রোকন রাইয়ান
গত ৫ বছর যাবত ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের শিকার সিরিয়া। ভয়ঙ্কর এ গৃহযুদ্ধের গল্প শুনলে শরীর শিউরে উঠে। সিরীয় বাহিনী, আইএস এবং আমেরিকা রাশিয়াসহ শক্তিধর দেশগুলোর ক্রমাগত দাবার ঘুটি চালাচালিতে শহরগুলো এখন মরুভূমি। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে লাখ লাখ বসতি। ফসলের ক্ষেতগুলোতে হচ্ছে বুলেটের চাষ।
সিরিয়ায় এত পরিপাণ নৃশংতা হয়েছে যা দেখার পর অন্তরে রক্তনদী বইতে থাকবে। দেশটির সবচে বড় শহর আলেপ্পোতে এতটাই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে যেখানে এখন পা রাখার মতো জায়গা নেই। ইট কঙ্কর আর বুলেটের খোসার দলখে প্রতি ইঞ্চি মাটি। শহরটি বাস্তবে দেখার পর মনে হবে কিয়ামত দিনের ভয়াবহতা ছুঁয়ে গেছে এখানে।
এক সময় এই সিরিয়ায় যেখানে ছিল প্রাচীন ঐহিত্যে ভরপুর এক মনোরম দৃশ্যের সম্মিলন এখন সেখানে ধুধু বালি। এখানে মানুষের বসতি তো দূরে থাক কাক পক্ষিকেউ এই আকাশে উড়তে দেখা যায় না। কিছু মানুষ যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই বলে ঘুপের আড়ালে কোনোরকম রাত পাড় করেন তাদের বুকেও প্রতি মুহূর্তে বাজতে থাকে হাতুড়িপেটা।
আলেপ্পোয় জন্ম নেয়া রেস্টুরেন্ট মালিক কার্লো ওহাইনিন বলেন, আমরা কখনো ভাবতে পারিনি এত শান্ত শহর এভাবে ধ্বংস্তুপে পরিণত হবে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিডিয়াকে বলেন, বিশ্বের বিবেকহীনরা একটি বারের জন্য হলেও দেখুন আমরা কী পরিমাণ কষ্ট বুকে চেপে রাত পাড় করি। আমাদের শহর ও বসতিতে কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
ওহাইনিন ২০১২ থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের বেশ কিছু ছবি নিজের কাছে রেখেছেন। মিডিয়া কথা বলতে এলেই তিনি এসব দেখান। ছবিগুলোতে পূর্বের শান্ত সিরিয়া আর বর্তমানের ধ্বংসলীলার ছাপ রয়েছে নিখুঁতভাবে।
ওহাইনিন বলেন, আমাদের শহর ছিল টুকটুকে ফুলের মতো, মার্কেট ছিল প্রাণবন্ত, মসজিদ ছিল শান্ত সুনিবিড়, শিক্ষালয়গুলো ছিল জ্ঞানপিপাসু শিশু কিশোরের পদভারে মুখরিত, পরিবারগুলোতে ছিল চক্ষু শীতল করা সুখ। কিন্তু এসব এখন কল্পজগতের গল্প। এখন বাবা জানে না তার ছেলে কোথায়, মা জানেনা তিনি সংসারি মানুষ, শিশুরা জানেনা এটা একুশ শতকের উন্নত পৃথিবী। গুহায় বসবাসরত মানুষগুলো মাঝে মাঝে ভাবে ঐশরিক কোনো টাইম মেশিনের মাধ্যমে তারা হাজার বছর পেছনে চলে এসেছে।
আসুন ছবিগুলোতে দেখি সভ্য মানুষের বোমায় কিভাবে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে সিরীয় প্রাচীন শহর আলেপ্পো।
এটি ছিল আলেপ্পোর এক প্রাচীন বাজার। যেখানে লুঙ্গি টিশার্ট থেকে শুরু করে পাওয়া যেত স্বর্ণলঙ্কার। শহরবাসীর পদভারে মুখরিত থাকত প্রতিটি সময়। কিন্তু বর্তমানের চিত্রটি দেখলে মনে হবে এই শহরে কেউ কখনো পা-ই রাখেনি।
এই ছবিতে দেখা যাচ্চে শান্ত রাস্তাটিতে এক দম্পতি হাঁটছেন। কিন্তু একই রাস্তার বর্তমানের ছবিটি দেখে মনে হবে দ্বিতীয় যুদ্ধের পর কোনো ইউরোপীয় শহর।
এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে সিরিয়ার ঐতিহাসিক এক কেল্লায় উড়ছে দেশটির পতাকা। আর নিচের ছবিতে প্রাচীন এই কেল্লা পরিণত হয়েছে কবরস্তানে।
এটি কার্টন সিটাডেল নামের আধুনিক এক হোটেল যা ছিল পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু বর্তমানে এই হোটেলটি পুরোই ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে। এখানে এখন শুধু কঙ্করই চোখে পড়ে।
এটিও একটি আন্তর্জাতিক মানের হোটেল যেখানে ছিল নজরকাড়া সুইমিংপুলসহ অত্যাধুনিক সব আয়োজন। কিন্তু বর্তমানের ছবিটিতে সুইমিংপুল বোঝা গেলেও সেখানে পানির পরিবর্তে রয়েছে ইট আর পাটকেল।
এটি ছিল বাচ্চাদের খেলার স্থান। উপড়ের ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাচ্চারা ফুটবল খেলছেন কিন্তু নিচের ছবি দেখলে ডাস্টবিন ছাড়া অন্য কিছু মনে হওয়ার সুযোগ নেই।
এটিও একটি হোটেল বা বিনোদনস্পট। যেখানে মানুষ খোলা মাঠে সুসজ্জিত টেবিলে বসে খাবার খেতেন আর অবসর কাটাতেন। কিন্তু একই স্থানের বর্তমান চিত্র আপনাকে মর্মাহত করবে।
এই ছবিটিও সিরিয়ার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি স্থাপনার। কিন্তু বোমার আঘাতে এটি এখন অকেজো এক কুঠুরি মাত্র।
গত এপ্রিলে দেয়া জাতিসংঘের এক হিসেব অনুযায়ী দেশটিতে গৃহযুদ্ধে প্রাণহানি ঘটেছে ৪ লাখ মানুষ। তবে বেসরকারিভাবে সংখ্যাটি কয়েকগুণ বেশি। কার এর আগে একটি পত্রিকায় এসেছিল সিরিয়ায় গত পাঁচ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে প্রাণহানীর সংখ্যা ২০ লাখ। আর দেশটি ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয়ের জন্য ছুটে গিয়েছেন ২ লাখেরও বেশি মানুষ।
উর্দু দৈনিক পাকিস্তান অবলম্বনে