আওয়ার ইসলাম : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের মধ্যদিয়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সামরিক উত্তেজনা কিছুটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু গতকাল পাকিস্তানের ভেতরে কথিত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’র কারণে দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে আবার উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। সীমান্ত থেকে ভারত লোকজন সরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেছেন, যেকোনো মূল্যে তারা দেশ রক্ষা করবেন।
এমন ধরনের সামরিক উত্তেজনার পরও বিশেষজ্ঞরা এ দুটি দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশংকা উড়িয়ে দিচ্ছেন। তবু বিশ্ববাসীর মনে রয়েছে নানা জল্পনা, নানা শংকা। যুদ্ধের আশংকা দেখা দিলেই খুব দ্রুত চলে আসে যুদ্ধে কার কী ক্ষতি হতে পারে তার হিসাব-নিকাশ। এ প্রেক্ষাপটে সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করেছে পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ‘এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’। পার্সটুডের পাঠকদের জন্য আমরা ফিচারধর্মী প্রতিবেদনটি অনুবাদ আকারে তুলে ধরলাম।
অর্থনৈতিক ক্ষতি: যদি যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে দু পক্ষই দু দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে টার্গেট করবে যাতে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা যায় এবং অপরপক্ষ যেন যুদ্ধ টেনে নিতে না পারে। বন্দরগুলোতে নৌ অবরোধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের মারাত্মক ক্ষতি হবে। এতে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বি হবে। দু দেশের স্টক মার্কেটেও পড়বে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব। এর ফলে পাকিস্তান ও ভারতের স্টক মার্কেট থেকে বিদেশিরা তাদের পুঁজি প্রত্যাহার করে নেবে।
যুদ্ধের কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাবে। ফলে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য ব্যবসা ও অর্থ সহায়তা মুখ থুবড়ে পড়বে। এক হিসাব মতে- যুদ্ধের জন্য ভারতকে প্রতিদিন ৫০ বিলিয়ন রুপি বা ৫,০০০ কোটি রুপি ব্যয় করতে হবে। এছাড়া, দেশটির বাজেট ঘাটতি বাড়বে শতকরা ৫০ ভাগ। যুদ্ধ চালিয়ে নিতে হলে পাকিস্তানকেও তার অপর্যাপ্ত সম্পদ থেকে নতুন করে বরাদ্দ দিতে হবে। এমনকি যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিপুল অংকের অর্থ লাগবে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি: পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে ভঙ্গুর সামাজিক অবকাঠামোর কারণে দু দেশেই উগ্রবাদ নতুন রূপে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ভারতে মুসলমানরা এবং পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুরা যুদ্ধ-উন্মাদনার কারণে হামলার শিকার হতে পারে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান অভ্যন্তরীণভাবে যে লড়াই করছে তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ পূর্ব সীমান্ত রক্ষার জন্য অনেক বেশি সেনা প্রয়োজন হবে। এ সুযোগে সন্ত্রাসীরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে।
আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের কারণে পরিবহণ, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অবকাঠামোর মারাত্মক ক্ষতিসাধন হবে। যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় তবে দু দেশের লোকজন উদ্বাস্ত হবে যা দু দেশের অর্থনীতির জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দেখা দেবে।
যুদ্ধের মতো এমন ট্র্যাজেডিতে সবসময় পাকিস্তানে যা ঘটে এবারও তার ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা কম। সম্ভাব্য যুদ্ধ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেবে এবং দেশে সামরিক শক্তির প্রভাব বাড়বে।
কূটনৈতিক ক্ষতি: যুদ্ধ হলে সীমান্ত বাণিজ্য, ক্রীড়া এবং পর্যটনও এর শিকার হবে। সরকারি বাণিজ্যের পরিমাণ কমে গেলে বা বন্ধ হলে সীমান্তে চোরাচালান বাড়বে। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের ক্রিকেট সম্পর্ক হয়ত ভালো নয় কিন্তু আরো বেশ কিছু ক্রীড়া রয়েছে যাতে দু দেশ অংশ নেয় -তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের যেসব আত্মীয়-স্বজনের বসবাস রয়েছে তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ কমে যাবে। এছাড়া, রোগী ও তীর্থযাত্রীদের জন্য দু দেশ সফর করা কঠিন হয়ে পড়বে।
যুদ্ধের প্রথম দিকেই দু দেশের কূটনীতিকরা হয়রানির শিকার হতে পারেন। আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীনে কূটনীতিকরা যেসব সুবিধা পেয়ে থাকেন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে দু দেশের কূটনীতিকরা তা পাবেন কিনা -সন্দেহ রয়েছে অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অর্থই হচ্ছে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি এবং বাণিজ্য ও অর্থ সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এতে দু দেশই আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে একঘরে হতে পারে।
স্বাস্থ্যখাতের ক্ষতি: যেহেতু মৃত্যু, আহত হওয়া এবং শারীরিকভাবে পঙ্গু হওয়ার বিষয়গুলো যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ সে কারণে জনস্বাস্থ্য খাত পাক-ভারত যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসের কারণে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিয়েও পাকিস্তান জরুরি প্রয়োজনগুলো হয়ত মেটাতে পারবে। কিন্তু যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং চিকিৎসা স্থাপনাগুলো যদি সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়ে তাহলে দু দেশের সরকারের জন্যই জনস্বাস্থ্য খাত হবে আলাদা চিন্তার বিষয়।
যুদ্ধের সময় এবং তার আগে-পরে দু দেশের জনগণের মধ্যে মানসিক অবসাদগ্রস্ততা ও উদ্বেগ দেখা দেবে। দেশ রক্ষার জন্য শক্তি ও সামর্থ ব্যয় করা হবে এবং যুদ্ধের পর দেশ পুনর্গঠনের প্রশ্ন আসবে তখন মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষিত হবে যা ভবিষ্যতে দেশের জন্য মারাত্মক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সবচেয়ে খারাপ যে চিত্র হবে: যদি যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে কোটি কোটি মানুষ মারা যেতে পারে। এসব মানুষ মারা যাবে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণে, বোমা বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট আগুনে পুড়ে এবং তেজস্ক্রিয়তার ফলে। পরমাণু বোমা ব্যবহার করা হলে দু দেশের সীমান্ত অঞ্চলেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ বাতাসের মাধ্যমে ছড়াবে পরমাণু তেজস্ক্রিয়তা।
পরিবেশ দুষণ সংক্রান্ত ক্ষতি এবং আবহাওয়ার গঠনে পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষ ভয়াবহ ক্ষুধার মুখে পড়বে কারণ ভারতীয় উপমহাদেশের ফসলের ওপর বিশ্বের বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য নির্ভরতা রয়েছে। এ সংকট থেকে পরে বড় ধরনের সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। পরমাণু বোমা ব্যবহারের কারণে আক্রান্ত এলাকার বায়ুমন্ডলে তার অণু ছড়িয়ে পড়বে এবং সূর্যের আলো কমে যাবে আর বায়ুর মান খারাপ হয়ে যাবে।
সূত্র : পার্স টুডে
এফএফ