শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল কুরআন-সুন্নাহর আইন ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না : মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী শীত ও শৈত্যপ্রবাহ নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস ফ্যাসিবাদ বারবার ফিরে আসবে, সতর্ক থাকতে হবে: গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা ‘কোনো রাজনৈতিক দলকে সরিয়ে দেয়ার ইচ্ছা জামায়াতের নেই’ শরীরে রক্ত বাড়াতে যেভাবে পালং শাক খাবেন

‘দেওবন্দের জারজ সন্তান’ কিছু কথা, কিছু ব্যথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

rezaul-karim-abrarরেজাউল কারীম আবরার

দেওবন্দ! আমাদের শিকড়। আকাবিরদের চোখের পানি আর কলজের খুনে সিক্ত প্রতিষ্টান। মক্কা, মদীনা এবং বায়তুল মাকদিসের পর আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা! যে মাটি মাড়িয়েছেন হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিম নানুতবী, শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি, মুহাদ্দিসুল আসর আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী, হাকিমুল উম্মাত আশরাফ আলী থানভী, শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী, সে মাটির ভালোবাসা আমার হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। নিজের পরিচয় দেওয়ার কিছুই নেই। শুধু বুক ফুলিয়ে বলতে পারি যে, দেওবন্দের স্বর্ণ কাফেলার আমিও একজন ক্ষুদ্র সদস্য! মূর্খ হওয়া সত্বেও দেওবন্দি চেতনা লালনের চেষ্টা করি। দেওবন্দিয়ত কি? কি কাজ করলে দেওবন্দি হওয়া যাবে? এবিষয়ে প্রথমে কয়েকজন আকাবিরের বক্তব্য তুলে ধরছি।
দারুল উলূম দেওবন্দের সূর্য সন্তান মাওলানা মানযুর নুমানী রহ. রাসূলগণ কবরে জীবিত এবিষয়ে একটি কিতাব লিখেছেন “মাসআলাতু হায়াতিন নাবী” নামে।

সে কিতাবের শেষে তিনি দেওবন্দের বৈশিষ্ট সম্পর্কে আলাচনা করতে গিয়ে লিখেন: “দারুল উলূম এবং আকাবিরে দেওবন্দ হল একটি শিরোনাম। বসুধার সকল উত্তম পন্থা, উত্তম ফিকির এবং প্রত্যেক উত্তম বস্তু হল দেওবন্দিয়ত”। (মাসাআলাতু হায়াতিন নাবী, পৃষ্টা নং, ১৩০)

১৪০০ হিজরীতে দারুল উলূম দেওবন্দের শতবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্টিত হয়েছিল। সেখানে মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. একটি যুগান্তকারী বক্তব্য পেশ করেছিলেন। সে ভাষণে তিনি দেওবন্দের বৈশিষ্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন: দেওবন্দের বৈশিষ্ট হল চারটি।

“এক: এ দরসগাহের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট হল সে মতনৈক্যকে পিছনে ফেলে তাওহীদ এবং সুন্নতের উপর নিজের দৃষ্টি রাখবে।আর এটা এমন ওয়রাছাত এবং আমানত, যা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ ইসমাইল শহীদ এবং সায়্যিদ আহমদ শহীদ এর ওসীলায় এ প্রতিষ্টান পেয়েছে এবং এখন পর্যন্ত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে আছে।
দুই: সুন্নাতের অনুসরণের জযবা এবং ফিকির থাকতে হবে।
তিন: আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরী করার ফিকির, যিকির এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার জযবা থাকতে হবে।
চার: আল্লাহর কালেমা বুলন্দীর জযবা থাকতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে। এ চারটি শিরোনাম যার মধ্যে থাকবে, সে দেওবন্দি। যদি এর মধ্যে কোন একটি কমে যায়, তাহলে সে পূর্ণ দেওবন্দি নয়”। (কারওয়ানে জিন্দেগী, ৩/৩১০-৩১১)

এ প্রসঙ্গে কারী তায়্যিব সাহবে রহ. এর বক্তব্য অবশ্যই বেশ চমৎকার । তিনি বলেন, উলামায়ে দেওবন্দের গুণ হল ‘দিলে দরদমন্দ, ফিকরে আরজুমন্দ, যবানে হুশমন্দ’। অর্থাৎ তারা হবেন দরদী হৃদয়, সমুন্নত চিন্তা এবং সুপ্রাজ্ঞ ভাষার অধিকারী”।

এ বিষয়ে শায়খুল ইসলাম তাকী উসমানী দা.বা. এর ছোট রেসালা “আকাবিরে দেওবন্দ কিয়া থে” অবশ্যই পাঠ করার মত একটি বই। আমাদের আকাবিরদের জীবনের বাকেঁবাঁকে ঘটে যাওয়া ঘটনা পড়ে চোখে অশ্রু চলে আসে! বুক ফুলিয়ে বলতে পারি যে, এরাই আমাদের পিতৃ পুরুষ। আমরা তাদের উত্তরসুরী।

গতকালকের বেফাকের উলামা সম্মেলন নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে! আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদকে ইশারা করে একজন বড় আল্লামা “দেওবন্দের জারজ সন্তান” বলে ফতোয়া দেন! বক্তব্য দিতে দেরী, ফেইসবুকে সেটা আনন্দের সাথে ছড়িয়ে দিতে দেরী হয়নি! সবার শেষ দিকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম আল্লামা আযহার আলী আনোয়র শাহ দা.বা.কে অপদস্থ করা এবং সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আসলেই পুরো কওমিয়্যতের জন্য অশনি সংকেত! সর্বশেষ তাকে উদ্দেশ্য করে ফতোয়া জারী করা যে, তিনিও দেওবন্দের তালিকা থেকে বাদ পড়ে দরবারী আলেমদের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। মুখোশপরা এক ভদ্র লোকতো বলেই দিলেন যে, তিনি অহংকারীদের বাবা! এজন্য মাঝে মাঝে এমন ব্যবহার তার প্রাপ্য!

মতপার্থক্য থাকতে পারে। একজনের কাজ আরকজনের নিকট ভালো নাও লাগতে পারে! স্বীকৃতির ব্যাপারে কারো পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিন্তু “দেওবন্দের জারজ সন্তান” বলা কতটুকু সঠিক? দেওবন্দিয়তের কি নির্দিষ্ট কোন বৃত্ত রয়েছে যে, এর বাহিরে গেলেই জারজ সন্তান? যদি থাকে. তাহলে আমাদের আকাবিররা কোথায় সে বৃত্তের সীমারেখা নির্ধারিত করে গেছেন, কেউ জানালে খুশি হতাম। প্রশ্ন জাগে যে, দেওবন্দের জারজ সন্তান কেন দেওবন্দের শত বার্ষিকী সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করে? দেওবন্দের জারজ সন্তান কেন দেওবন্দের মসজিদে পুরো দেওবন্দের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বয়ান পেশ করে? আকাবিরে দেওবন্দের তত্বাবধানে অনুষ্টিত দিল্লীর রামলীলা ময়দানে কেন বয়ান পেশ করে দেওবন্দের জারজ সন্তান? কেন জারজের সুপারিশে ভর্তি করা হত দারুল উলূমে বাংলাদেশি তালিবুল ইলমদের? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম, বর্তমান মুহতামিম, নায়েবে মুহতামিম, প্রদান মুফতী, উলূমুল হাদীসের মুশরিফ, শুরা সদস্যদের এত দরহম মহরম কেন দেওবন্দের “জারজ সন্তানের” সাথে? তবে কি তারাও দেওবন্দিয়ত বুঝেননা? ধরে নিলাম আনোয়ার শাহ সাহেব টাকার কাছে বিক্রি হয়েছেন? দেওবন্দের এতজন উস্তাদকেও কি জারজ টাকা দ্বারা কিনে নিয়েছেন? নাকি দেওবন্দের ঠিকাধারী আপনাদের হাতে অর্পন করা হয়েছে? আপনারা যাকে বলবেন, দেওবন্দি, তিনিই দেওবন্দি! যারাই আপনাদের মতের অমিল হবে, তারাই জারজ! অথবা দরবারী! বড়দের থেকে এমন অহেতুক বক্তব্য সত্যি দুঃখজনক! রক্তখেকোদের নিয়ে লেখলে যারা নসীহত প্রসব করেন যে, বড়দের ব্যাপারে আপনি নাক গলাতে চান কেন? ঐ সমস্ত লোকগুলো যখন আযহার আলী আনোয়ার শাহকে নিয়ে মারাত্বক বেয়াদবিমূলক পোষ্ট দেন, জানিনা, তাদের আদবের বস্তার মুখ কি তখন বন্ধ থাকে!

সর্বশেষে আসুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু হাদীস শুনি। ইবনে আবদিল বার মালেকী (৪৬৩হি.) একজন প্রথিতযশা ইমাম ছিলেন। “জামিয়ূ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি” নামে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সর্বযুগে তালিবুল ইলমদের নিকট কিতবাটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত। সে কিতাবে তিনি একটি পরিচ্ছেদের নামকরণ করেছেন এভাবে:
باب حكم قول العلماء بعضهم في بعض

ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা কেরেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
« استمعوا علم العلماء ولا تصدقوا بعضهم على بعض فوالذي نفسي بيده لهم أشد تغايرا من التيوس في زروبها »
(জামিয়ূ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২/২৫০. হাদীস নং, ১১১৬৪)

الحسن بن أبي جعفر قال : سمعت مالك بن دينار يقول : يؤخذ بقول العلماء والقراء في كل شيء إلا قول بعضهم في بعض ؛ فلهم أشد تحاسدا من التيوس ، تنصب لهم الشاة الضارب فينيبها هذا من هاهنا وهذا من هاهنا » وقال سعيد في حديثه : فإني وجدتهم أشد تحاسدا من التيوس بعضها على بعض »
(হাদীস নং, ১১১৬৬)
عبد العزيز بن أبي حازم قال : سمعت أبي يقول : « العلماء كانوا فيما مضى من الزمان إذا لقي العالم من هو فوقه في العلم كان ذلك يوم غنيمة وإذا لقي من هو مثله ذاكره ، وإذا لقي من هو دونه لم يزه عليه ، حتى كان هذا الزمان فصار الرجل يعيب من هو فوقه ابتغاء أن ينقطع منه حتى يرى الناس أنه ليس به حاجة إليه ولا يذاكر من هو مثله ويزهى على من هو دونه فهلك الناس »
হাদীস নং, ১১১৬৮)

মালিক, আমাদেরকে সব ধরণের হিংসা এবং অনৈক্য থে হেফাজত কর। মুসলিম উম্মাহর চরম দুর্দিনে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করার তাওফিক দান কর। কারণ, শতাব্দির চাহিদা পূরণে আমাদেরই নিতে হবে আগামী পৃথিবীর ভার।

আরো পড়ুন: বেফাক সম্মেলনে কী বলেছিলেন মাওলানা আনোয়ার শাহ?

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ