ড. এ বি এম হিজবুল্লাহ
গোড়ার কথা: ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দ পূ্বর্কাল। দিল্লীতে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাই ছিল দ্বীনি শিক্ষাঙ্গনের প্রতীক। দরসে হাদীসের সিলসিলা এখান থেকেই পুরো ভারত বর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাদ্বে মাওলানা কাসিম নানুতবী (র.) -এর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত উপমহাদেশে দারুল উলূম দেওবন্দ। কাওমী মাদরাসার প্রাতিষ্ঠানিক রূপের সূচনা হয় এখান থেকেই। ১৯০১ খ্রীষ্টাদ্ব। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেরশের চট্টগ্রামের হাটাহাজারীতে দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম। এরপর আর পিছনের দিকে তাকাতে হয় নি। দারুল উলূম দেওবন্দকে কেন্দ্র করে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ নানা প্রান্তে ও দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে একে একে কাওমী মাদরাসা। তখনও সব দেশেই সরকার ছিল। কিন্তু এ মাদরাসাগুলোর স্বীকৃতি ছিলনা তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে। তবে স্বীকৃতি ছিল কাওমের, জাতির ও আম মুসলিমের। আসমানী ওহীলদ্ধ এ শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উৎস হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে গারে হেরা বা জাবালে নূর। যেখান থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে কুরআন হাদীসের নূরানী আভা। ইংরেজ বিতাড়িত হয় ভারত বর্ষ থেকে। দেশ বিভক্ত হয় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। তখনও কাওমী মাদরাসার সরকারী স্বীকৃতির ব্যাপারে কেউ চিন্তাও করেন নি। দেশ বিভক্তির অনেক বছর পর সাম্প্রতিক সময়ে স্বীকৃতির প্রশ্নটি সামনে আসে। শুরু হয় পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্ক।
১. কাওমী মাদরাসার সনদ স্বীকৃতি প্রসঙ্গে দু’টি ধারা পাওয়া যায়।
এক. যারা স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই মনে করেন তাদের যুক্তি:
ক. কাওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে এর মিল নেই। কাওমী মাদরাসার মূল কেন্দ্র দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম উম্মাহকে লিল্লাহিয়্যাতের ভিত্তিতে দ্বীনী ইলমের সাথে সম্পৃক্ত করে আল্লাহওয়ালা তৈরীর প্রত্যয়ে। দারুল উলূম দেওবন্দকে ঘিরেই পাক-ভারত ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে অগণিত কাওমী মাদরাসা ।
খ. আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ তাওয়াক্কুল নির্ভর এ মাদরাসাগুলো। মাদরাসা পরিচালনায় জনগণের দান অনুদানই হচ্ছে এ মাদরাসাগুলোর আর্থিক উৎস ।
গ. কোন ধরনের সরকারী অনুদান এ মাদরাসাগুলো গ্রহণ করে না। এমন কি সরকার অনুদান দিতে চাইলেও বিনয়ের সাথে তা ফিরিয়ে দেয়া হয়। পূর্বে এবং সাম্প্রতিক কালেও ভারত সরকার দেওবন্দকে সরকারী অনুদান গ্রহণের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু মাদরাসা কতৃপক্ষ তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান ।
ঘ. সব চাইতে বড় আশঙ্কা হল স্বীকৃতি নিলে সরকার স্বাভাবিকভাবেই চাইবে মাদরাসা পরিচালনা কমিটিতে তার প্রতিনিধি দিতে। এতে মাদরাসার স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা লংঘিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে ।
ঙ. আধুনিকায়ন বা যুগোপযুগী করার দোহাই দিয়ে পাঠ্যসূচীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হবে ।
চ. আর এটা ঘটলে কাওমী মাদরাসার মহান বৈশিষ্ট্য রূহানিয়্যাত, আখলাকী ও আমলী তারবিয়ত উঠে যাবে এবং সবাই বৈষয়িক ক্ষেত্রে এ সনদ ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে ।
ছ. বিজ্ঞ অভিজ্ঞ আলিম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতী ও ফকীহ তৈরী হবে না ।
জ. এক সময় এমনও হতে পারে যুগোপযুগী কোর্স বা বিষয়ের অন্তর্ভুক্তির কারণে মূল বিষয়গুলিই ধামাচাপা পড়ে যাবে।
ঞ. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদেরকে হাতে গোণা কয়েকটি বিভাগ ছাড়া অন্যান্য বিভাগে ভর্তি হতে দেবে না। যেমন বর্তমানে সরকারী মাদরাসার ছাত্ররা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চমৎকার ফলাফল করা সত্বেও পসন্দের বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায় না । কাওমী মাদরাসা ছাত্রদের সাথেও যে এমন আচরণ করা হবে না তার কোন গ্যারেন্টি নেই । ইত্যাদি ।
দুই. যারা স্বীকৃতি প্রাপ্তির পক্ষে তাদের যুক্তি :
ক. স্বীকৃতি প্রাপ্তির মাধ্যমে কাওমী ছাত্ররা সমাজে একটি সন্মানজনক অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হবে ।
খ. স্বীকৃত সনদের মাধ্যমে তারাও দেশ বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবে। কাওমী ছাত্রদেরকে লুকিয়ে লুকিয়ে আর দাখিল আলিম বা মেট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে হবে না।
গ. বর্তমানে অনেক কাওমী ছাত্র লুকিয়ে লুকিয়ে দাখিল আলিম বা মেট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিদেশে যেমন সৌদী আরব, মিসর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভে অধ্যয়নরত। বিশেষ করে সৌদী আরবের মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সুনামের সাথে অধ্যয়ন করছেন।
ঘ. দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তারা নিজেকে সংযুক্ত করতে পারবে ।
ঙ. দেশ ও জাতির সেবায় তারা আরও বেশি ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে ।
চ. সমাজের বোঝা হিসাবে তাদেরকে আর কোন গ্লানি বহন করতে হবে না।
২. বিভিন্ন দেশে কাওমী সনদের স্বীকৃতি
ক. ভারত
ভারত থেকে ইংরেজ খেদাও আন্দোলন এবং অবিভক্ত ভারতের পক্ষে অনড় ভুমিকা পালনকারী শাইখুল আরব ওয়াল আজম ও রূহানী শাইখ দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস শাইখূল ইসলাম হোসাইন আহমাদ মাদানী (রা.) ।
শ্রুতি আছে যে, দেশ বিভাগের পর ভারতীয় কংগ্রেস সরকার হযরতকে দারুল উলূম দেওবন্দের সনদের স্বীকৃতি দানের প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু শাইখুল ইসলাম সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপরও ভারতীয় বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে আছে সেভাবে ঠিক রেখেই দারুল উলূম দেওবন্দ এবং পরবর্তিতে বেশ কিছু নিরবাচিত মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদকে স্বীকৃতি প্রদান করে। উল্লেখ্য আমার জানামতে ভারতে কাওমী মাদরাসা বোর্ড নামে কোন বোর্ড নেই ।
আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, জামেয়া মিল্লিয়া ও হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বীকৃতিদানকারী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইটে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলোর নাম পাওয়া যেতে পারে বা তাদের সাথে যোগাযোগ করে এগুলো সংগ্রহ করা যেতে পারে। তা ছাড়াও স্বীকৃতিদানকারী যেকোন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করে স্বীকৃতি দানের পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হওয়া যেতে পারে। (আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতর থেকে প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র)
এরই সূত্র ধরে সময়ে সময়ে দেওবন্দের ছাত্ররা দাওরা শেষে অনেকেই আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে এম এ কোর্সে ভর্তি হয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করে। অনেকেই পরবর্তিতে এম ফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রিও লাভ করেন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা পেশায় প্রবেশ করেন। আমাদের দেশেও এর নজির আছে।
খ. পাকিস্তান
পাকিস্তান সরকারও কাওমী মাদরাসার সনদকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে তা মাদরাসা কেন্দ্রিক নয়। কাওমী মাদরাসা বোর্ড কেন্দ্রিক। উল্লেখ্য পাকিস্তানে ‘বেফাকুল মাদারিসিল কাওমিয়্যাহ’ নামে একটি মাত্রই বোর্ড রয়েছে। এর সভাপতি হলেন জামেয়া ফারুকিয়ার মুহতামিম হযরত মাওলানা সালিমুল্লাহ খান সাহেব। দাওরায়ে হাদীসকে সরাসরি এম এ-র মান দেয়া হয়েছে।
এ বোর্ড কতৃক ইস্যুকৃত দাওরায়ে হাদীসের সনদের ভিত্তিতে দাওরা ডিগ্রিধারীগণ বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে ইসলামিক স্টাডিজ ও এ্যারাবিকের শিক্ষক হতে পারেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি এম ফিল-এ ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় এবং পরবর্তিতে পিএইচ.ডি ডিগ্রিও অর্জন করতে পারেস। বাংলাদেশী কিছু ছাত্র এ সুযোগ গ্রহণ করে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেছেন।
গ. বাংলাদেশ
বাংলাদেশের অনেক আলিম কাওমী মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করেছেন। তাদের মাঝে ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রা.)। এ জন্য তিনি মুক্তাঙ্গণে বেশ কিছুদিন অবস্থান ধর্মঘটও করেন এবং উম্মুক্ত স্থানে হাদীসের দারসও দেন ।
সম্ভবত এরই ফলশ্রুতিতে তার সৌজন্যে তৎকালীন সময়ের চার দলীয় জোট (যে জোটে হযরতের দলও অন্তর্ভূক্ত ছিল) সরকার অন্তিম মুহূর্তে দাওরায়ে হাদীসকে এম এ (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী সাহিত্য) সমতুল্য হিসেবে একটি গেজেট প্রকাশ করে। (রেজিস্টার্ড নং ডি এ-১, তারিখ ২০ডিসেম্বর ২০০৬ বুধবার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রজ্ঞাপন)।
তিন. পযার্লোচনা
ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বীকৃতিতে দেখা যায় এক. মাদরাসা সিলেবাস ও কারিকুলামে আধুনিকায়ন ও যুগপোযুগী করার কোন শর্ত নেই। এ ক্ষেত্রে মাদরাসা কতৃপক্ষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। দুই. সরকারী সম্পৃক্ততার জন্য কোন শর্ত নেই। তিন. নিদৃষ্ট ও নিবার্চিত মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদীসের সনদকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এটা চলমান। চার. এ স্বীকৃতিতে সমমান হিসাবে বি এ (অনার্স) নির্ধারণ করা হয়েছে। পাঁচ. এ সনদের মাধ্যমে আমার জানামতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন, আলীগড়, জামেয়া মিল্লিয়া, হামদর্দ ও লাখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়) -এ সরাসরী এম এ কোর্সে ভর্তি হওয়া যায়। পরবর্তিতে এম ফিল ও পিএইচ.ডি করারও সুযোগ আছে। ছয়. কর্মক্ষেত্র হিসাবে সব ক্ষেত্রের জন্যই উম্মুক্ত রাখা হয়েছে বলে জানা যায়।
পাকিস্তানী স্বীকৃতিতে দেখা যায় এক. মাদরাসার সিলেবাস ও কারিকুলামে আধুনিকায়ন ও যুগপোযুগী করার কোন শর্ত নেই। এ ক্ষেত্রে মাদরাসা কতৃপক্ষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবে এ স্বীকৃতি পেতে হলে মাদরাসা ছাত্রদের অবশ্যই বেফাকের তত্ববধানে দাওরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। দুই. সরকারী সম্পৃক্ততার জন্য কোন শর্ত নেই। তিন. সরকারী নিয়ন্ত্রণমুক্ত বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়্যা পাকিস্তান কতৃক আয়োজিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় পাশকরা দাওরা সনদকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। চার. এ সনদকে সরাসরি এম এ -র সমমান দেয়া হয়েছে। পাঁচ. যতটুকু জানা যায় বেফাক থেকে সনদপ্রাপ্তরা যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি এম ফিল কোর্সে ভর্তি হতে পারে। পরবর্তিতে পিএইচ.ডি করারও সুযোগ আছে। ছয়. কর্মক্ষেত্র নির্ধারণে বলা হয়েছে স্কুল ও কলেজে ইসলামী শিক্ষা ও আরবী সাহিত্যে তারা শিক্ষকতা করতে পারবেন।
বাংলাদেশী স্বীকৃতিতে দেখা যায় এক. প্রচারিত প্রজ্ঞাপনের বক্তব্য অনুযায়ী সরকার সকল কাওমী মাদরাসার সমম্বয়, উন্নয়ন ও পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের জন্য ‘কাওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ’ নামে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। দুই. উক্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন/বিধিবিধান অনতিবিলম্বে প্রণয়ন করা হবে। তিন. কাওমী মাদরাসার দাওরা ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পরবর্তিতে এ পরীক্ষা ‘কাওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশের’ তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হবে। চার. দাওরা ডিগ্রি এম এ (ইসলামিক স্টাডিজ/আরবী সাহিত্য) -এর সমমান হবে। পাঁচ. কিন্তু এ সনদের ভিত্তিতে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এম ফিল কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগের কথা বলা নাই। ছয়. কর্মক্ষেত্র হিসাবে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবী সাহিত্য/ ইসলামিক স্টাডিজ, কাজীর দায়িত্ব ও মাসজিদের ইমামতিকে নির্ধারণ করা হয়েছে।
চার
বাংলাদেশী স্বীকৃতিতে যে বিষয়গুলো উঠে আসে তা হল: এক. কাওমী মাদরাসার স্বকীয়তা ক্ষুন্ন হবে। ভারত ও পাকিস্তানের ন্যায় তারা স্বাধিনভাবে কার্যক্রম চালাতে পারবে না। প্রস্তাবিত ‘কাওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ’ গঠন করে কাওমী মাদরাসাগুলোকে এর আওতায় নিয়ে আসা হবে। প্রয়োজনীয় আইন/বিধি বিধান রচনা করে এ বোর্ডকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক প্রেরিত দাওরা ডিগ্রিধারীগণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স/এম এ কোর্সে ভর্তির অনুমতি প্রার্থনা প্রসঙ্গে আবেদনের জবাবে বাংলাদেশ মঞ্জুরী কমিশনের (সূত্র নং ৪১(২য়) বিমক/বৃত্তি/সচি/২০০১(পার্ট-১)/১৪৪৬ তারিখ ২৬/০২/২০০৯) এক চিঠিতে বলা হয় দাওরা ডিগ্রিকে এম এ সমমান দেয়ার পরও তারা বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে স্নাতক পযার্য়ে ভর্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। প্রশ্ন হল, এম এ সমমান স্বীকৃতির পর কীভাবে আবার স্নাতক কোর্সে ভর্তির কথা বলা হয়েছে? এতে কী এম এ সমমানের স্বীকৃতিকে খাটো করা হলো না? তাছাড়াও প্রশ্ন উঠতে পারে কোন বোর্ড কী বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির সার্টিফিকেট দিতে পারে? এর জন্য প্রয়োজন হবে আরও একটি এফিলিয়েটেড কাওমী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। ইত্যাদি বিষয়গুলো মাথাচাড়া দেবে।
বর্তমান সময়ে যেখানেই কাওমী মাদরাসা সনদ স্বীকৃতির আলোচনা হচ্ছে সেখানে এ বিষয়টি সম্পর্কে কেউ কথা বলছেন না। এ স্বীকৃতিকে বাতিল করা হয়েছে কি না তাও জানা নেই। তবে আমার জানা মতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চিঠির ভিত্তিতে দাওরা ডিগ্রিধারীগণকে কোন কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ও সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়) অনার্সে ভর্তি করেছেন এবং তারা অনার্স শেষে আবার এম এ ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। বিষয়টি কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকেছে। ঘোষিত ঐ প্রজ্ঞাপন ত্রুটিপূর্ণ। তাই সংশোধনযোগ্য।
পাঁচ
যারা কাওমী সনদের স্বীকৃতির পক্ষে কথা বলেছেন তাদের মতামতকে সন্মান দেখিয়ে বলছি, দারুল উলূম দেওবন্দের স্বীকৃতি কিন্তু আন্দোলন করে আদায় করা হয়নি। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই কাওমী দাওরা ডিগ্রিকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। সে কারণে এখনও দারুল উলূম কতৃপক্ষের এ বিষয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। কেউ আলীগড় ভর্তি হয়েছে না কি ভর্তি হয়েছে জামেয়া মিল্লিয়া বা অন্য কোন ভার্সিটিতে এ নিয়ে তারা মাথা ঘামান না। দাওরা ডিগ্রিধারীদেরও এ বিষযে তাড়া নেই যে, তারা কী করবে? কোন ভার্সিটিতে ভর্তি হবে? অনুরূপ দেখা যায় পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও। ছাত্রদের কে এ স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে কোন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে আর কে হয় নি এ নিয়ে মাদরাসা কতৃপক্ষের কোন চিন্তা নেই। তারা চলছে আপন গতিতে স্বাধীনভাবে।
ছয়
এক সময় দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসার দাওরা ডিগ্রিধারীগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে গেষ্ট টিচার হিসাবে পাঠ দান করেছেন। তাদের মাঝে রয়েছেন মাওলানা যফর আহমাদ উসমানী, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক এবং সম্ভবত মাওলানা রেজাউল কারীম ইসলামাবাদী। সেখানে এ প্রশ্ন ওঠেনি তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাতিষ্ঠানিক কোন সার্টিফিকেট নেই। না অনার্সের, না মাস্টার্স-এর। তাঁরা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগে অনার্স ও এম এ-র ক্লাশ নেবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ তখন শিক্ষা ও শিক্ষককে মূল্যায়ন করেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় কি দেওবন্দ, কি দেশের কোন কাওমী মাদরাসার দাওরা ডিগ্রিধারীগণ সরকারী মাদরাসার ফাযিল ও পরবর্তিতে কামিল সমমান ধরে সরকারী আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করার সুযোগ পেতেন। এদের সংখ্যা প্রচুর ছিল। এখন অবশ্য এ ধারা অব্যাহত নেই।
খতীব মাওলান উবাইদুল হক যিনি ছিলেন ঢাকা আলীয়া মাদরাসার হেড মুহাদ্দিস। পরবর্তিতে আজীবন তিনি জাতীয় মাসজিদ বাইতুল মুকাররামের খিতাবাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। শুধু তাই নয়, ক্রান্তিকালে মুসলিম উম্মাহকে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। জাতীয় অঙ্গনে উন্নত মমশীর মাওলনা আতহার আলী, খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দীক আহমাদ, সদর সাহেব মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, বাংলাদেশের তাওবার রাজনীতি প্রবর্তনকারী এবং প্রেসিডেন্ট নিবার্চনে অংশগ্রহণকারী হাফেজ্জী হুজুর মাওলানা মুহাম্মাদ উল্লাহ, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক এবং মুফতী ফজলুল হক আমীনী (সাবেক এম পি), মাওলানা আতাউর রহমান খান (সাবেক এম পি) রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখের অবদান কেউ কী অস্বীকার করতে পারবেন? তাঁরা সবাই ছিলেন কাওমী ঘরানার।
আরও আগে শাইখুল ইসলাম মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাদানী, চৈন্তিক জগতে আরব ও আজমের উস্তায, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব আবুল হাসান আলী নাদাভী (আলী মিয়) মাওলানা মানযুর নোমানী, মাওলানা শিব্বির আহমাদ উসমানী, পাকিস্তানের মুফতিয়ে আযম মুফতী মুহাম্মাদ শফী, মাওলানা যফর আহমাদ উসমানী, সিন্দ প্রদেশের মূখ্য মন্ত্রির দায়িত্ব পালনকারী মুফতী মাহমূদ, মাওলানা গোলাম গাউস হাজারী, মাওলানা ইহতিশামুল হক থানবী প্রমুখ রাহিমাহুমুল্লাহ এবং বর্তমানে মাওলানা ফজলুর রাহমান, পাকিস্তান বেফাকের সদর মাওলানা সালিমুল্লাহ খান, পাকিস্তানের বর্তমান মুফতিয়ে আযম মাওলানা রাফী উসমানী এবং এক সময়ের শরীয়া আদালতের (পাকিস্তান) প্রধান বিচারপতি, আন্তর্জাতিক ফিকহ কাউন্সিলের সদস্য, ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব মুফতী তাকী উসমানী প্রমুখরাও ছিলেন কাওমী মাদরাসার ডিগ্রিধারী। তালিকা অনেক দীর্ঘ।
একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সন্মানীত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. ইসহাকের নিকট দেওবন্দের দাওরা ডিগ্রির মান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি লিখেছিলেন, (যতটুকু মনে পড়ে মর্মার্থ) ‘দাওরা ডিগ্রি এম এ ডিগ্রির চাইতেও অনেক উর্ধ্বে’।
সাত. প্রস্তাবনা:
মাননীয় সরকার কাওমী সনদের স্বীকৃতি দিতে আন্তরিক বলেই মনে হয়। ইতঃমধ্যে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী এ স্বীকৃতি প্রদানে বিলম্বের কারণ হিসেবে একাধিক বোর্ডের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সবাইকে একটি বোর্ডের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন। পাশাপাশি দ্রুত কাওমী মাদরাসা উপযোগী কারিকুলাম প্রস্তুত করার নির্দেশও দিয়েছেন। সম্প্রতি এ সম্পর্কিত একটি সরকারী প্রজ্ঞাপনও জারী করা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি মহোদয় কতৃক কাওমী মাদরাসার জন্য সিলেবাস প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। তাই কাওমী সনদের স্বীকৃতির ব্যপারে সুস্পষ্ট কিছু প্রস্তাবনা পেশ করছি।
এক. সরকার নিবার্হী ক্ষমতা বলে গেজেট আকারে প্রজ্ঞাপন জারীর মাধ্যমে স্বীকৃতির ঘোষণা দিতে পারেন।
দুই. ভারত ও পাকিস্তানের সমম্বিত নীতি অবলম্বনে দাওরা ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে।
তিন. ভারত ও পাকিস্তানের মত কাওমী মাদরাসাগুলোকে একক হোক বা বেফাকের মাধ্যমে তাদের একক স্বাধীনতা বহাল রাখতে হবে। তারা নিজেরাই তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে শিক্ষা কারিকুলাম ও সিলেবাসের আধুনিকায়ন, যুগোপযুগীকরণ, সংশোধন সংযোজনের ক্ষমতা সংরক্ষণ করবেন।
চার. দাওরা ডিগ্রির মান হবে এ নিয়ে কিছু প্রস্তাব নযরে পড়েছে। কেউ বলেছেন মেট্রিক সমমান দেয়া হোক। আবার কেউ প্রস্তাব করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক (এইচ এস সি) সমমান দেয়া হোক। সমস্যা হল এতে কাওমী মাদরাসার সবোর্ব্চ্চ ডিগ্রির কি নাম হবে? তাই মুনাসিব হলো দাওরা হাদীস হোক বা তাফসীর বা ফিকহ এগুলোর মান হবে এম এ ডিগ্রির। নুন্যতম মান তো বি এ (অনার্স) এর নিচে হবে না।
পাঁচ. জাতীয় ভিত্তিতে নিবার্চিত একাধিক বেফাকের (বোর্ড বা কমিশন) তত্ববধানে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় কৃতকাযর্করাই এ স্বীকৃতি পাবেন।
ছয়. এ সনদের আওতায় ডিগ্রিধারীগণকে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে (সরকারী ও বেসরকারী) অনার্স হলে আল কুরআন, আল হাদীস, দাওয়াহ, আল ফিকহ ও আরবী সাহিত্যে এম এ ও এম এ হলে এম ফিল কোর্সে ভর্তি এবং পরবর্তিতে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ দিতে হবে।
সাত. স্তর বিন্যাসে বেফাকের নিজস্ব স্তর থাকতে পারে। তবে সেখানে উচ্চ মাধ্যমিকের স্তর থাকলে তাদেরকে উম্মুক্ত প্রতিযোগীতার মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তবে এটা না করাটাই উত্তম হবে। কারণ ছাত্ররা তখন এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে এবং মাদরাসাগুলো ইমেজ সংকটে পড়তে পারে। যেমন বর্তমানে আলিয়া মাদরাসাগুলোর অবস্থা।
আট. বিভিন্ন কাওমী মাদরাসায় পরিচালিত তাখাস্সুসের (উচ্চতর গবেষণা) বিষয়টিকেও বিবেচনায় আনা যেতে পারে। এম ফিল মানোত্তীর্ণ হলে এগুলোকে এম ফিল মান দেয়া যায় কি না বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে ঢালাওভাবে এ ধরণের তাখাসসুস কোর্স পরিচালনা করা যাবে না। উল্লেখ্য নানাবিধ কারণে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চতর গবেষণা স্তরে এম ফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রি দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।
নয়. কর্মক্ষেত্র সংকুচিত না করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র উম্মুক্ত করা যেতে পারে। জন প্রসাশনে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে দাওরা ডিগ্রিধারীদের জন্য বি সি এস ক্যাডারে প্রতিযোগিতার সুযোগ দিতে হবে। আমার বিশ্বাস এ সুযোগ পেলে কাওমী ছাত্ররা দেশ ও জাতির সেবায় তাদের সেরাটা দিতে পারবে।
দশ. সবশেষে দাওরা তথা কাওমী মাদরাসা সনদ স্বীকৃতি প্রাপ্তির জন্য একদল আলিম ভারত ও পাকিস্তান সফর করে সেখানের স্বীকৃতির ধরণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারেন এবং প্রস্তাবনা পেশ করতে পারেন।
কাওমী মাদরাসার স্বকীয়তা ধ্বংস করে স্বীকৃতি কাওমী ছাত্রদের জন্য কতটুকু ফলপ্রসু হবে বিষয়টি নিয়ে আকাবিরকে ভাবতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বর্তমান বেফাকুল মাদারিসের সভাপতি হযরত মাওলানা শাহ আহমাদ শফি এবং মাওলানা ফরিদুদ্দিন মাসউদসহ আকাবিরের কেউ কাওমী মাদরাসার স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে স্বীকৃতি মেনে নেবেন না। আমরা জানি তাঁরা দু’জনসহ দেশের সন্মানীত আলিমগণ ভারত সরকারের স্বীকৃতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানকারী উস্তাযুল আরব ওয়াল আজম শাইখুল হাদীস মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাদানীর রূহানী সন্তান ও অনুসারী। আল্লাহ আমাদের মুরুব্বী ও আকাবিরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার তাওফীক দান করুন।
প্রফেসর ড. হাফেজ এ বি এম হিজবুল্লাহ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]