আওয়ার ইসলাম : মাদ্রাসার নির্ধারিত পোশাক ছাড়া আর কোনো পাঞ্জাবি বা ভালো পোশাক নেই নজরুলের। খুব ইচ্ছে ছিল ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় নতুন একটি পাঞ্জাবি পরে যাবেন। কিন্তু যেখানে ঢাকায় যাওয়ার খরচ জোগানোই কঠিন, সেখানে তো নতুন পাঞ্জাবি অনেকটা বিলাসিতা। অবশেষে বাবার কষ্টে জমানো এক হাজার টাকা হাতে নিয়ে পরীক্ষার আগের দিন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলেন। উঠলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বড় ভাইয়ের কাছে। পরের দিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বিকেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা শেষ করেই বাড়িতে ফিরে আসেন। খরচ বাঁচিয়ে হাতে তখনো ৪০০ টাকা নজরুলের।
নজরুল এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১৫৩ দশমিক ৮০ নম্বর পেয়ে মেধাতালিকায় ৩২০তম স্থান পেয়েছেন। আর জগন্নাথে ‘বি’ ইউনিট থেকে মেধাতালিকায় আছেন ২০২ নম্বর স্থানে। মেধাতালিকায় স্থান পেলেও এখন ভর্তি আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়েই শঙ্কা নজরুলের।
নজরুলের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ভয়রা গ্রামে। তিনি নিয়ামতপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসা থেকে ২০১৪ সালে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর সেখান থেকেই আলিম পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান।
নজরুলের বাবা জালাল মিয়া ঝালমুড়ি বিক্রেতা। পাঁচ সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সাতজনের সংসার। স্থানীয় বাজারে সারা দিন ঘুরে ফেরি করে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। এ টাকা দিয়ে সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে স্বপ্ন দেখেন সন্তানেরা শিক্ষিত হয়ে বড় মানুষ হবে। সেদিন আর কোনো কষ্ট থাকবে না। তাই চার সন্তানকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন।
তবে বাবার কষ্ট কমাতে মাঝেমধ্যেই বাবাকে মরিচ, পেঁয়াজ কেটে সাহায্য করেছেন নজরুল ও তাঁর বড় ভাই। এ ছাড়া আলিম প্রথম বর্ষে মাদ্রাসা থেকে ফিরে রাত নয়টা পর্যন্ত ওষুধের দোকানে কাজ করতেন নজরুল। মাসে পেতেন দুই হাজার টাকা। তবে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনার চাপ থাকায় আর কাজ করা হয়নি।
টিনের ঘর। মাটির মেঝে। ঘরে দুটি চৌকি আর দুটি টেবিল। এর মধ্যে সবাই গাদাগাদি করে থাকেন। সেখানেই কথা হয় জালাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর ভিটাবাড়ি ছাড়া একচিলতেও জমি নেই। সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় ঝালমুড়ি বিক্রি করি। দিনে হয়তো বিক্রি হয় ৩০০-৪০০ টাকার। আর খরচ বাদ দিয়ে হাতে থাকে দেড় শ থেকে ২০০ টাকার মতো। এ আয় দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ ছাড়াও বাকি তিন সন্তানের পড়ালেখা চালাচ্ছেন। এ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুলের ভর্তি নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় আছেন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘অনেক অভিভাবকের অনেক টাকা থাকা সত্ত্বেও সন্তানেরা ভর্তির সুযোগ পায় না। আর আমার সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও টাকার অভাবে পড়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’
নজরুল বলেন, ‘টাকার অভাবে মাঝেমধ্যে মনে হতো ঢাকায় গিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি করে পরিবারকে সহায়তা করি। কিন্তু বাবার ও শিক্ষকদের উৎসাহে কষ্ট হলেও পড়া চালিয়ে আসছি। কয়েক দিন পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো জোগাড় হয়নি ভর্তি ফিসহ আনুষঙ্গিক অর্থ। এখন আমি কী করব বুঝতে পারছি না। হয়তো ঋণ করতে হবে।’
নজরুলদের বাড়ির এক প্রতিবেশী হনুফা আক্তার বলেন, এরা কোনো রকমে জীবন যাপন করে। এর মধ্যে নজরুলের বাবা কষ্ট করে সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে যাচ্ছেন। আর ছেলেগুলোও মেধাবী। এত দিন ওদের বাড়িতে বিদ্যুৎও ছিল না। বিদ্যুৎ এসেছে তিন-চার মাস। এত দিন তারা কুপির আলোতে পড়াশোনা করেছে।
নিয়ামতপুর মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. শরিফ হোসেন বলেন, নজরুল খুব মেধাবী। পড়ালেখার প্রতি অনেক আগ্রহ। তাঁর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সমাজের বিত্তবান লোকদের এগিয়ে আসা উচিত।
নজরুলের বড় ভাই নাজিরুল ইসলাম করিমগঞ্জ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির আবেদন করেছেন। নজরুলের পরের ভাই বরজু। তার আবার পড়াশোনায় মন বসে না। সে চায়ের দোকানে কাজ করে। পরের ভাই তৌফিক দ্বিতীয় শ্রেণিতে আর একমাত্র বোন সোমাইয়া আক্তার কিন্ডারগার্টেনে প্লে গ্রুপে পড়ছে।
সূত্র : প্রথম আলো
এফএফ