এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, 'দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে মনিটরিং ব্যবস্থা কঠোর করা হচ্ছে। প্রয়োজনে প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং পদ্ধতি চালু করা হবে। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিন্দুমাত্র অনুকম্পা দেখানো হবে না।' তিনি আরও বলেন, 'যারা অনিয়ম ও দুর্নীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও করা হবে।' দুদক সূত্র জানায়, অভিযুক্ত ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে পাঁচ কর্মকর্তা ও আট কর্মচারী। অবশ্য এর আগেও অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগে দুদকের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সিন্ডিকেট :প্রণীত তালিকায় অভিযুক্তদের সম্পর্কে এই মর্মে মন্তব্য করা হয়েছে, অভিযুক্তকে অব্যাহতি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অর্থ আদায়, ভয় দেখিয়ে অর্থ গ্রহণ, অর্থের বিনিময়ে প্রকৃত অপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যক্তিকে চার্জশিটভুক্ত করা, ভুয়া রেকর্ডপত্র তৈরি, দুদকের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার পাশাপাশি চাঁদাবাজি, ফেনসিডিলসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার, হত্যা মামলায় গ্রেফতার আসামিকে মুক্ত করার আশ্বাস দিয়ে সংশ্লিষ্ট লোকদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ, চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ঘুষ নেওয়াসহ নানা অন্যায় ও অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িত রয়েছেন।
জানা গেছে, দুদকের ভেতরে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সিন্ডিকেটের কেউ কেউ ধরা পড়েছেন, কেউবা ঘাপটি মেরে বসে আছেন। তারা কমিশনকে ভুল বুঝিয়ে অভিযোগ নথিভুক্ত করার বিনিময়ে অভিযুক্তদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিচ্ছেন। অভিযোগ অনুসন্ধানকালে অনেককে ঢালাওভাবে
জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পরে অর্থের বিনিময়ে আসামির তালিকা থেকে কারও কারও নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। মামলার পর তদন্ত পর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও চার্জশিটে কার নাম অন্তর্ভুক্ত হবে, কার নাম হবে না_ এ নিয়ে হচ্ছে আরেক দফা দুর্নীতি। অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সময় অভিযুক্তদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। আবার দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এ রকম নানা উপায়ে অবাধে দুর্নীতি করছে দুদকের অসাধু কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটটি।
বিভাগীয় মামলা :অভিযোগ উঠেছে, দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক খন্দকার আখেরুজ্জামান দুর্নীতি মামলার প্রকৃত অপরাধীকে অর্থের বিনিময়ে কৌশলে ছেড়ে দিয়ে অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন এমন ব্যক্তিকে চার্জশিটভুক্ত করেছেন। তদন্ত শেষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে এ সম্পর্কে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। মানি লন্ডারিংয়ে অভিযুক্ত আসামিকে ভয় দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এর উপপরিচালক শাবি্বর হাসানের বিরুদ্ধে। অভিযোগে প্রকাশ, তিনি চট্টগ্রামের পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ফোর এইচ গ্রুপের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। ১০ লাখ টাকা নেওয়ার সময় তিনি চট্টগ্রাম র্যাবের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েন। এ মামলা বিচারাধীন থাকায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। অব্যাহতি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অভিযুক্তের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো দুদকের ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক আহসান আলীর বিরুদ্ধে। অব্যাহতির বিরুদ্ধে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াও স্থগিত রয়েছে।
এ ছাড়া প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক কেএম মিছবাহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে বদলি আদেশ বাতিলের জন্য বেসরকারি খাতের ব্যক্তির মাধ্যমে কমিশনে তদবির করানোর অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগের তদন্ত চলছে।
মামলায় জড়িত আট কর্মচারী :ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আবু ইউসুফ শাহের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দুর্নীতির অভিযোগে ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়ের। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ-সংক্রান্ত ভুয়া রেকর্ডপত্র তৈরির অভিযোগ রয়েছে প্রধান কার্যালয়ের কনস্টেবল খসরু জাহানের বিরুদ্ধে। এটি ছাড়াও আরেকটি অভিযোগে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। দুদকের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে প্রধান কার্যালয়ের কনস্টেবল আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে সিআর (কমপ্লেইন রেজিস্টার) মামলা করা হয়েছে। এই মামলা বিচারাধীন থাকায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার হওয়ায় ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে পটুয়াখালী জেলা কার্যালয়ের কনস্টেবল ইমরান হোসেনের বিরুদ্ধে।
এদিকে, হত্যা মামলায় গ্রেফতার এক আসামিকে মুক্ত করা ও এক ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রধান কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী হায়দার হোসেনের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগটির তদন্ত চলছে।
অতীতে গৃহীত বিভাগীয় ব্যবস্থা :জানা গেছে, অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণের অভিযোগে গত ৬-৭ বছরে দুদক দেড় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। বর্তমানে ১৩ জনের বিভাগীয় মামলা ঝুলে রয়েছে। এর আগে দুর্নীতির দায়ে উপপরিচালক শফিকুল ইসলামকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। দুর্নীতির দায়ে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া উপপরিচালক আহসান আলীর নামে রাজধানীর নিকুঞ্জে তিনতলা বিলাসবহুল একটি বাড়ি রয়েছে। খিলগাঁওয়ে রয়েছে আরেকটি বাড়ি। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে উপপরিচালক গোলাম মোস্তফা ও জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সহকারী পরিদর্শক হাফিজুল ইসলামকে অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত করা হয় উপপরিচালক ঢালি আবদুস সামাদকে।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে উপপরিচালক রামমোহন নাথ, উপপরিচালক এসএম শাহিদুর রহমান ও কোর্ট সহকারী ওবায়দুল্লাহ খালেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
এ ছাড়া অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ছয় কর্মচারীকে। তারা হলেন_ সহকারী পরিচালক সাঈফ মাহমুদ, সহকারী পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান, মো. কামরুজ্জামান, কনস্টেবল জামিল মোহাম্মদ খান ও ফারুক আহমেদ। দুর্নীতির দায়ে চাকরি থেকে অপসারণ করা নয় কর্মচারী হলেন_ ডাটা এন্ট্রি/কন্ট্রোল অপারেটর আবদুর রহমান, কনস্টেবল ফরহাদ হোসেন, এসএম গোলাম কিবরিয়া, আবু বকর সিদ্দিক, আবদুল মোতালিব মিয়া, গোলাম রব্বানী, আলমগীর হোসেন, অমিত কুমার দাস ও গাড়িচালক গোলজার হোসেন ভূঁইয়া।