সালমান তারেক শাকিল
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুই যুগের বেশি সময় ধরে ছাত্র সংসদ উপেক্ষিত, তবে রাজধানীর কওমি মাদ্রাসাগুলোয় নিয়মিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে ছাত্র সংসদগুলোর কার্যক্রম। এক যুগের বেশি সময় ধরে কওমি মাদ্রাসাগুলোয় ছাত্র সংসদের নেতৃত্ব নির্বাচনও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আছে। তবে নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, নেতৃত্বদানের যোগ্যতা আছে এমন ছাত্রদের এসব মাদ্রাসায় ছাত্র সংসদের কার্যক্রমে বেছে নেওয়া হয়। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদের কার্যক্রম দেখভাল করার জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকও থাকেন। রাজধানীর বিভিন্ন মাদ্রাসায় খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে চট্টগ্রামের বড় কয়েকটি মাদ্রাসায় ছাত্র সংসদই নেই। ওই বিভাগের কিছু জেলার মাদ্রাসায় ছাত্র সংসদ থাকলেও বিগত ৪-৫ বছর ধরে তা নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
জানা গেছে, রাজধানীর বড় মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মোহাম্মদপুর, জামিয়া আরাবিয়া লালবাগ, খাদিমুল ইসলাম মিরপুর ১৩, জামিয়া শরিয়্যাহ মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসা, ঢালকানগর মাদ্রাসা, ফরিদাবাদ মাদ্রাসা, জামিয়া বাইতুল আমান মিনার মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্রসহ ছাত্র সংসদ কার্যকর রয়েছে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র সংসদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে একটি বিশেষ কক্ষ। এসব মাদ্রাসায় বছরে একবার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল শ্রেণি) ক্লাসের একজনকে আমির করে ৭ থেকে ১০ জনের একটি কমিটি করা হয়। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলকে ওই মাদ্রাসার পুরনো ছাত্র হতে হয়।
জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকে ছাত্র সংসদ। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে দেয়ালিকা প্রকাশ, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, হামদ-নাত প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, মাদ্রাসার পরিবেশসংস্কার ও পাঠাগার ব্যবস্থাপনা।
জানা গেছে, মাদ্রাসা বিশেষে ছাত্র সংসদের নামও ভিন্ন ভিন্ন হয়। কার্যক্রমেও তফাৎ আছে। তবে সংসদের সভাপতি পদে কোনও নির্বাচন হয় না। এক্ষেত্রে পুরনো, বিশ্বাসী, দায়িত্বশীল, ভালো অবস্থানে আছে, এমন ছাত্রদের প্রাধান্য দিয়ে নেতা মনোনীত করা হয়।
সরেজমিনে মুহাম্মদপুর জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসার ছাত্র সংসদে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ৫-৮ হাজার বইয়ের সমারোহ রয়েছে তাদের ‘ছাত্র কাফেলা’র পাঠাগারে। মাদ্রাসার দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ছাত্র কাফেলার কার্যালয়ে ইসলামী বিষয়ের বাইরে জ্ঞান-বিজ্ঞান, গল্প-কবিতা, উপন্যাস, হররসহ নানা বিষয়ের গ্রন্থ রয়েছে। ছাত্র কাফেলার বর্তমান সভাপতি ইব্রাহিম খলিল। তিনি দাওরায়ে হাদিসে অধ্যয়ন করছেন।
ছাত্র সংসদেই কথা হয় তাকমীল জামাতের এক শিক্ষার্থী আবদুর রউফের সঙ্গে। তিনি জানান, ছাত্র কাফেলার ৬টি বিভাগ আছে। এগুলো হচ্ছে, দফতর বিভাগ, অর্থ বিভাগ, পাঠাগার বিভাগ, অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন বিভাগ, পরিবেশ বিভাগ ও প্রকাশনা বিভাগ। এই বিভাগগুলোর দায়িত্বে থাকেন বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্ররা। বর্তমানে রাহমানিয়া মাদ্রাসায় প্রায় ৮ জন ছাত্র কাফেলার সদস্য। এর বাইরে প্রত্যেক শ্রেণি থেকে ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি মনোনীত করা হয়।
রাহমানিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মারুফ আবদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বছরে অন্তত ১০ টি দেয়ালিকা প্রকাশ করে ছাত্র সংসদ। ৪টি আরবি ভাষায়, ৬টি বাংলায়। ঈদুল আজহা ও সীরাতুন্নবী উপলক্ষেও বিশেষ দেয়ালিকা বের হয়। এগুলোর পুরোপুরি দেখভাল করে ছাত্র কাফেলা।
ছাত্র কাফেলার সদস্য আবদুর রউফ জানান, মাসে দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠান হয়, সেটাও ছাত্র কাফেলা আয়োজন করে। সারা বছর ধরে বক্তৃতা, লেখালেখি, ইসলামি সঙ্গীতের আয়োজন হয়।
ছাত্র কাফেলার সামনে নোটিশ বোর্ডে টানানো আছে, আগামী ১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দুপুর ২ টায় ৪র্থ বাংলা সাপ্তাহিক জলসা অনুষ্ঠিত হবে। ওই জলসার বিষয়বস্তুর মধ্যে একটি রয়েছে, জঙ্গি প্রতিরোধ আন্দোলন, সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা।
চৌধুরীপাড়ায় ইক্বরা বাংলাদেশ মাদ্রাসার রয়েছে ইক্বরা ছাত্র সংসদ। এর সভাপতির দায়িত্বে একজন শিক্ষক। অভিভাবক হিসেবে তিনি থাকলেও ছাত্রদের পক্ষ থেকে দারুল ইফতার ছাত্র মাওলানা ওলিউল্লাহ আছেন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে।
সেখানকার ছাত্র কে এম আবদুল্লাহ শাকির বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আমাদের ছাত্র সংসদ দেয়ালিকা প্রকাশ, ছাত্রদের অধিকারসহ নানা বিষয়ে কাজ করে।
ঢাকার বাইরের অনেক মাদ্রাসাতেও আছে ছাত্র সংসদ। বগুড়ার জামিল মাদ্রাসা, রাজশাহী, ফরিদপুর, খুলনার অনেক মাদ্রাসার ছাত্র সংসদ নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গহরডাঙ্গা মাদ্রাসার ছাত্র সংসদের নাম খাদেমুল ইসলাম ছাত্র শাখা। এর সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মেসবাহ।
আব্দুল্লাহ আল মেসবাহ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মেধাবিকাশে প্রতিযোগিতা, বির্তক, ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কাজ করা এবং দেশের বৃহৎ মাদ্রাসাগুলোর ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা—এসব কাজই ছাত্র সংসদ করে। আমাদের নতুন সংসদের কাউন্সিল মাত্র শেষ হল। কার্যক্রমের মধ্যে পাঠাগার পরিচালনা অন্যতম। জাতীয় দিবসগুলোয় আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকি।
এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানের কওমি মাদ্রাসায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেও চট্টগ্রামের বড় দুটি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসায় ছাত্রদের ছাত্র সংসদ কার্যক্রম নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হাটহাজারী মাদ্রাসায় রাজনীতি নিষিদ্ধ। এ কারণে ছাত্র সংসদ নেই। মাদ্রাসার শুরু থেকে ছাত্র সংসদ নেই।
তবে ওই মাদ্রাসার আরেক শিক্ষক জানান, আল্লামা শফী ও মাদ্রাসার সিনিয়র দায়িত্বশীলরা প্রাচীনপন্থী হওয়ার কারণেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিচ্ছেন না।
মাওলানা হাসান আজিজ জানান, দারুল উলুম দেওবন্দে আছে। প্রত্যেক প্রদেশের আলাদা আঞ্জুমান (ছাত্র সংসদ)। কোনও কোনও প্রদেশের একাধিক আঞ্জুমানও আছে।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনূছিয়া, দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ছাত্র সংসদ কার্যকর থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরে নিষ্ক্রিয়। ২০০০ সাল থেকে এই দুটি মাদ্রাসায় দেয়ালিকা প্রকাশ, সঙ্গীত আয়োজন, বক্তৃতা আয়োজন হত নিয়মিত। তবে হঠাৎ করেই বিগত ৩ বছর ধরে আটকে আছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। তবে শিক্ষকরা বলছেন, ছাত্ররা চাইলে আবারও ছাত্র সংসদ শুরু হতে পারে। মাদ্রাসার দায়িত্বশীলরা বলছেন, এক অবহেলা, দুই দায়িত্বশীল শিক্ষকদের ব্যস্ততার কারণেই ছাত্র সংসদ বন্ধ রেখেছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
জামিয়া ইউনূছিয়ার শিক্ষক মাওলানা আবদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অবহেলাজনিত কারণেই জামিয়ার ছাত্র সংসদ বন্ধ রয়েছে।
দারুল আরকাম মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা সাইফুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছাত্র সংসদের অভিভাবক হিসেবে যে সব শিক্ষক দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা এখন বেশি ব্যস্ত। এ কারণে ছাত্র সংসদ কার্যকর নয়।
মাদ্রাসায় ছাত্র সংসদ থাকা-না থাকা বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছাত্র সংসদ হচ্ছে ছাত্রদের জায়গা। তাদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে সংসদ কার্যকর ভূমিকা রাখে। সাংস্কৃতিক আয়োজনগুলো পড়াশোনার পাশাপাশি তারা করে। এক্ষেত্রে কর্মজীবনে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তবে যারা ছাত্র সংসদের অনুমতি দেননি, সেটা তারা বলতে পারবেন।
প্রতিবেদনটি বাংলা ট্রিবিউন থেকে নেয়া