মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী
সরকার কর্তৃক কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি বা সনদ প্রদান ফুজালায়ে কওমীর জাতীয় অধিকার। সুতরাং এটার প্রয়োজন নিয়ে ভাবার অপেক্ষা রাখে না। তবে যারা এর পক্ষে বলেন, তারাও কওমীর মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই বলেন এবং যারা এর বিপক্ষে বলেন, তারাও কওমীর কল্যাণের চিন্তা করেই তা বলেন। সুতরাং কারো দৃ্ষ্টিভঙ্গিই অবহেলা করার মতো নয়।
তবে এক্ষেত্রে আমার মত হলো, যদি কওমী মাদরাসাকে কওমী রেখেই সরকার স্বীকৃতি দেয় অর্থাৎ কওমী স্বকীয়তা বজায় থাকে এবং দেওবন্দ মাদরাসার আদলে স্বীকৃতি হয়, তাহলে তা গ্রহণ করা উচিত। এতে কওমী আলেমগণের দ্বারা দেশ ও সমাজ বেশী উপকৃত হতে পারবে আশা করি।
বস্তুত এ ভারত উপমহাদেশে বৃটিশ-ইঙ্গদের উপনিবেশের পূর্বে তদানীন্তন দরসে নিজামীর কওমী মাদরাসাগুলো সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানরূপে বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু বৃটিশ সরকার এসে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার বিরুদ্ধে খড়গ চালিয়ে তৎকালীন কওমী মাদরাসাগুলোর এলোট বাতিল করে এ মাদরাসাগুলোকে প্রশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর কালক্রমে তীব্র আন্দোলনে এদেশ থেকে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও তাদের কারিকুলামই চালু থাকে।
অতঃপর মুসলিম স্বান্ত্রত্য চেতনায় ভারত থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন মুসলিম দেশরূপে ‘পাকিস্তান’ আত্মপ্রকাশ করে। এরপর স্বাধীকারের আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামে এদেশের বাংলাভাষী মুসলমানদের স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়।
ইতিহাসের এ পরিক্রমায় এ মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশে একের পর এক অনেক মুসলিম শাসক রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার মূলধারা কওমী মাদরাসার উপর আপতিত বৃটিশী সেই খড়গই বহাল রয়েছে। তাই সময়ের বড় দাবী হয়ে পড়েছে–আমাদের জাতীয় শিক্ষাকে বৃটিশের সেই ইসলামী শিক্ষা সংকোচন নীতির রাহুগ্রাস থেকে বের করে আনা। সুতরাং এ পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষার ধারক কওমী মাদরাসাগুলোকে জাতীয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় মূল্যাবোধের যথাযথ সংরক্ষণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
তাই কওমী মাদরাসার স্বীকৃতির জন্য কোন প্রকার দাবী বা আন্দোলন ছাড়াই নৈতিকভাবেই সরকারের কর্তব্য হয়ে যায় বিষয়টির দিকে বাস্তবতার নিরিখে নজর দেয়ার। কিন্তু তারপরও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ নিয়ে এ যাবত বহু আন্দোলন হয়েছে।
বর্তমান সরকারের কওমী সনদের স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণকে বাস্তবতার উপলব্ধি ও বিগত সরকারের ব্যর্থতাকে জয় করার পদক্ষেপ বলেই আমি মনে করি। অবশ্য অনেকে এটাকে আপত্তিকর শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রমের বিরুদ্ধে কওমী বোর্ড ও কওমী উলামায়ে কিরামের চলমান আন্দোলনকে দমন করার কৌশল বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সে কথা কতটা সঠিক বা বেঠিক বা এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা কতটুকু--সময়ই তা বলে দিবে।
এ ধারায়ই বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে কওমী উলামা-মাশায়িখের নেতৃত্ব বিভিন্নরকম আন্দোলন হয়েছে। এক্ষেত্রে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)ও মুফতী ফজলুল হক আমিনী (রহ.) জোরালো ভূমিকা পালন করেন। উলামায়ে কওমীর সেই আন্দোলনের ধারায়ই ১৫ এপ্রিল-২০০৫ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে কওমী ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণে জাতীয় ছাত্র কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। তেমনিভাবে ২৫ মে-২০০৬ জাতীয় উলামা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তখন রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ ও গণমিছিলে আন্দোলন তীব্রতর হয়। এরপর ৫ জুলাই-২০০৬ মুক্তাঙ্গনে গণমিছিল হয়। সেখান থেকে ১৬ আগষ্ট-২০০৬ পল্টনে ঐতিহাসিক মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৬ আগষ্ট-২০০৬ পল্টন ময়দানে কওমী সনদের স্বীকৃতির দাবিতে সর্ববৃহৎ মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) ঘোষণা করেন–‘ স্বীকৃতি ছাড়া আমরা ঘরে ফিরে যাবো না।’ সে সময় উত্তাল জনস্রোতকে সাথে নিয়ে মুক্তাঙ্গনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেন শাইখুল হাদীস (রহ.)। লাগাতার ৫ দিন সেই অবস্থান কর্মসূচি চালানোর পর সরকার কওমী মাদরাসাকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে তাদেরকে আশ্বস্ত করে।
সেই প্রেক্ষিতে ২১ আগষ্ট-২০০৬ তৎকালীন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার কওমী মাদরাসা শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতির ঘোষণা দেয় এবং এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেই সরকারের গৃহিত এ পদক্ষেপ প্রত্যক্ষ করে কওমী অঙ্গনের সকলে ধারণা করে নেন যে, কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি হয়ে গিয়েছে। তাই তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বাইতুল মুকাররমের উত্তর গেটে মুফতী ফজলুল হক আমিনী (রহ.)-এর আহবানে উপস্থিত কওমী উলামা-ত্বালাবা সেই সরকারপ্রধানকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুকরিয়া সমাবেশ করেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরে কোন অশুভ শক্তির কারসাজিতে তা বাস্তবতার আলো দেখার পরিবর্তে মূলো হয়ে ঝুলে থাকে। কওমীর স্বীকৃতির সরকারী প্রজ্ঞাপন কার্যকরি করা হয় না।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেই প্রজ্ঞাপনকে আমলে আনা বা কার্যকর করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে তা তথৈবচ ঝুলে থাকে।
অতঃপর বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় সরকার ক্ষমতা গ্রহণের প্র্রথম টার্মে কওমী মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করলেও তা কার্যকারিতার রূপ পায়নি। তারপর এ সরকার দ্বিতীয় টার্মে ক্ষমতায় এসে দেশের সকল শিক্ষাধারাকে সরকারী আওতায় আনার পদক্ষেপ হিসেবে কওমী মাদরাসাকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু কওমী অঙ্গনের প্রতিনিধিদের অনৈক্য ও অনাগ্রহকে দায়ী করে তা বাস্তবায়নে সময় ক্ষেপন করা হয়। ফলে কওমী সনদের স্বীকৃতির বিষয়টি বিলম্বিত হতে থাকে।
এ পর্যায়ে কওমী মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থার স্বীকৃতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল ১৭ সদস্যের একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের আমীর শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে এবং কো-চেয়ারম্যান করা হয় মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদকে ও সদস্য সচিব করা হয় মাওলানা রুহুল আমীনকে। কিন্তু বেফাকসহ বিভিন্ন কওমী বোর্ড ও বহু কওমী উলামায়ে কিরাম নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ ও মাওলানা রুহুল আমীন সাহেবকে মেনে নেননি। যার কারণে সেই কমিটি সবার নিকট গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবুও সরকার সামনে অগ্রসর হয় এবং উক্ত কমিটির উপস্থিত সদস্যবৃন্দের দ্বারা কওমী নেসাব সংস্কারের রূপরেখাসহ কওমী সনদের স্বীকৃতির কার্যক্রম এগিয়ে নেয়।
এরপর কার্যকরভাবে কওমী সনদের স্বীকৃতির বিষয় বেগবান করার লক্ষ্যে সম্প্রতি ২৭ সেপ্টেম্বর--২০১৬ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৯ সদস্যের একটি নতুন কমিটি গঠন করে। কিন্তু এতেও উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের নেতৃত্ব কার্যকর থাকায় বেফাকসহ বিভিন্ন কওমী মাদরাসা বোর্ড ও বহু উলামায়ে কিরাম সেই কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেন এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন দাবী পেশ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান। তাদের আপত্তির মুখে ইতোমধ্যে সরকার পূর্বের ১৭ সদস্যের কমিটিকে পরবর্তী তিনমাসের জন্য মেয়াদ বাড়িয়ে সচল করেছে। তবে সে কমিটি নিয়েও পূর্ববর্ণিত কারণে টানাপোড়েন পূর্ব থেকেই রয়েছে।
তবুও বিভিন্নরূপে বর্তমান সরকারের কওমী সনদের স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণকে বাস্তবতার উপলব্ধি ও বিগত সরকারের ব্যর্থতাকে জয় করার পদক্ষেপ বলেই আমি মনে করি। অবশ্য অনেকে এটাকে আপত্তিকর শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রমের বিরুদ্ধে কওমী বোর্ড ও কওমী উলামায়ে কিরামের চলমান আন্দোলনকে দমন করার কৌশল বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সে কথা কতটা সঠিক বা বেঠিক বা এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা কতটুকু সময়ই তা বলে দিবে।
কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি বিষয়ে সকল কওমী প্রতিনিধিগণের অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন। যাতে সেই স্বীকৃতি কওমী অঙ্গনে বিভাজন সৃষ্টি না করে। অন্যথায় কওমী মাদরাসাগুলো দু’ভাগ হয়ে ‘সরকারী কওমী মাদরাসা’ ও ‘বেসরকারী কওমী মাদরাসা’ রূপে দু’ধারা চালু হবে–যা আলিয়া মাদরাসার সাথে মিলে ত্রিধারার রূপ পরিগ্রহ করবে। আর তা সুফল বয়ে আনার পরিবর্তে পারস্পরিক রেষারেষি ও বিভেদকেই উস্কে দিবে। তাই সরকারের উচিত, এ বৃহত্তর কাজকে বিচ্ছিন্নভাবে সমাধা না করে যথাসম্ভব সকল কওমী প্রতিনিধিগণকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস চালানো।
এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবানকে আমলে নেয়া যেতে পারে। সম্প্রতি তিনি কৃষি ইন্সটিটিউটের উলামা সম্মেলনে এক বক্তৃতায় বলেছেন, “আমরা কওমী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে চাই। তাদেরকে রাস্ট্রীয় কাঠামোতে এনে সরকারী স্বীকৃতি দিতে চাই। আপনারা বোর্ড গঠন করে আমাদের কাছে আসুন।”
এ বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবান বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তা হলো, “আপনারা বোর্ড গঠন করে আমাদের কাছে আসুন।” এর মানে হচ্ছে–কওমী বোর্ডগুলোর অনৈক্যের কারণে সরকারের গৃহিত কওমী স্বীকৃতির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই তিনি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বীকৃতি গ্রহণের জন্য বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর দেখা যাচ্ছে, দেশের কওমী আলেম সমাজের মধ্যে কওমী সনদের স্বীকৃতির ব্যাপারটি নিয়ে নতুন করে আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। তদুপরি কওমী সনদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য সম্প্রতি নতুনভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করার পর দেশের কওমী মাদরাসাসমূহের বোর্ডগুলো সজাগ হয়ে এ পরিস্থিতিতে কর্তব্য নির্ধারণে তৎপর হয়েছে।
সুতরাং এমতাবস্থায় অনায়াসে সকল বোর্ডের প্রতিনিধিগণকে একসাথে করে তাদের ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণে কওমী সনদের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। আর তা-ই সার্বিকভাবে সকলের জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে আমি মনে করি।
আমাদের অত্যন্ত সচেতনতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কওমী মাদরাসা শিক্ষার জাতীয় শিক্ষারূপে স্বীকৃতি ফুজালায়ে কওমিয়্যার জাতীয় অধিকার। কারো ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা অমূলক পদক্ষেপে যেন তাদের সেই অধিকার যুগ যুগ ধরে শুধু মুলো হয়ে ঝুলে থাকার ভাগ্যবরণ না করে। তাই ব্যক্তিগত স্বার্থদ্বন্দ্ব বা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষকে এখানে প্রশ্রয় দেয়া উচিত হবে না। কে কোন নেতৃত্বের সাপোর্টার বা কোন সরকারের মাধ্যমে স্বীকৃতি নিলে কী স্বার্থ হাসিল হবে-সেই ক্ষুদ্র চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সার্বিকভাবে কওমীর কল্যাণকেই মুখ্য করতে হবে।
এ জন্য যেহেতু বিগত সরকার সুযোগ পেয়েও তা বাস্তবায়ন না করে ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছে, তাই এখন নগদ হিসেব করাই যুক্তিযুক্ত মনে করি। তা ছাড়া কওমীর ঐতিহ্য কওমীকেই রক্ষা করতে হবে-এ জন্য সরকারে কে আছে সেটা মূল বিবেচ্য নয়। এভাবে সকলের আত্মস্বার্থ বিসর্জন ও উদার নীতির প্রতিফলনই এখানে কাম্য।
এ অবস্থায় বেফাকের পক্ষ থেকে যে কওমী ঐক্যের চেষ্টা করা হচ্ছে, তা সময়ের দাবী পূরণে ভাল উদ্যোগ। দু‘আ করি, সেটা সফল হোক।
তবে বেফাকের এ উদ্যোগে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া না গেলে, অযথা সময় ক্ষেপন না করে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা এভাবে করা যেতে পারে যে, সকল বোর্ডকে একিভূত করে ঐক্যবদ্ধভাবে কওমী স্বীকৃতি গ্রহণের জন্য সকল বোর্ডের মাঝে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে একটি ‘লিয়াজোঁ বোর্ড’ গঠন করা যেতে পারে, যার মধ্যে দেশের সকল কওমী বোর্ডের সমান অংশীদারিত্ব থাকবে। আর তা গঠনের প্রক্রিয়া এই হবে যে, প্রথমে একজন সর্বজন গ্রহণীয় আলেমের নেতৃত্বে সকল কওমী উলামায়ে কিরামকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালাতে হবে। এ জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব রূপে হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফী সাহেব (দা. বা.) আমাদের মাঝে আছেন। তাই তাঁকে মুরব্বী বানিয়ে কিংবা সেরূপ কোন মুরব্বী নির্বাচন করে প্রথমে সকল কওমী বোর্ডের প্রতিনিধিবৃন্দ ‘কওমী উলামা-প্রতিনিধি কমিটি’ রূপে একক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হবেন। এরপর তারা সকলে মিলে একটি একক কওমী লিয়াজোঁ বোর্ড গঠন করবেন। তারপর বেফাকসহ দেশের সকল কওমী বোর্ডকে সেই লিয়াজোঁ বোর্ডের আন্ডারে ঐক্যবদ্ধ করবেন। এভাবে সকল বোর্ডের প্রতিনিধিগণ মিলে সম্মিলিতভাবে একক বোর্ড গঠন করলে তার মাধ্যমে কওমী স্বীকৃতির যাবতীয় কাজ আনজাম দেয়া সহজ হবে। আর তা সকলের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হবে আমি মনে করি।
কর্তৃপক্ষকে যথার্থ কওমী প্রতিনিধি হতে হবে। এর প্রত্যেক সদস্যকে সম্পূর্ণরূপে কওমী স্বার্থ সংরক্ষণকারী ও কওমী আদর্শের যথাযথ ধারক-বাহক হতে হবে। যাতে তারা কওমীর ঐতিহ্য ও নীতি-আদর্শ রক্ষার প্রশ্নে সরকারের সাথে কোনরূপ আপোষ না করেন। তাহলেই কওমীর স্বকীয়তা বজায় রাখার সাথে কওমী শিক্ষার সনদ লাভ সম্ভব হবে আশা করি।
কওমী সনদের সরকারী স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে সরকার কওমী মাদরাসা শিক্ষাকে প্রচলিত জাতীয় শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যশীল করার জন্য কওমী মাদরাসার সিলেবাসভুক্ত দ্বীনী কিতাবাদির সাথে কিছু জাগতিক জ্ঞানের বই-পুস্তক তথা, সায়েন্স, কমার্স, কম্পিউটার-নলেজ প্রভৃতি সংযোজনের ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে সেটা সরকারের মাধ্যমে নয়, বরং কওমী উলামা-প্রতিনিধিগণের মাধ্যমে বা কওমী লিয়াজোঁ বোর্ডের মাধ্যমে হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে-সরকারী স্বীকৃতিতে কওমী মাদরাসা যেন ‘সরকারী মাদরাসা’ তথা আলিয়া মাদরাসা হয়ে না যায়।
অবশ্য সরকার ১৫ অক্টোবর-২০১৬ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ‘কওমী মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়া’ নামে কওমী মাদরাসা শিক্ষা সনদ প্রদান বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষ গঠন ও তৎসংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালার প্রস্তাবিত খসড়া প্রকাশ করেছে। সেই কওমী কর্তৃপক্ষের নীতিমালা দ্বারা বুঝা যায়- কওমী মাদরাসার শিক্ষা সনদ প্রদান বাস্তবায়নের জন্য সরকারের মাধ্যমে গঠিত কর্তৃপক্ষ এতদসংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সর্বময় ক্ষমতা প্রাপ্ত হবে। এ কর্তৃপক্ষ এখনো গঠন করা হয়নি। নীতিমালা চূড়ান্ত করার পর সেই আলোকে গঠন করা হবে। সরকার এ কর্তৃপক্ষকেই কওমী মাদরাসার সিলেবাস সংস্কার, পরিচালনার নীতিমালা তৈরী প্রভৃতি বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিবে--যা এ কর্তৃপক্ষের দ্বারা বাস্তবায়িত হবে।
সুতরাং এ কর্তৃপক্ষকে যথার্থ কওমী প্রতিনিধি হতে হবে। এর প্রত্যেক সদস্যকে সম্পূর্ণরূপে কওমী স্বার্থ সংরক্ষণকারী ও কওমী আদর্শের যথাযথ ধারক-বাহক হতে হবে। যাতে তারা কওমীর ঐতিহ্য ও নীতি-আদর্শ রক্ষার প্রশ্নে সরকারের সাথে কোনরূপ আপোষ না করেন। তাহলেই কওমীর স্বকীয়তা বজায় রাখার সাথে কওমী শিক্ষার সনদ লাভ সম্ভব হবে আশা করি।
এক কথায় বলতে গেলে কওমীকে কওমী হিসেবেই সরকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। তাই কওমী মাদরাসাসমুহের পা্ঠ্যক্রম-সিলেবাস, শিক্ষা-কারিকুলাম, নীতি-বিধি সবই কওমী কর্তৃপক্ষ তথা সেই ঐক্যবদ্ধ কওমী উলামা-প্রতিনিধিবৃন্দ বা কওমী লিয়াজোঁ বোর্ড কর্তৃকই প্রণীত হওয়া আবশ্যক। আর সরকারের নিয়োজিত ‘কর্তৃপক্ষ’ শুধু তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী হবেন। সুতরাং কওমী লিয়াজোঁ বোর্ডই প্রয়োজনে সময়োপযোগী আবশ্যকীয় বিষয়াদি যুক্ত করে কওমী শিক্ষাকে কাঙ্ক্ষিত মানে উত্তীর্ণ করবেন। এক্ষেত্রে সরকার বা সরকার কর্তৃক গঠিত কর্তৃপক্ষ শুধু সেসব নিরীক্ষণ করতে পারবেন এবং অনুমোদন দিতে পারবেন। কিন্তু সরকার বা কর্তৃপক্ষ সেসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। সেগুলো কওমী লিয়াজোঁ বোর্ডই নিয়ন্ত্রণ করবে। এভাবে সরকার যদি কাঙ্ক্ষিত শর্ত মেনে কওমীর স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বীকৃতি দেয়, তাহলেই তা গ্রহণীয় হবে।
কিন্তু সরকার সেসব শর্ত না মানলে, কওমীর স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে স্বীকৃতি গ্রহণ করা কওমীকে ধ্বংস বা আলিয়ায় পর্যবসিত করারই না্মা্ন্তর হবে। যা দারুল উলূম দেওবন্দের চেতনার পরিপন্থী। তাই দারুল উলূম দেওবন্দ-এর আদর্শভিত্তিক কোন কওমী মাদরাসা এরূপ স্বীকৃতি গ্রহণ করতে পারে না।
মোদ্দা কথা, কওমী মাদরাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে সরকার কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি দিলেই কেবল তা গ্রহণযোগ্য হবে। সেই অবস্থায় এর বিরোধিতা করার কোন কারণ থাকতে পারে না। অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে যদি দেওবন্দ মাদরাসা সে দেশের সরকারের স্বীকৃতি নিয়েও স্বকীয়তা বজায় রেখে চলতে পারে, আমাদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে দারুল উলূম দেওবন্দের আদর্শভিত্তিক কওমী মাদরাসাগুলো কেন সরকারের স্বীকৃতি নিয়েও স্বকীয়তা বজায় রেখে চলতে পারবে না?
তাই কামনা করছি, কওমী স্বীকৃতি আর মুলো হয়ে ঝুলে না থাক। অতিসত্বর তা স্বকীয়তার সাথে বাস্তবায়িত হোক। ফারেগীনে কওমিয়্যার জাতীয় অধিকার তথা কওমী শিক্ষার জাতীয় স্বীকৃতি যত তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হবে, দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে কওমী অঙ্গনের নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক উলামায়ে কিরাম তত দ্রুত বলিষ্ঠ অবদান রাখতে পারবেন। এতে শান্তি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে অনেক ধাপ এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় সোনার বাংলাদেশ।
লেখক: সম্পাদক, মাসিক আদর্শ নারী
আরআর