হাওলাদার জহিরুল ইসলাম; দেওবন্দ থেকে
কওমি মাদরাসায় প্রতি বছরই নতুন করে ভর্তি হওয়ার নিয়ম রয়েছে৷ দারুল উলুমসহ উপমহাদেশের সব কওমি মাদরাসায় শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় রমজানের পর থেকে৷ ঈদের ৭ দিন পর থেকে ভর্তি শুরু হয়৷ দারুল উলুমে ক্লাস শুরু হয় শাওয়াল মাসের শেষের দিকে৷ দারুল উলুমের ভর্তি পরীক্ষা হয় বেশ শক্ত পোক্তভাবে৷ ছাত্ররা এর জন্য এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে৷ পড়তে পড়তে ছাত্ররা রাত দিন একাকার বানিয়ে ফেলে৷ ঈদুল ফিতর নামের আনন্দের দিনটাকেও ভুলে যায়৷
দারুল উলুমে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষাটাই সর্বাধিক গুরুত্ব পায়৷ এই ক্লাসে দেশের বাইরের ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করে৷ ফলে ছাত্রদের মাঝে প্রতিযোগিতাটাও হয় খুব বেশি৷ অন্য ক্লাসের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি ছাত্র দাওরায়ে হাদিসের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকে৷ একদিনে দুই কিতাব করে মোট ছয় কিতাবের লিখিত পরীক্ষা হয়৷ একটি পরীক্ষার পর একদিন বিরতি থাকে৷ ভর্তি পরীক্ষার কোনো খাতা দারুল উলুমের শিক্ষকগণ দেখেন না৷ বরং দেশের বড় বড় মাদরাসার বিজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে খাতা দেখানো হয়৷ যাতে দারুল উলুমের প্রতি পক্ষপাতিত্বের সামান্য অভিযোগও না ওঠে৷ পরীক্ষার প্রায় দশদিন পর রেজাল্ট প্রকাশিত হয়৷
দেওবন্দের দাওরা হাদিসে অতিরিক্ত ৬৫০ ছাত্র ভর্তির সিদ্ধান্ত
সব কওমি মাদরাসায়ই ছাত্রদের জন্য আবাসিক থাকাওয়ার ব্যবস্থা থাকে৷ কোনো কোনো মাদরাসায় ছাত্রদের থেকে মাসিক চার্জ নেয়া হয়৷ দারুল উলুমে ছাত্রদের থেকে কোনো প্রকারের বেতন বা চার্জ নেয়া হয় না৷ থাকা, খাওয়া, বিদ্যুৎ, পানি সবই মিলে ফ্রীতে৷ কেবল ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেই হয়৷ প্রতি বছরই দাওরায়ে হাদিস জামাতে নতুন করে ছাত্র নেয়া হয়৷ মেশকাত জামাত শেষ করে আসা ৫/৬ শ' ছাত্রের বাইরে প্রায় পাঁচ শ' নতুন ছাত্র নেয়া হয়৷ এ বছরও তাই হয়েছিলো৷ কিন্তু হঠাৎই দারুল উলুমের ১০০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে ফলাফল প্রকাশের সাত দিন পর নতুন করে আরো ৬০০ ছাত্রের তালিকা প্রকাশ করা হয়৷ (ফলে দাওরা হাদিস জামাতের ছাত্রসংখ্যা বেড়ে দাড়ায় প্রায় ১৮ শ'র কোঠায়৷) নোটিশে ঘোষণা আসে তাদেরও দাওরায়ে হাদিসে ভর্তির সুযেগ দেয়া হবে৷ হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ইমতিহান দেয়া ছয় শ' ছাত্রের(যাদের নাম প্রথম প্রকাশিত তালিকায় আসেনি)মুখে হাসি ফোটে৷ স্বপ্নভঙের বেদনা ভুলে যায় মুহূর্তের মধ্যে৷
তবে মাদরাসার পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানো হয় যে আপাতত এই ছয় শ' ছাত্রের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ বহন করতে পারছে না৷ ছাত্ররা এতে কোনো আপত্তি জানায় নি৷ 'প্রাণের দারুল উলুমে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি এতেই আমরা সন্তুষ্ট'_এমনই ছিলো তাদের মনোভাব৷ বিষয়টা আসলেই সময় সাপেক্ষ৷ এতো মানুষের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা চাট্টিখানিক কথা নয়৷ ছাত্ররা নিজ খরচে দেওবন্দের বিভিন্ন গলিতে বাসা নিয়ে থাকতে লাগলো৷ আর নিয়মিত হাজির হতে থাকলো 'ক্বালা ক্বালা হাদ্দাসানা'র স্বপ্নিল দরসে৷
এদিকে কিছু দিন পর দারুল উলুমের মজলিসে শূরা'র অধিবেশন বসে৷ নানা আলোচনা পর্যালোচনার পর মাদরাসার বার্ষিক বাজেটে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব গৃহীত হয়৷ মাদরাসার নির্মাণ ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান, মসজিদে রশিদের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা শিল্পের ডিজাইনার, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বাজেট প্রণয়নকারী, শায়খ আবদুল খালেক মাদরাজি সাহেব দামাতবারাকাতুম নতুন করে বাজেট ঘোষণা করেন৷ আবাসিক হোস্টেলের চলমান নির্মাণ কাজ আরে দ্রুততর করা হয়৷ নিয়োগ করা হয় দিগুণ শ্রমিক৷ এভাবে চলে যায় অনেকটা সময়৷ কুরবানীর ঈদের পরও প্রায় এক মাস অতিবাহিত হয়ে যায়৷
ছাত্রদের কাঙ্খিত দিনটি চলে আসে হঠাৎই৷ গত চৌদ্দ-ই মহররম(১৬ নভেম্বর) মাদরাসার প্রশাসনিক বিভাগের প্রধান মাওলানা মুনির আহমদ সাহেবের স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ জারি করা হয়৷ তাতে জানানো হয়, 'দাওরায়ে হাদিসের যে সব ছাত্রদের আবাসিক থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়নি তারা যেনো অতিসত্বর প্রশাসনিক দফতরে যোগাযোগ করে নিজ নিজ সিট ও খাবার টিকেট নিশ্চিত করে৷' মসজিদে রশিদের পশ্চিম পাশে নব নির্মিত এশিয়ার সর্ব বৃহৎ লাইব্রেরির ২য় তলায় অস্থায়ীভাবে ছাত্রদের থাকার অনুমতি দেয়া হয়৷ ওদিকে বোর্ডিংয়ে সবার খানার ব্যাপারটিও নিশ্চিত করা হয়৷ সবাইকে শীশা ও সিলভার দিয়ে তৈরী নতুন খাবার টিকেট প্রদান করা হয়৷ এর মধ্য দিয়ে দারুল উলুম তার সন্তানদের অসুবিধা ও কষ্টগুলো দূর করার প্রয়াস পেলো৷
আগামী বছরের নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার পূর্বেই এ অস্থায়ী আবাস সরিয়ে নেয়া হবে৷
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারত উপ মহাদেশের মুসলমানদের ওপর নেমে ভয়ংকর অন্ধকার সময়৷ কৃষি, ব্যবসা, জমিদারি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিত্ত-বৈভব সব কিছু থেকেই চরমভাবে বিতাড়িত হচ্ছিলো মুসলমানগণ৷ মুসলমানদের ঐতিহাসকিভাবে দুর্বল করে একটি ব্যর্থ সামাজে পরিণত করতে দখলদার বৃটিশ সরকার একের পর এক গুড়িয়ে দেয় মুসলিম-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো৷ কোটি কোটি টাকার ওয়াকফ সম্পত্তি কুক্ষিগত করে নেয় বৃটিশ হানাদার বাহিনী৷ বৃটিশ-রাজ প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের প্রধান অন্তরায় মনে করায় অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠির তুলনায় মুসলমানরাই সর্বাধিক নির্যাতিত হয়৷ লক্ষ লক্ষ আলেমকে প্রকাশ্য রাজপথে নির্মমভাবে শহিদ করে দেয়া হয়৷ ফলে এক সময় গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর আলেমশূন্য হয়ে পড়ে৷ অবস্থা এতোই নাজুক হয়ে পড়েছিলো যে জানাজা পড়ানোর মতে একজন লোক খুঁজে পাওয়া যেতো না!
মুসলামনাদের ঈমান, আমল, কুরআন, সুন্নাহ সংরক্ষণের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ১৮৬৪ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ নামক এলাকায় 'আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম দেওবন্দ' নামে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি মাদরাসা৷ এর মূল ফাউন্ডার হিসেবে কাজ করেছিলেন ছয় জন মনীষী৷ যাদের প্রধান ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতাবি রহ. পরবর্তীতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে মাদরাসাটি অসাধারণ ভূমিকা পালন করে৷ দারুল উলুমের সূর্যসন্তান শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদুল হাসান রহ.-এর ঐতিহাসিক রেশমি রুমাল আন্দোলন বৃটিশ সরকারের ভিত নড়বড়ে করে দেয়৷ এই শাইখুল হিন্দ-ই ভারত স্বাধীনতার অন্যতম নায়ক, করম চাঁদ গান্ধীকে 'মহাত্না গান্ধী' উপাধি দিয়ে হিন্দু মুসলিমের মাঝে ঐতিহাসিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন৷ ফলে অল্প দিনের মধ্যেই বৃটিশরা ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়৷ মাদরাসাটি একের পর এক এমন হাজারো অবদান রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে৷ মজার ব্যাপার হলো এতো বড় বড় অবদান রাখা মাদরাসাটি ছিলো সম্পূর্ণ সরকারি সাহায্য ও আনুকুল্য মুক্ত৷ আজও মাদরসাটি তার সেই নীতি বজায় রেখেছে৷ সময়ের তালে তালে এ মাদরাসাটির শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতবর্ষে৷ বরং পৃথীবিজুড়েই রয়েছে এর অনুকরণে হাজার হাজার মাদরাসা৷ তাই দারুল উলুমকে বলা হয় উম্মুল মাদারিস বা কওমি মাদরাসার শিকড়মূল৷
আরআর