রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


শুধু বেফাকের মাধ্যমে কমিশন হলে মতানৈক্য হবে -মুফতি এনামুল হক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

mizanমুফতি এনামুল হক কাসেমী। ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরার প্রধান মুফতি। মুহাদ্দিস। সম্প্রতি সরকার কর্তৃক গঠিত ৯ সদস্যের সাব কমিটির সদস্য। শিক্ষানীতির ব্যাপারে তার মতামত জানতে গতকাল বিকেলে আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি মোস্তফা ওয়াদুদ

মোস্তফা ওয়াদুদ : কওমী সনদের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

মুফতি এনামুল হক : কওমী সনদের ব্যাপারে জানতে হলে একটু শুরু থেকে আসতে চাই। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের মাধ্যমে কওমী সনদের আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। এর ও অনেক আগে গঠিত হয় বেফাক। বেফাককে যদিও জাতীয় বোর্ড বলা হয়। আর অন্যগুলোকে বলা হয় আঞ্চলিক বোর্ড। কিন্তু বাংলাদেশে সর্বপ্রথম গঠিত হওয়া বোর্ড হলো এদারা বোর্ড সিলেট। বৃটিশ পিরিয়ডে ১৯৪৭ সালের আগে এ বোর্ড গঠন করা হয়। এরপর ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান পিরিয়ডে গঠিত হয় এত্তেহাদুল মাদারিস। তারপর সবার ঐক্যমতে এ দুই বোর্ডের সদস্যগণ আরেকটি বোর্ড তৈরি করে। যার নাম বেফাক।
যখন স্বীকৃতির কথা আসলো তখন সবার ঐক্যমতে সিদ্ধান্ত হলো, বেফাকের মাধ্যমে আমরা সরকারী স্বীকৃতি নিবো। ২০০৫ সালে খালেদা জিয়ার মাধ্যমে একটি প্রতিনিধি দল ঠিক করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সরকার আর কোনো চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করতে পারেননি।

এরপর আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ২০১২ সালে ১৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। সে কমিটিতে প্রধান চেয়ারম্যান ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফি। আর কো-চেয়াম্যান ছিলেন ফরিদউদ্দীন মাসউদ সাহেব। সেখানে সদস্য সচিব থাকেন গওহারডাঙ্গার মুফতি রুহুল আমীন খান। আমাকেও সে কমিটিতে রাখা হয়। সে হিসেবে একটি চিঠি আসে আমার কাছে। আমি চিঠির ব্যাপারে আমাদের বড় হজুর ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান সাহেবকে দেখাই। এবং গ্রহণ করা না করার ব্যাপারে পরামর্শ চাই। তখন হুজুর বললেন, যেহেতু কমিটিতে শফি সাহেব আছেন! যদি হুজুর গ্রহণ করেন। তাহলে আপনি গ্রহণ করুন। মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি, সে চিঠিটি হুজুর গ্রহণ করেছেন। এরপর আমিও গ্রহণ করি। এরপর যাচাই বাছাই করে ১৭ সদস্যের সে কমিটি একটি খসড়া তৈরি করে দেন।
পরবর্তীতে সে খসড়ার আলোকে প্রস্তাব পেশ করার জন্য ইয়ারপোর্ট আশকোনায় একটি মিটিং ডাকা হয়। যে মিটিংয়ের দাওয়াত নামায় আল্লামা শাহ আহমদ শফির স্বাক্ষর থাকে। আমি মিটিংয়ে অংশ নেই। পরবর্তীতে মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, মিটিং প্রত্যাখ্যান করেছেন আল্লামা শফি সাহেব। তারপর চলে গেলো অনেক দিন। স্থিমিত হয়ে পড়লো কওমী উলামায়ে কেরাম। সর্বশেষ গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর একটি আশ্বাসের মাধ্যমে কওমী অঙ্গণ নড়েচড়ে বসে।
আল্লামা ফরিদউদ্দীন মাসউদ সাহেবের মাধ্যমে দেয়া হয় ৯ সদস্যের কমিটি। এ কমিটিতে পত্রিকায় দেখলাম আমার নামও আছে। অথচ আমু জানিনা।
গতকাল অবশ্য ফরিদউদ্দীন মাসউদ সাহেব আমাকে টেলিফোনের মাধ্যমে জানিয়েছেন ৯ সদস্যের এ কমিটিতে আপনার নাম আছে। এটা আমাকর পরে জানিয়েছেন। আগে জানাননি।

মোস্তফা ওয়াদুদ : কেমন কমিশন চান?

মুফতি এনামুল হক : কেমন কমিশন চাই এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে বলতে চাই, আমরা আমাদের স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা রক্ষা করার গ্যারান্টি কে দিতে পারবে?
যে কমিশন এ গ্যারান্টি দিতে পারবে। যে কমিশন কওমী স্বকীয়তা রক্ষা করতে পারবে। এবং বাংলাদেশে বেফাক বোর্ড ছাড়া আনো যে বড় বড় পাঁচটি বোর্ড আছে। যেমন, তানজীম, ইত্তেহাদ, ইদারা ও গওগার ডাঙ্গা বোর্ড। এ সকল বোর্ডগুলোর সমন্বয়ে যদি কমিশন গঠন করা হয় তাহলে কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। শুধু বেফাকের মাধ্যমে যদি কমিশন গঠন হয় তাহলে অনেক মতানৈক্য দেখা দিতে পারে।
এ কথাটি গত বৃহঃস্পতিবার যে হাটহাজরীতে সকল উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে বৈঠক হয়। সেখানে আল্লামা শাহ আহমদ শফি সাহেব বলেছেন, একলা নীতি পরিহার করতে। সবাই নিয়ে চলার নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
অতএব আমার কথাও সেটাই। একলা নীতি পরিহার করে সমনীতি বাস্তবায়ন করে কওমী কমিশন গঠন করতে হবে। আমরা এমন কমিশনই চাই। কেননা একা চলা মুশকিল। বরং সবাই নিয়ে চললে আমাদের পথচলা সহজ, সাবলীল, চমৎকার ও সবার মনমতো হবে।

মোস্তফা ওয়াদুদ : সরকার যখন স্বীকৃতি দিয়ে দিবে। তখন তা বাস্তবায়নের কি অথরিটি আছে আপনাদের কাছে?

মুফতি এনামুল হক : এখানে আমাদের অথরিটি বড় বিষয় নয়। বরং স্বীকৃতি তো মুখে দেয়া হবে না। একটি খসড়া বা সুপারিশমালার মাধ্যমে প্রদান করা হবে। সে খসড়া যেসব বিষয় সংযোজন করা হবে সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে। এখানে ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু বলার নেই।

মোস্তফা ওয়াদুদ : স্বীকৃতি কোন পদ্ধতিতে নেয়া হবে?

মুফতি এনামুল হক : আমরা দাওরায়ে হাদীসকে এম.এ মান নিয়ে স্বীকৃতি নিতে চাই। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতি কি হবে? সেটাও নির্ভর করে ঐ খসড়া আইনের উপর।

মোস্তফা ওয়াদুদ : "সরকার আমাদের স্বীকৃতি দেয়ার চেয়ে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যই বেশি আগ্রহী"। এ কথার ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?

মুফতি এনামুল হক : সরকার যখন আমাদের স্বীকৃতি দিবে। তখন তার কাছে কওমী অঙ্গণ কৃতজ্ঞ থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার স্বীকৃতি দিয়ে তার কোনো বাস্তবায়ন করবে কিনা?
সেটা ভাববার বিষয়। তবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, সরকার স্বীকৃতির নামে আমাদেরকে একটি টোপ দিচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকার আমাদেরকে তার নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করছে।

কারণ আপনি জেনে থাকবেন বর্তমান বিশ্বে একমাত্র কওমী মাদরাসা এমন, যেখানে সরকারের কোনো কর্তৃত্ব চলে না। সরকার সবাইকে নিয়ে পথ চলতে চায়। বিশ্বের দরবারে নিজেকে প্রমাণ করতে চায় যে, আমার সেবা প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। কিন্তু উইকিলিকসের রিপোর্ট মতে সরকার কওমী মাদরাসাকে এখনো কোনো সেবা দিতে পারছে না। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। এমন রিপোর্টের প্রেক্ষিতেই সরকার কওমী মাদরাসাকে স্বীকৃতির আওতায় আনতে চাচ্ছে।

মোস্তফা ওয়াদুদ : কওমী সনদ দিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে চাকুরির সুযোগ মিলবে?

মুফতি এনামুল হক : সরকারী চাকুরির সুযোগতো মিলবে। যেমন, আরবী প্রভাষক, খেতাবাত, কাজী, ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের সরকারী পদে, সরকারী ধর্মীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও চাকুরির সুযোগ থাকবে।
এছাড়া বেসরকরী বিভিন্ন সেক্টরে ইন্টারভিউ ও ভাইভার মাধ্যমে তারা তাদের যোগ্যতানুযী চাকুরির সুযোগ পাবে।
তবে এক্ষেত্রে আমি আপনাকে একটি বাস্তব বিষয় শেয়ার করতে চাই। গত কয়েকদিন পূর্বে সৈনিক পদে নিয়োগের জন্য বায়োডাটা চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিলে কিছু মাদরাসা শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। নির্ধারিত দিন উপস্থিত হলে মাইকে ঘোষণা করা হয়। যারা মাদরাসার সার্টিফিকেট দিয়ে এপ্লাই করেছেন আপনাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনারা চলে যান। আমাদের এখানে কোনো মাদরাসা শিক্ষার্থীকে নেয়া হবে না।
তো দেখা গেলো সরকারী ডিফেন্সে সরকারী মাদরাসার সুযোগ নেই। তাহলে কওমী মাদরাসা সরকারী হলে এর সুযোগ থাকবে বিষয়টি কি করে ভাবতে পারেন।

(এসময় পাশে থাকা আরশাদ রাহমানী বলেন) বর্তমানে পাকিস্তানে এ কওমী শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতি আছে। সেখানে মাত্র ৫% লোক সরকারী এ সার্টিফিকেটককে কাজে লাগাতে পারে। বাকী ৯৫% লোক কিন্তু সার্টিফিকেটের ব্যবহার করতে পারছেন না। তাহলে কি করে বলতে পারেন?
যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানে স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও তারা এর যথাযথ বাস্তবায়নন করতে পারছেন না। সেখানে বাংলাদেশে আমাদের কি লাভ হবে?

মোস্তফা ওয়াদুদ : সর্বশেষ একটি প্রশ্ন, আপনারা কার মাধ্যমে স্বীকৃতি নিতে চান? শাহ আহমদ শফি?

ফরিদউদ্দীন মাসউদ?

মুফতি এনামুল হক : আসলে স্বীকৃতি কার মাধ্যমে নিতে চাই। কে নেতৃর্ত্ব দিবে। সেসব বলা হয়ে গিয়েছে। এখানে কোনো ব্যক্তিকে টেনে আনা উচিত হবে না। তবে সকল উলামায়ে কেরাম যাকে সাপোর্ট দিবেন। আমিও তাকেই সাপোর্ট দিবো। ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু বলতে চাই না


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ