদ্যাবধি এ সম্মেলন অব্যাহত রয়েছে।
প্রাচ্যবাদ শব্দটি ইংরেজি ডিকশনারিতে প্রবেশ করেছিল ১৭৭৯ সালে। ফরাসী একাডেমির শব্দকোষে ঢুকেছিল ১৮৩৮ সালে। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দিতে। তারপরেও গুগল স্কলারসের হিসাব অনুযায়ী এর সাইটেশন ৩০০০ এর উপরে। প্রাচ্যবাদের ওপর বেশ কিছু একাডেমিক ডিসিপ্লিনও প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে জনমনে। যেমন, পোস্টকলোনিয়াল স্টাডিজ। এটি গবেষককে বুদ্ধিবৃত্তির পথ দেখায়। বিশেষ করে যখন কেউ তার পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে অন্য দল বা সমাজকে পাঠ করতে যায়।
এসব সম্মেলনের প্রধান খোরাক ছিল মুসলিম চিন্তায় বুদ্ধিবৃত্তির প্রভাব খাটানো। এ কারণে তারা ইসলামি বিভিন্ন পরিভাষার পেছনে বুদ্ধিবৃত্তির বাণিজ্য খুলতে থাকে। এজন্য যেসব গবেষক ইসলাম ও মুসলিম চিন্তা নিয়ে কাজ করছেন তারা ইসলামসংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনায় অনেক শব্দ-পরিভাষার সচেতন ও উদ্দেশ্যপূর্ণ বিকৃতি ঘটিয়ে থাকে। পরিভাষার এই অশুদ্ধ, বিকৃত ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তারা মুসলিমদের যাপন, আচরণকে ‘ইসলাম’ হিসেবে পরিবেশন করতে চায়। ফলে ‘আই এস এ’র আচরণকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইসলামের বলে চালিয়ে দিতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য তো স্পষ্ট, ইসলাম সম্পর্কে অশুদ্ধ নেতিবাচক ধারণা ছড়ানো। কিন্তু বর্তমানে ইসলামি স্কলাররাও পাশ্চাত্য লেখকদের অনুকরণে নির্দ্বিধায় এসব শব্দগুলোর ব্যবহার করে, ছাপে, লেখে।
প্রাচ্যবিদরা ইসলামের সাথে সন্ত্রাস ও জঙ্গি শব্দটি সেঁটে দিতে পেরে এক অর্থে সফল বলা যায়। হোক তা কথিত। কারণ বর্তমানের জনমনে জঙ্গি-সন্ত্রাস বলতেই যেন ‘ইসলাম’ শব্দটি ভেসে ওঠে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কিছুদিন আগে পুলিশজায়া বা বৃদ্ধ পুরোহিতকে কে খুন করেছে—তা তখনওতদন্তাধীন। আর এরই মধ্যে ইসলামি স্কলাররা বলতে থাকলেন—এ মানবতারহিত কর্মটি কথিত ‘ইসলামি জঙ্গি’রা করে থাকলে এর বিচার আল্লাহই করবেন! এসব ইসলামিকরা হয়ত জানে না, কথিত বিষয়টি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়, সম্ভাবনা আছে সেটা বাস্তব হয়ে যাওয়ার। আর সন্ত্রাসী-জঙ্গি অপবাদটি যদি ইসলামের বলে বাস্তব প্রমাণ হয়, তাহলে মুসলমানিত্বের অবস্থা কী হবে- কেউ কি এর জবাব দেবেন?
পাশ্চাত্যের ইসলাম গবেষকদের পরিভাষা বিকৃতির আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ইসলাম অর্থে Mohammedanism শব্দটির ব্যবহার। যেটি আমাদের ইসলামি স্কলাররা ‘মুহাম্মাদিয়া’ বা ‘দীনে মুহাম্মাদ’ বলে অনুবাদ করে থাকেন। মূলত ইংরেজিতে ism অর্থ তন্ত্র বা মতবাদ। এভাবে ইসলাম বোঝাতে গিয়ে যদি নবী মুহাম্মাদের নামের শেষে ওংস যোগ করে Mohammedanism বলা হয়, তাহলে এ ভাবনা অবান্তর নয় যে, ধীরে ধীরে ইসলামের ঐশিত্ব ঘুচে যেতে থাকবে। জনমনে এমন ভুল ধারণার উদ্রেক ঘটবে যে, ইসলাম কোনো ঐশী ব্যাপার নয়, তা মূলত এক ঐতিহাসিক ব্যক্তির প্রবর্তিত মতবাদ। আমার এই আশঙ্কা একেবারে ফেলনা নয়। পাশ্চাত্যের লেখকরা এ শব্দটি ব্যবহার করে মূলত তাই করতে চায়। কারণ, আরব সভ্যতা ও ইসলাম নিয়ে প্রাচ্যবিদদের লেখা গবেষণাগুলো পড়লে দেখা যায়, নিছক জ্ঞানার্জনের আগ্রহে বা অন্য কোনো সদিচ্ছা নিয়ে তারা মুসলিম চিন্তা নিয়ে কাজ করেনি। মূলত এই প্রাচ্যবিদরা শুরুতেই আরব সভ্যতা ও ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়েই সচেতন ও পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন দিক থেকে তার বিরুদ্ধে কাজ করে। বর্তমানে ইসলাম সম্পর্কে প্রচলিত ভুল বিকৃত ধারণাগুলোর অধিকাংশের জন্ম এই প্রাচ্যবিদ্যার গর্ভে। তারা ইসলামের একেকটি পরিভাষাকে বির্তকিত করেছে। সংকুচিত করেছে। সীমাবদ্ধতায় আঁকড়ে দিয়েছে। একটা সময় ‘হিজাব’ ছিল নারীর পর্দা, সময়ের বিবর্তনে এখন স্টাইল। দেহের গঠনতন্ত্র জানান দেয়া এবং মুখশ্রী অক্ষুণ্ন থাকার দোহাইযন্ত্র এসব ‘হিজাব’ এখন ইসলামের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুই
প্রাচ্যবিদ্যার অন্যতম সফল দিক হচ্ছে জনমতকে উস্কে দেয়া। বিতর্কিত করে তোলা। যাতে খুব সহজেই জনমনে দলাদলির একটা স্পৃহা চলে আসে। আর দল-মত যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে, তখন কান টানলে মাথার আসার মতো অনৈক্য কিংবা বিভেদও চলে আসবে। অনৈক্যে ধ্বংস হয় একটি দেশ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় গোটা জাতি। অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা ও বিভেদ একটি দেশের গজব। কুরআনেও আভ্যন্তরীণ গোলযোগ, বিশৃঙ্খলা ও বিভেদকে ফেতনা বলা হয়েছে। ইসলামে এটি হত্যাকাণ্ডের চেয়েও জঘন্য অপরাধ। কারণ, হত্যাকাণ্ডে বেদনাদায়ক মৃত্যু ঘটে কিছু ব্যক্তির। অনৈক্য বা ফেতনায় মৃত্যু ঘটে গোটা দেশের বা জাতির। কারণ, এতে প্রচ- দুর্বলতা সৃষ্টি হয় শত্রুর মোকাবিলায় মুসলমানের টিকে থাকা বা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে।
সাম্প্রতিক বুদ্ধিবৃত্তির প্রধান হাতিয়ার হয়েছে জঙ্গি বা কোপসন্ত্রাস। মানুষকে কোপানো ইসলামের ধর্ম নয়। জিহাদ আরেক জিনিস। সাহাবীরাও রাসূলের অবমাননাকারীকে শুয়ে দিয়েছিলেন রক্তের বিছানায়। তাই বলে উগ্র মনোভাব ইসলামের আদর্শ নয়। মনে রাখা দরকার, প্রতিবাদের ভাষা কখনো হত্যা হতে পারে না; প্রতিবাদ হতে হয় বুদ্ধিবৃত্তিক।রাসূলের দাঁত ভেঙেছিল কাফেররা, অসহ্যনীয় কষ্ট দিয়েছিল আবু জাহেল। তায়েফবাসীর আঘাতে জর্জরিত হয়েছিলেন খোদ রাসূল। পরে জিবরাইল এসে অনুমতি চাইলেন—হে রাসূল, শুধু অনুমতি দিন। যের-যবর করে ফেলব তায়েফ নগরী। রাসূল নীরব। বুকের ভেতর দরদ ও মহব্বতের পাহাড়। মাফ করে দিয়ে বললেন, এরা অবুঝ। মাফ করে দিলাম। এই ছিল রাসূলের অনুপম আদর্শ। এটাই সারাজীবন করে গেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
সেদিন একটি প্রবন্ধ পড়লাম। শিরোনাম ছিল—‘মধ্যপ্রাচ্যে ইসলাম’। সাধারণত শিরোনাম দেখে যে কেউ পড়তে আগ্রহবোধ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভেতরে যা পড়লাম তা ভেবে আমার চোখ কপালে উঠার যোগাড়। ইসলামের কোনো সংজ্ঞা ছাড়াই লেখক প্রবন্ধটিতে অন্ত্যন্ত ধূর্ততার সাথে ইসলামকে জঙ্গি বলে বিচার করেছেন। প্রবন্ধটিতে আলোচনা করা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত নির্দিষ্ট কতিপয় মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে। বিবেচনার বিষয় হলো, ইসলাম আর মুসলিম জনগোষ্ঠী কি এক? ভেতরের মালমশলা অনুযায়ী শিরোনামটি কি ‘মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমরা’ নামকরণ করা উচিত ছিল না? ‘ইসলাম’ পরিভাষার এই অশুদ্ধ ও বিকৃত ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাদের কি ইসলাম সম্পর্কে অশুদ্ধ নেতিবাচক ধারণা ছড়ানো উদ্দেশ্য নয়? বর্তমানে জঙ্গি সংগঠনগুলোর ব্যাপারেও মুসলমানরা মগজধোলাইয়ের শিকার । এ কারণে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বলতেই আমরা মান করি এটা ইসলামিক। কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে জুতাচোর কি কখনো মুসলিম হতে পারে? এ কি মুসলমানদের নিবুর্দ্ধিতা নয়?
স্পেনে আটশ বছরের ইসলামি সাম্রাজ্য ভূগর্ভে দাফন হয়েছে। কর্ডোভা মসজিদ গীর্জায় পরিণত হয়েছে। এখন সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী খ্রিষ্টান। স্পেনের সব হারিয়েছি কেবল মুসলিম চিন্তার অবুদ্ধিতার কারণে। সব সময় মুসলমানরা যা করবে, ঢোল পিটিয়ে করবে। এ কারণে প্রতিপক্ষ সব সময়ই মুসলমানদের প্লান সম্পর্কে জেনে ফেলে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে। আর তখন মুসলিম চিন্তায় সেই সনাতন পদ্ধতির প্রতিরোধ নিয়েই বিভোর। কিছুদিন পর যখন ওদের নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে জানে, আবার তা প্রতিহত করতে মুসলমান ঢোল পেটায়। এই করব, সেই করব বলে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়। ফলে আবার তাই ঘটে, যা পূর্বে ঘটেছিল। এভাবেই মুসলমান পিছিয়ে পড়েছে অনেক দূরে। এ কারণে কাজ করে যেতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক মানসিকতা নিয়ে; ঢোল পিটিয়ে নয় কিংবা ঘটা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নয়।
প্রাচ্যবিদ্যার অন্যতম সফল দিক হচ্ছে জনমতকে উস্কে দেয়া। বিতর্কিত করে তোলা। যাতে খুব সহজেই জনমনে দলাদলির একটা স্পৃহা চলে আসে। আর দল-মত যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে, তখন কান টানলে মাথার আসার মতো অনৈক্য কিংবা বিভেদও চলে আসবে। অনৈক্যে ধ্বংস হয় একটি দেশ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় গোটা জাতি। অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা ও বিভেদ একটি দেশের গজব। কুরআনেও আভ্যন্তরীণ গোলযোগ, বিশৃঙ্খলা ও বিভেদকে ফেতনা বলা হয়েছে। ইসলামে এটি হত্যাকাণ্ডের চেয়েও জঘন্য অপরাধ। কারণ, হত্যাকাণ্ডে বেদনাদায়ক মৃত্যু ঘটে কিছু ব্যক্তির। অনৈক্য বা ফেতনায় মৃত্যু ঘটে গোটা দেশের বা জাতির।
ইসলামি সাম্রাজ্য থাকাকালেও স্পেন ইসলামের মন্ত্রে মুগ্ধ ছিল। এখনকার চাইতে ঢের বেশি। সবক্ষেত্রে ইসলামি সংস্কৃতি তাদের মাঝে বদ্ধমুল ছিল। কিন্তু প্রাচ্যবিদরা কী করেছিল? চুপে চুপে ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করে। তারপর একেকজন বনে যায় ‘ইসলামি স্কলার’। যখন তারা সমাজের চোখে ধীরে ধীরে মান্য হয়ে উঠে, তখন তারা ইসলামের মাঝে ইঞ্জেকশনের সূচালো মাথা দিয়ে অণুতম ‘বিতর্কবিশ্বাস’ পুশ করে। আর মিডিয়া তাদের হাতে থাকাতে খুব সহজেই এ বিষ ছড়াতে সক্ষম হয়েছিল তারা। যেসব পত্র-পত্রিকা সে সময়ে একাজে নিবিষ্ঠমনে কাজ চালিয়ে গেছে, তার অন্যতম হচ্ছে, কে. গ্র্যাগ সম্পাদিত 'The Moslem World' এবং ফরাসি প্রাচ্যতাত্ত্বিক কর্তৃক প্রকাশিত 'Le Monde Musulman'।
অথচ একবিংশতে এসে মুসলমানদের হা-হুতাশ করা ছাড়া কিছুই বাকি ছিল না। কারণ, মুসলমানরা তো অন্য ধর্মের শিক্ষাই নিতে চায় না। বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করার লোক থোড়াই মিলে। আমার মতে, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রই প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। ইসলামি শিক্ষা ও দীক্ষাপ্রসারের এটি অন্যতম একটি ভিত্তি। বস্তুত মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটই প্রধান সমস্যা। অনেকের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে যেমন স্বচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে, তেমনি ইসলামের শিক্ষা ও এসব শিক্ষার পর্যায়ক্রমিক গুরুত্ব অর্থাৎ কোনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি সাধারণ গুরুত্বের এবং কোনটি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়—এসব ব্যাপারে জ্ঞানের গুরুতর অভাব রয়েছে।
বর্তমানে যে যুগে বাস করছি তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা সম্পর্কেও জ্ঞানের গুরুতর অভাব দেখা যায়। অন্যদের সম্পর্কে মুসলমানদের অজ্ঞতা এমন যে তাদেরকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেই, নয় তো খাটো করে দেখি। অথচ অন্যরা মুসলমানদের সব বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। বস্তুতমুসলমানরা নিজেদের সম্পর্কেও ব্যাপক অজ্ঞ। আজ পর্যন্ত আমাদের শক্তি ও দুর্বলতার দিকগুলো হয়ত কখনোই খতিয়ে দেখা হয়নি। অথচ সামান্য বিষয় নিয়ে অযথা বির্তকে মেতে ওঠি। আমাদের শক্তি-সামর্থ্য অথবা দোষ-ত্রুটি যে দিকেই দেখি না কেন, উভয়ক্ষেত্রে একই অবস্থা। এ অজ্ঞতা কেবল সাধারণ মুসলমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের স্বার্থ এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, যাদের মৌলিক কাজের ওপর ইসলামি আন্দোলন গড়ে উঠবে, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মাঝেও এ অজ্ঞতা প্রকট।
এজন্য এখন যৌবন যার, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করার সময় তার, পাশ্চাত্যবিদ হওয়ার সময় তার। প্রাচ্যবিদ মানে যদি হয় প্রাচ্যের ইতিহাস, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে প্রতীচ্যীয় গবেষণা, তাহলে বিপরীত অর্থে পাশ্চাত্যবিদের মানে দাঁড়াবে—পাশ্চাত্যের ইতিহাস, সভ্যতা, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রাচ্যীয় গবেষণা। এ সংগ্রাম হোক বুদ্ধিবৃত্তির। হোক পাশ্চাত্য বা অন্যকে জানার, আবিষ্কার করার।
লেখক : মাদরাসা শিক্ষক, প্রাবন্ধিক
এফএফ