আহমাদ আবসার হুসাইন মাদানী
দুর্বলতা মানবজীবনের অবধারিত অংশ। মানুষ সৃষ্টি হয়েছে দুর্বলতা থেকে, প্রত্যাবর্তিতও হবে আরেক দুর্বলতায়। মানব প্রকৃতিতে আল্লাহর রীতিই হলো এ জগতে প্রতিটি মানুষ দুর্বলতার নানা অবস্থা, সামর্থ্যবানের অসামর্থ্য এবং অন্যের মুখাপেক্ষিতার ভেতর দিয়ে যায়। চিন্তাশীল ব্যক্তির জন্য মানুষের অবস্থা, ক্রমিকতা ও বেড়ে ওঠায় দৃষ্টিপাতই যথেষ্ট। সে জন্ম নেয় দুর্বল ও লালন-পালনকারীর মুখাপেক্ষী হয়ে। তারপর সে বড় হয়, আল্লাহ তাকে শক্তি দান করেন। যাতে সে তার যত্ন ও পালনকারীকে উত্তম বদলা দিতে পারে। অতঃপর ফের দুর্বলতায় প্রত্যাবর্তন করে।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ, তিনি দুর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন অতঃপর দুর্বলতার পর শক্তিদান করেন, অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ (সূরা নিসা : ৫৪)।
সুতরাং বাস্তবতা যেহেতু এটিই, তাই প্রত্যেক বুদ্ধিমান বিচক্ষণের কর্তব্য হবে যারা স্থায়ী দুর্বলতা ও দীর্ঘমেয়াদি অক্ষমতার পরীক্ষায় নিপতিত, তাদের প্রতি নজর দেয়া। যে কেউ দুর্বলতার কিছু অবস্থা এবং অক্ষমতার কিঞ্চিৎ চিত্র সামনে আনতে চান, তিনি ওই ছোট্ট শিশু ও শীর্ণ সন্তানদের অবস্থা স্মরণ ও কল্পনা করুন, যার অভিভাবকের বিদায়ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। মৃতপ্রায় লোকটি তাদের রেখে যাচ্ছেন দিনের বিবর্তন, জীবনের রুক্ষতা, প্রত্যাশার কঠোরতা ও চাওয়ার আঘাতের আশঙ্কায়। কামনা করছেন তাদের জন্য উপযুক্ত অভিভাবক, যিনি তার স্থলে তাদের বিকল্প হবেন এবং অব্যাহত রাখবেন তার মমতা-ভালোবাসা। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের ভয় করা উচিত, যারা নিজেদের পশ্চাতে দুর্বল অক্ষম সন্তান-সন্ততি ছেড়ে গেলে তাদের জন্য তারাও আশঙ্কা করে; সুতরাং তারা যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং সঙ্গত কথা বলে।’ (সূরা নিসা : ৯)।
দুর্বল, অক্ষম ও অসহায়- এগুলো অসীম চিত্র ও সীমাহীন সংখ্যার কিছু বিশেষ্য ও উপাধি। দুর্বল, সাহায্যপ্রার্থী ও শক্তিহীনরা হলো অভাবী ও অক্ষম। এরা হলো, ফকির, মিসকিন, অসুস্থ, বিদেশি, মুসাফির, এতিম, বিধবা, মজলুম, শ্রমিক, কয়েদি, মজুর, বিশেষ প্রয়োজনসম্পন্ন, দুর্যোগ ও দুর্ঘটনাকবলিত, বাস্তুচ্যুত ও দেশান্তরিত- ছোট-বড় ও নারী-শিশু নির্বিশেষে যারা নিজেদের প্রাপ্য নিজেরা বুঝে নিতে পারে না, হয়তো ব্যক্তিগত অক্ষমতা কিংবা ক্ষমতাবান, পদধারী জালেমের শক্তি ও দাপটের দরুন। হতে পারে দুর্বল শরীরে, চিন্তায় কিংবা অবস্থা ও প্রয়োজন পূরণে। তারা দুর্বল, কারণ তারা শক্তিমান ও জালিমের মোকাবিলায় শক্তি খুঁজে পান না। তারা নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে কিংবা জুলুম প্রতিহত করতে অক্ষম। সেহেতু তারা দুর্বলতার অধিকারী, যা তাদের কর্মে ও ভাবনায় শক্তির পূর্ণতার অন্তরায়।
এদের ধরন ও বিবরণ জানতে আমরা কোরআন ও সুন্নাহর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিগুলো ভাবনায় আনতে পারি। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘সে বার্ধক্যে পৌঁছবে, তার দুর্বল সন্তান-সন্ততিও থাকবে।’ (সূরা বাকারা : ২৬৬)।
‘তাদের ভয় করা উচিত, যারা নিজেদের পশ্চাতে দুর্বল অক্ষম সন্তান-সন্তাতি ছেড়ে গেলে তাদের জন্য তারাও আশঙ্কা করে; সুতরাং তারা যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং সঙ্গত কথা বলে।’ (সূরা নিসা : ৯)।
‘অতঃপর ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ হয় কিংবা দুর্বল হয় অথবা নিজে লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে অক্ষম হয়।’ (সূরা বাকারা : ২৮২)।
‘দুর্বল, রুগ্ণ, ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ লোকদের জন্য কোনো অপরাধ নেই, যখন তারা মনের দিক থেকে পবিত্র হবে আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে। নেককারদের ওপর অভিযোগের কোনো পথ নেই। আর আল্লাহ হচ্ছেন ক্ষমাকারী দয়ালু।’ (সূরা তওবা : ৯১)।
‘আর তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর রাহে লড়াই করছ না দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের এ জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান করো; এখানকার অধিবাসীরা যে অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষাবলম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও।’ (সূরা নিসা : ৭৫)।
‘অতঃপর সে তার পালনকর্তাকে ডেকে বলল, আমি অক্ষম, অতএব, তুমি প্রতিবিধান করো।’ (সূরা কামার : ১০)।
‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে। আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। আপনি তার আনুগত্য করবেন না যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা।’ (সূরা কাহফ : ২৮)।
তেমনি রাসুল সা. বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতিদের সম্পর্কে অবহিত করব না? (তারা হলো) প্রত্যেক দুর্বল এবং এমন ব্যক্তি যাকে দুর্বল মনে করা হয়। সে যদি আল্লাহর নামে কসম করে তাহলে তা তিনি পূর্ণ করে দেন।’ (বোখারি)। ‘তোমাদের যে কেউ লোকদের ইমামতি করে, সে যেন নামাজ হালকা করে। কেননা মুসল্লিদের মাঝে দুর্বল, অসুস্থ ও প্রয়োজনসম্পন্ন ব্যক্তি থাকেন।’ (মুসলিম)
এসব আয়াত ও হাদিস সামনে রেখে উম্মাহর বিজয়, রিজিকের প্রাচুর্য, কাজেকর্মে বরকত এবং কালেমার একতার জন্য প্রয়োজন দুর্বলের পাশে দাঁড়ানো। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা দুর্বলদের (সেবা ও সহযোগিতার) মাঝে আমাকে অন্বেষণ করো। কেননা, দুর্বলদের দোয়ার কারণেই তোমাদের রিজিক প্রদান এবং সাহায্য করা হয়।’
লেখক: আলেম, মুফতি, গবেষক
খলিফা. আল্লামা আহমদ শফী দা.বা.