রাইয়ান বিন লুৎফর রহমান
প্রতি বছরই আমাদের দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ হজ্জে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারাতে মাদীনার উদ্দেশ্যে আরবভ‚মি সফর করে থাকেন। এছাড়াও রুজি-রোযগারের উদ্দেশ্যেও আমাদের দেশের অনেক মানুষ সেখানে প্রবাস জীবন যাপন করছেন। যে উদ্দেশ্যেই হোক, আরবের পুণ্যভ‚মি সফর করতে পারা অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়। তবে সাম্প্রতিককালে আমাদের কিছু ভাই সেখান থেকে সফর করে এসে মুজতাহিদ ইমামগণ এবং তাঁদের সংকলিত ফিকহী মাযহাব সম্পর্কে বিভিন্নরকম বিষোদগার করে থাকেন। এসব ফিকহী মাযহাব কোত্থেকে এল? আরবে মাযহাব এবং তাকলীদ বলতে তো কিছু নেই? আরবের আলেমগণ তো কোনো মাযহাব অনুসরণ করেন না ইত্যাদি নানা রকম মন্তব্য তাঁদের মুখে শোনা যায়। সাধারণ মানুষকেও তাঁরা মাযহাব এবং তাকলীদ সম্পর্কে বিরূপ ও বীতশ্রদ্ধ করে থাকেন। অথচ বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অধিকাংশ আরব আলেম কোনো না কোনো মাযহাবেরই অনুসারী। কোনো কোনো আলেম সরাসরি কোনো মাযহাবের সাথে নিজেকে সম্পর্ক বা সম্বন্ধ না করলেও ফিকহ ও ফতোয়া, মাযহাব এবং মাযহাবের অনুসারীদের প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ করেন। আর সাধারণ মানুষের জন্য তাকলীদকে জরুরি মনে করে থাকেন। আলিমদের অনুসরণ ও তাদের সাথে যুক্ত থাকার জন্য উৎসাহিত করে থাকেন। মাযহাব তাকলীদকে গোমরাহী আখ্যা দেওয়ার যে প্রবণতা তা ওখানের দায়িত্বশীল আলিমগণের বা অনুসরণীয় মাশাইখের প্রবণতা নয়। এটা মূলত অপরিপক্ক ইলমের অধিকারী আবেগপ্রবণ কিছু লোকের প্রবণতা। এখানে নমুনা স্বরূপ সৌদি আরবের এমন কয়েকজন শাইখের বক্তব্য উল্লেখ করার প্রয়াস পাব, যাদেরকে মাযহাব ও তাকলীদ বিরোধীরাও অনুসরণীয় মনে করেন (বরং নিজেরাও তাদের অনুসরণ করে থাকেন)।
১. শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদী-এর বক্তব্য
আরবের মাটিতে তাওহীদ ও সুন্নাহকে যিন্দা করা এবং শিরক-বিদআত নির্মূলে যারা অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদী রাহ.। বর্তমানে সৌদি আরবের অধিকাংশ আলিম শাইখ নাজদী রাহ.-এর চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শে বিশ্বাসী। আমাদের সালাফী বন্ধুরাও তাঁর রচিত ‘কিতাবুত তাওহীদ’ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করে থাকেন। মাযহাব ও তাকলীদের বিষয়ে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদী-এর অনেক বক্তব্য রয়েছে। কিছু এখানে উল্লেখ করছি। এক জায়গায় তিনি বলেন-
ونحن أيضاً في الفروع، على مذهب الإمام أحمد بن حنبل، ولا ننكر على من قلد أحد الأئمة الأربعة، دون غيرهم، لعدم ضبط مذاهب الغير؛ الرافضة، والزيدية، والإمامية، ونحوهم؛ ولا نقرهم ظاهراً على شيء من مذاهبهم الفاسدة، بل نجبرهم على تقليد أحد الأئمة الأربعة .
অর্থ : আমরা ফিকহী বিষয়ে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রাহ.-এর মাযহাবের অনুসারী। যারা চার ইমামের কোনো একজনের তাকলীদ করে আমরা তাদের উপর কোনো আপত্তি করি না। কারণ (চার ইমামের মাযহাব সংকলিতরূপে বিদ্যমান। পক্ষান্তরে) অন্যদের মাযহাব সংকলিত আকারে বিদ্যমান নেই। তবে রাফেযী,যাইদিয়া, ইমামিয়্যাহ ইত্যাদি বাতিল মাযহাব-মতবাদের অনুসরণকে আমরা স্বীকৃতি দিই না। বরং তাদেরকে চার ইমামের কোনো একজনের তাকলীদ করতে বাধ্য করি। -আদ দুরারুস সানিয়্যা ১/২৭৭
শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদীর উপরোক্ত বক্তব্যই প্রমাণ করে তিনি চার মাযহাবের কোনো একটির অনুসরণকে কতটা জরুরি মনে করতেন। সেই সাথে এটাও স্পষ্ট হল যে, তিনি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। যারা তাঁর নামে প্রচার করেছিল যে, ‘তিনি তাকলীদকে বর্জন করেছেন এবং চার মাযহাবের গ্রন্থগুলিকে বাতিল বলেন’ তিনি তাদের এই প্রচারণার বাস্তবতা খণ্ডন করে বলেছেন :
قوله : إني مبطل كتب المذاهب الأربعة، وإني أقول إن الناس من ستمائة سنة ليسوا على شيء وإني أدعي الاجتهاد، وإني خارج عن التقليد... هذا بهتان عظيم .
অর্থ : যারা আমার নামে প্রচার করছে যে, আমি চার মাযহাবের কিতাবগুলোকে বাতিল বলি, আমি নাকি বলি মানুষ ছয়শ বছর ধরে ভুলের উপর আছে, আমি ইজতিহাদের দাবি করেছি এবং তাকলীদকে বর্জন করেছি, (তাদের এই অপপ্রচারের জবাবে শুধু এটাই বলব,) এটা আমার উপর মিথ্যা অপবাদ। -আর রাসায়েলুস শাখসিয়্যাহ, পৃ. ৪
২. শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আলে শায়খ রাহ.
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম রাহ. ছিলেন সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতী এবং শায়খ ইবনে বায রাহ.সহ অনেক আলেমের উস্তায। তাঁর সম্পর্কে শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান আলজিবরীন বলেন,
قد لاحظنا ان الشيخ ابن ابراهيم يشرح كتب الحنابلة كالروض المربع ونحوه ويقرر مسائله، ولا يخرج عنها إلا قليلا.
‘আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আলে শায়খ রাহ. হাম্বলী মাযহাবের কিতাবসমূহ যেমন ‘আররওযুল মুরবী’ ইত্যাদির ব্যাখ্যা করতেন এবং এখানে উল্লেখিত মাসআলার প্রমাণাদি আলোচনা করতেন। খুব কমই এখান থেকে সরে আসতেন।’ -ভ‚মিকা : আল ইজায ফী ব‘দী মাখতালাফা ফীহিল আলবানী ওয়াবনু আসাইমীন ওয়াবনু বায১/৬
৩. শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে সা‘দী রাহ.
যে সকল মাসআলায় ফিকহ-ফতোয়ার ইমামগণের মাঝে শরয়ী দলীলের ভিত্তিতে ইখতিলাফ হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের কর্তব্য, নিজ অঞ্চলের আলিমদের ফতোয়া অনুসরণ করা। সালাফের যুগে এই নীতিই অনুসরন করা হত। অথচ অনেক সময় গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুদের দেখা যায়, তারা মতভেদপূর্ণ মাসআলায় নিজ দেশের আলিমদের পরিবর্তে আরব জাহানের আলিমদের ফতোয়া অনুসরণ করেন এবং অন্যদেরকেও তা মানার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। এটা সঠিক নিয়ম নয়। খোদ আরবের আলেমগণ বলে গেছেন, সাধারণ মানুষের কর্তব্য- মতভেদপূর্ণ মাসআলায় নিজ দেশের আলিমদের তাকলিদ করা। যারা এই নীতি অনুসরন করতে বলেছেন তাঁদের অন্যতম হলেন সৌদি আরবের শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে সা‘দী রাহ.।
তিনি শাইখ উছাইমীন রাহ.-এর উস্তায ছিলেন। শাইখ উছাইমীন রাহ. বলেন,
فالعامي يجب عليه أن يقلد علماء بلده الذين يثق بهم، وقد ذكر هذا شيخنا عبد الرحمن بن سعدي رحمه الله، وقال: "العامة لا يمكن أن يقلدوا علماء من خارج بلدهم؛ لأن هذا يؤدي إلى الفوضى والنزاع"
অর্থ : সাধারণ মানুষের জন্য আবশ্যক হল নিজ দেশের আলিমদের তাকলীদ করা। এই বিষয়টি আমাদের উস্তায আব্দুর রহমান ইবনে সা‘দী রাহ. বলে গেছেন। তিনি বলতেন : সাধারণ মানুষের জন্য অনুচিত নিজ দেশের আলিমদের পরিবর্তে অন্য দেশের আলিমদের তাকলীদ বা অনুসরণ করা। কেননা এর দ্বারা লাগামহীনতা ও বিবাদ-বিসংবাদের সৃষ্টি হয়। -লিকাআতুল বাবিল মাফতুহ ১৯/৩২
গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুরা যদি উপরোক্ত নীতি অনুধাবন করতেন এবং অনুসরণ করতেন তাহলে সকল ঝগড়া-বিবাদ এমনি খতম হয়ে যেত।
৪. শাইখ আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ.-এর বক্তব্য
সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতী শাইখ ইবনে বায রাহ.-কে তাঁর ফিকহী মাযহাব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন,
مذهبي في الفقه هو مذهب الإمام أحمد بن حنبل رحمه الله.
‘ফিকহের ক্ষেত্রে আমার মাযহাব হল, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর মাযহাব’। -মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে বায ৪/১৬৬
তিনি আরো বলেছেন,
وأتباع الشيخ محمد بن عبد الوهاب رحمه الله كلهم من الحنابلة، ويعترفون بفضل الأئمة الأربعة و يعتبرون أتباع المذاهب الأربعة إخوة لهم في الله.
অর্থ : শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদীর অনুসারী সকলেই হাম্বলী মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত। তারা চার ইমামকেই অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেন এবং চার মাযহাবের অনুসারীদেরকে নিজেদের দ্বীনী ভাই মনে করে থাকেন। -মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে বায ৫/১৫০
ফিকহী মাযহাবগুলি সম্পর্কে সাধারণত আমাদের গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুরা ধারণা করেন যে, এগুলো নতুন সৃষ্ট এবং এই ফিকহী মতপার্থক্য মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতিকে বিনষ্ট করেছে এবং তাঁদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। শায়েখ ইবনে বায রাহ. এই ধারণা খÐন করে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,
وأنتم تعلمون حفظكم الله أن الخلاف المذهبي في أمور الفروع واقع منذ قديم الزمان، ولم يؤد ذلك إلى البغضاء والتشاحن والشقاق.
অর্থ : আল্লাহ আপনাদের রক্ষা করুন নিশ্চয়ই আপনারা অবগত আছেন যে, দ্বীনের ফুরু‘ বা শাখাগত মাসায়েলে ফিকহী মাযহাবসমূহের মধ্যে যে মতপার্থক্য তা নতুন নয় বরং প্রাচীনযুগ (সাহাবাযুগ) থেকেই চলে আসছে। আর এই মতপার্থক্য মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোনোরকম হিংসা-বিদ্বেষ এবং বিভক্তি সৃষ্টি করেনি।-মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে বায ৫/১৪৯
দ্বীনের ফুরু‘ বা শাখাগত মাসায়েলে মতভিন্নতা যে সালাফ থেকেই চলে আসছে এবং এটা কোনো বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা নয় এই বিষয়টি শাইখ ইবনে বায রাহ. অসংখ্য জায়গায় বলেছেন। এক জায়গায় তিনি লেখেন,
فقد كان أصحاب الرسول صلى الله عليه وسلم والعلماء بعدهم رحمهم الله يختلفون في المسائل الفرعية، ولا يوجب ذلك بينهم فرقة ولا تهاجرا...
অর্থ : রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ এবং তাঁদের পরবর্তী উলামায়ে কেরাম শাখাগত অনেক মাসায়েলে মতভেদ করেছেন। কিন্তু এই মতভেদ তাঁদের মাঝে বিভেদ ও বিভক্তি সৃষ্টি করেনি কেননা তাঁদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য ছিল দলীলের ভিত্তিতে সত্যকে জানা। সুতরাং কোনো বিষয়ে যখন দলীলের মর্ম তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে তখন তারা একমত হয়ে গেছেন। আর যখন তাঁদের কারো নিকট দলীলের মর্ম অস্পষ্ট ছিল তখন তাঁদের মাঝে মতপার্থক্য হয়েছে। কিন্তু কেউ তাঁর ভাইকে গোমরাহ বলেননি এবং এর ভিত্তিতে সম্পর্কচ্ছেদ করা, তার পিছনে নামায ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হননি। সুতরাং আমাদের সকলের কর্তব্য হল, আল্লাহকে ভয় করা। হককে আকড়ে ধরা। ঈমানী ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করা এবং শাখাগত মাসায়েলে মতভিন্নতার দরুণ বিভেদ-বিচ্ছিন্নতায় লিপ্ত না হওয়ার যে আদর্শ সালাফে সালেহীন রেখে গেছেন তা গ্রহণ করা। -মাজমুউ ফাতওয়া ইবনে বায ১১/১৪২-১৪৩
ফিকহী মাযহাব সম্পর্কে লা মাযহাবী বন্ধুদের দৃষ্টিভংগী যে ইবনে বায রাহ.-এর দৃষ্টিতে ঠিক নয়, আশা করি উপরের আলোচনা দ্বারা সকলের নিকট স্পষ্ট হয়ে গেছে।
৫. শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আলউছাইমীন রাহ.-এর বক্তব্য :
সৌদি আরবের আরেকজন সম্মানিত আলিম, সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আলউছাইমীন রাহ.-এরও মাযহাব ও তাকলীদের সমর্থনে একাধিক বক্তব্য রয়েছে। তিনি নিজের ফিকহী মাসলাকের পরিচয় দিতে গিয়ে স্পষ্ট বলেছেন,
نحن الآن مذهبنا مذهب الامام أحمد رحمه الله.
অর্থ : বর্তমানে আমাদের মাযহাব হল, ইমাম আহমাদ রাহ.-এর মাযহাব। -লিকাআতুল বাবিল মাফতুহ ১২/১০০
মাযহাব মানার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করতে গিয়ে আরো লেখেন :
الانتماء الى المذهب ودراسة قواعده و أصوله يعين الإنسان على فهم الكتاب والسنة.
অর্থ : কোনো মাযহাবের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হওয়া এবং তাঁর উসূল ও কাওয়ায়েদ অধ্যয়ন করা মানুষকে কুরআন-সুন্নাহ বুঝতে সহায়তা করে। -মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইলে উছাইমীন ২৬/২৪৫
এছাড়া শাইখ উছাইমীন রাহ.-এর শরাহ-ভাষ্যসহ প্রকাশিত ইবনে কুদামা মাকদীসী রাহ.-এর ‘লুমআতুল ই‘তিকাদ’ কিতাবে স্পষ্ট লিখা আছেÑ
وأما النسبة إلى إمام في فروع الدين كالطوائف الأربع فليس بمذموم، فإن الاختلاف في الفروع رحمة، والمختلفون فيه محمودون في اختلافهم، مثابون في اجتهادهم، واختلافهم رحمة واسعة، واتفاقهم حجة قاطعة.
অর্থ : দ্বীনের ফুরু‘ তথা শাখাগত বিষয়ে কোনো ইমামের সাথে সম্বন্ধ নিন্দার বিষয় নয়। যেমন চার মাযহাব। কারণ, ফুরু‘-এর ক্ষেত্রে মতভেদ হচ্ছে রহমত। এই মতপার্থক্যকারীগণ তাদের মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে প্রশংসিত এবং ইজতিহাদের ক্ষেত্রে আজর ও ছওয়াবের অধিকারী। তাদের মতপার্থক্য হল, প্রশস্ত রহমত আর তাদের মতৈক্য হচ্ছে অকাট্ট দলীল।
ইবনে কুদামা রা.-এর উপরোক্ত বক্তব্যকে দালিলিকভাবে প্রমাণ করতে গিয়ে শাইখ উছাইমীন রাহ.-এর ব্যাখ্যায় লেখেন,
الفروع: جمع فرع وهو لغة : ما بني على غيره، واصطلاحًا: ما لا يتعلق بالعقائد، كمسائل الطهارة والصلاة ونحوها.
والاختلاف فيها ليس بمذموم حيث كان صادرًا عن نية خالصة واجتهاد، لا
عن هوى وتعصب؛ لأنه وقع في عهد النبي -صلى الله عليه وسلم- ولم ينكره، حيث قال في غزوة بني قريظة: "لا يصلين أحد العصر إلا في بني قريظة، فحضرت الصلاة قبل وصولهم فأخر بعضهم الصلاة، حتى وصلوا بني قريظة، وصلى بعضهم حين خافوا خروج الوقت، ولم ينكر النبي -صلى الله عليه وسلم- على واحد منهم" رواه البخاري، ولأن الاختلاف فيها موجود في الصحابة وهم خير القرون؛ ولأنه لا يورث عداوة ولا بغضاء ولا تفرق كلمة.
অর্থ : ...আর পরিভাষায় ফুরু‘য়ী বা দ্বীনের শাখাগত মাসায়েল হল, যা আকীদা সম্পৃক্ত নয়, যেমন পবিত্রতা এবং নামাযের বিভিন্ন মাসায়েল। আর এক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য, এটা কোনো নিন্দনীয় বিষয় নয়। যখন এর ভিত্তি হয় বিশুদ্ধ নিয়্যতের সাথে ইজতিহাদ। খেয়াল-খুশি বা অন্যায় পক্ষপাত নয়। কারণ তা নবীযুগেও সংঘটিত হয়েছে কিন্তু তিনি এর উপর কোনো আপত্তি করেননি। যেমন বনু কুরাইযার যুদ্ধের সময় তিনি বললেন, তোমরা বনু কুরাইযায় আসরের নামায পড়বে। অতপর গন্তব্যে পৌঁছার পূর্বেই আসরের সময় হয়ে গেল। একদল নামাযকে বিলম্বিত করলেন, বনী কুরায়যায় পৌঁছে নামায পড়লেন। আর একদল সময় চলে যাচ্ছে দেখে পথিমধ্যেই নামায পড়ে নিলেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল কোনো পক্ষের উপরই আপত্তি করলেন না,তিরষ্কার করলেন না। আর তাছাড়া এধরনের মতপার্থক্য তো সাহাবীদের মাঝেও হয়েছে। আর তারা হলেন এ উম্মতের সর্বোত্তম শ্রেণী। আর এই মতপার্থক্য উম্মাহর মাঝে কোনোরূপ হিংসা-বিদ্বেষ বা অনৈক্য সৃষ্টি করেনা।-শরহু লুমআতুল ই‘তিকাদ পৃষ্ঠা ১৬৪
যারা শাখাগত বিভিন্ন মাসায়েলে মতভিন্নতা দেখে ফিকহী মাযহাবসমূহের ব্যাপারে সংশয়-সন্দেহ পোষণ করেন এবং একে উম্মাহর মাঝে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা সাব্যস্ত করেন তাঁদের জন্য শাইখ উসাইমীন রাহ.-এর উপরোক্ত বক্তব্যে অনেক বড় শিক্ষা রয়েছে।
যারা ইজতিহাদী মাসায়েলে ভিন্নমত পোষণকারীদেরকে গোমরাহ-বিদআতী হিসেবে আখ্যায়িত করে, তাঁদের কঠোর সমালোচনা করে শাইখ উছাইমীন রাহ. বলেনÑ ‘যে বিষয়ে ইজতিহাদ বা গবেষণার অবকাশ রয়েছে সে বিষয়ে কাউকে সুন্নাতের পরিপন্থী-বিদআতী বলতে আমি সংকোচবোধ করি। এটা উচিত নয়। ... এ বিষয়টি কারো গবেষণার বিরোধী হলে তাকে সরাসরি বিদআতী বলা খুবই কঠিন বিষয়। এ ধরনের বিষয়ে বিদআত শব্দ উচ্চারণ করা কারো পক্ষে উচিত নয়। কেননা যেসকল বিষয়ে গবেষণার অবকাশ থাকে এবং হতে পারে এ মতটি সঠিক অথবা ঐ মতটি সঠিক, তাতে পরস্পরে বিদআতের অপবাদ দিতে শুরু করলে মুসলিমসমাজে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হবে। একে অপরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের সূচনা হবে। ইসলামের শত্রæরা তা নিয়ে হাসাহাসি করবে। -ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম পৃষ্ঠা ৩৯২
শাইখ উছাইমীন রাহ. সাধারণ মানুষের জন্য তাকলীদকে অত্যন্ত জরুরি মনে করতেন। বিশেষত মতপার্থক্যপূর্ণ মাসআলায় নিজ দেশের আলিমদের অনুসরণ এবং তাদের সাথে যুক্ত থাকার প্রতি জোর তাকিদ দিতেন। এক জায়গায় তিনি লেখেন-
أن يكون المقلد عاميا لا يستطيع معرفة الحكم بنفسه، ففرضه التقليد، لقوله تعالي ( فاسألوا أهل الذكر إن كنتم لا تعلمون)
অর্থ : যেসব সাধারণ মানুষ সরাসরি শরীয়তের বিধি-বিধান জানতে সক্ষম নন তাদের জন্য তাকলীদ করা ফরয। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
(তরজমা) তোমরা যদি না জান তাহলে আহলে ইলমদের জিজ্ঞাসা কর। -আলউসুল মিন ইলমিল উসূল, পৃ. ৮৭
নিজ অঞ্চলের আলিমদের অনুসরণের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে শাইখ উছাইমীন রাহ. বলেন-
...لأن فرضك أنت هو التقليد، وأحق من تقلد علماؤك، ولو قلدت من كان خارج بلادك أدى ذلك إلى الفوضى في أمر ليس عليه دليل شرعي... فالعامي يجب عليه أن يقلد علماء بلده الذين يثق بهم.
অর্থ : ...নিশ্চয়ই তোমার কর্তব্য হল তাকলীদ করা। আর তোমার তাকলীদের সবচে বড় হকদার হল তোমার (দেশের) আলিমগণ। যদি তুমি তা না করে বাইরের দেশের আলিমদের তাকলীদ কর তবে তা লাগামহীনতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে। সুতরাং সাধারণ মানুষের কর্তব্য নিজ দেশের আলিমদের অনুসরণ করা।-লিকাআতুল বাবিল মাফতুহ ১৯/৩২
গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুদের ধারণা, তাকলীদ চতুর্থ শতাব্দীতে শুরু হয়েছে। অথচ তাকলীদ সাহাবা যুগ থেকেই চলে আসছে। এ বিষয়ে শাইখ উছাইমীন রাহ. লেখেন :
والتقليد في الواقع حاصل من عهد الصحابة رضي الله عنهم. ولا شك أن من الناس في عهد الصحابة رضي الله عنهم وإلى عهدنا هذا من لا يستطيع الوصول إلى الحكم بنفسه لجهله وقصوره، ووظيفة هذا أن يسأل أهل العلم، وسؤال أهل العلم يستلزم الأخذ بما قالوا، والأخذ بما قالوا هو التقليد.
অর্থ : বাস্তব কথা হল, তাকলীদ সাহাবা যুগ থেকেই চলে আসছে। কেননা সাহাবা যুগ থেকে নিয়ে এই যুগ পর্যন্ত সবসময়ই এমন মানুষ থাকেন, যারা নিজে নিজে শরীয়তের বিধান জানতে সক্ষম নন। তাঁদের কর্তব্য, আহলে ইলমদের জিজ্ঞাসা করে সেই অনুপাতে আমল করা। আর এটাই তাকলীদ। -ফতোয়া নূর আলাদদারবি ২/২২০
মাযহাব এবং তাকলীদ বিষয়ে শাইখ উসাইমীন রাহ. যা বললেন, এরপরেও যদি আমাদের ঐ বন্ধুরা আশ্বস্ত না হন তবে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।
৬. শায়খ সালিহ ইবনে ফাওযানের বক্তব্য
সৌদি আরবের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলিম শায়খ সালিহ ইবনে ফাওযানেরও এ বিষয়ে বেশ কিছু বক্তব্য রয়েছে। মাযহাব অনুসরণ যে জরুরি এই বিষয়টি স্পষ্ট করতে গিয়ে শায়খ সালিহ ফাওযান লেখেনÑ
هاهم الأئمة من المحدثين الكبار كانوا مذهبيين، فشيخ الاسلام ابن تيمية وابن القيم كانا حنبليين، والإمام النووي وابن حجر شافعيين، والإمام الطحاوي كان حنفيا وابن عبدالبر كان مالكيا.
অর্থ : বড় বড় হাদীস বিশারদ ইমামগণ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. ও ইবনুল কায়্যিম রাহ. ছিলেন হাম্বলী, ইবনে হাজার রাহ. ও ইমাম নববী রাহ. ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। ইমাম ত্বহাবী রাহ. ছিলেন হানাফী মাযহাবের অনুসারী। ইবনু আব্দিল বার রাহ. ছিলেন মালেকী মাযাহবের অনুসারী। -ইয়ানাতুল মুসতাফিদ শরহু কিতাবিত তাওহীদ ১/১২
৭. শায়েখ আবু বকর জাবের আল জাযায়েরী রাহ.-এর বক্তব্য
সৌদি আরবের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলিম, মসজিদে নববীর ওয়ায়েজ আবু বকর জাবের জাযায়েরী সূরা আম্বিয়া এর ৭নং আয়াত فاسألوا أهل الذكر إن كنتم لا تعلمون-এর তাফসীরে লেখেন :
وفي الآية دليل على وجوب تقليد العامة العلماء، إذ هم أهل الذكر، ووجوب العمل بما يفتونهم به ويعلمونهم به.
অর্থ : উপরের আয়াতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে সাধারণ মানুষের উপর উলামাদের তাকলীদ করা ওয়াজিব। কেননা আয়াতে ‘আহলুয যিক্র’ বলে উলামাদেরকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। সুতরাং আলেমগণ যা ফতোয়া দেন, যা শিক্ষা দেন সেটার উপর আমল করা ওয়াজিব। -আইসারুত তাফাসীর পৃ. ৭৭০
৮. শায়খ আতিয়্যা সালিম-এর বক্তব্য
সৌদি আরবের আরেকজন প্রসিদ্ধ আলিম, মসজিদে নববীর মশহুর মুদাররিস এবং মদীনা মুনাওওয়ারার কাযী শায়খ আতিয়্যা সালিম রাহ. যারা ফিকহী মাযহাবের দলীল নির্ভর মতভেদকে দোষণীয় মনে করেন এবং উম্মাহর মাঝে বিভেদ-বিচ্ছন্নতা জ্ঞান করে একে নির্মূল করার চেষ্টা করছেন তাঁদের চিন্তাকে সংশোধন করে বলেন-
إن الاختلاف أمر من لوازم البشر، ولا يمكن رفعه، ولأنه لا يشكل خطرا على الأمة، فقد كانوا يختلفون في الرأي مع اتحاد كلمتهم وتوحيد صفوفهم.
অর্থ : নিশ্চয়ই ইখতিলাফ বা মতভিন্নতা মানুষের স্বভাবজাত একটি বিষয়। এটি নির্মূল করা সম্ভব নয়। (দলীল নির্ভর) ইখতিলাফ উম্মাহর জন্য কোনো ক্ষতিকর বিষয় নয়। তাঁরা (সালাফে সালেহীন) অনেক বিষয়ে মতভেদ করেছেন। কিন্তু এ সত্তে¡ও তাঁরা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। তাঁদের মাঝে কোনো বিভেদ ছিল না। -মাওকিফুল উম্মাহ মিন ইখতিলাফিল আইম্মাহ পৃ. ১৪
৯. শায়খ শানকীতি রাহ.-এর বক্তব্য
সৌদি আরবের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন শায়খ শানকীতি রাহ.। তাঁর ‘আযওয়াউল বয়ান’ তো খুবই প্রসিদ্ধ। শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ উসাইমীন রাহ.ও অনেক সময় ‘আযওয়াউল বয়ান’ কিতাবের হাওয়ালা দিয়ে থাকেন। (দ্র. ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম পৃ. ৩৯৭) এই কিতাবে শায়খ শানকীতি রাহ. লেখেন-
ولم يختلف العلماء، أن العامة عليها تقليد علمائها، وأنهم المرادون بقول الله عز وجل: فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ.
অর্থ : এ বিষয়ে কোনো আলিমের দ্বিমত নেই যে, সাধারণ মানুষের জন্য আলিমদের তাকলীদ করা আবশ্যক। কেননা আয়াতে আহলুয যিকর দ্বারা আহলে ইলমই উদ্দেশ্য। -আযওয়াউল বয়ান ৭/৪৯৫
তিনি আরো লেখেন-
وقد أمر الله تعالى بطاعته وطاعة رسوله وأولى الأمر، وهم العلماء أو العلماء والأمراء، وطاعتهم تقليدهم فيما يفتون به.
অর্থ : আল্লাহ তাআলা মানুষকে তার আনুগত্য করার, রাসূলের আনুগত্য করার এবং ‘উলুল আমর’-এর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। উলুল আমর দ্বারা উদ্দেশ্য হল আলেমগণ অথবা উলামা ও উমারা উভয়ই। তাঁদের আনুগত্যের অর্থ হল, তাঁরা যে ফতোয়া দেন সেই বিষয়ে তাদের তাকলীদ করা। -আযওয়াউল বয়ান ৪/৫০১
১০. রাবেতা আলমে ইসলামীর সিদ্ধান্ত
সবশেষে ফিকহি মাযহাবের ইখতিলাফ ও মতভিন্নতার ধরন সম্পর্কে বর্তমান যুগের বড় বড় মনীষীর প্রতিনিধিত্বে ১৪০৭ হিজরীতে ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী’ মক্কা মুকাররমায় যে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছিল তার মূল অংশ তুলে ধরছি-
“মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত চিন্তানৈতিক মতবিরোধ সাধারণত দু’ধরনের।
ক) আকীদা ও বিশ্বাসগত মতবিরোধ। খ) আহকাম ও বিধানগত মতবিরোধ।
প্রথমোক্ত মতবিরোধ...। আর দ্বিতীয়তটি হল, কিছু বিধানের ক্ষেত্রে ফিকহী মাযহাবসমূহের মতপার্থক্য, যার অনেক শাস্ত্রীয় কারণ রয়েছে। এবং যাতে আল্লাহ তাআলার নিগূঢ় হিকমত রয়েছে। যেমন বান্দাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ এবং নুসূস থেকে আহকাম ও বিধান উদঘাটনের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করা। তাছাড়া এটা হল অল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক বিরাট নিআমত এবং ফিকহ ও কানুনের মহাসম্পদ, যা মুসলিম উম্মাহকে দ্বীন ও শরীয়তের ক্ষেত্রে প্রশস্ততা দিয়েছে। ফলে তা নির্ধারিত একটি হুকুমের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে না, যা থেকে কোনো অবস্থাতেই বের হওয়ার সুযোগ নেই। বরং যে কোনো সময়ই কোনো বিষয়ে যদি কোনো একজন ইমামের মাযহাব সংকীর্ণতার কারণ হয়ে যায় তাহলে শরঈ দলিলের আলোকেই অন্য ইমামের মাযহাবে সহজতা ও প্রশস্ততা পাওয়া যাবে। তা হতে পারে ইবাদত সংক্রান্ত বিষয়ে অথবা মুআমালা সংক্রান্ত অথবা পারিবারিক কিংবা বিচার ও অপরাধ সংক্রান্ত। তো আহকাম ও বিধানের ক্ষেত্রে এ ধরনের মাযহাবী ইখতিলাফ আমাদের দ্বীনের জন্য দোষের কিছু নয় এবং তা স্ববিরোধিতাও নয়। এ ধরনের মতভেদ না হওয়া অসম্ভব। এমন কোনো জাতি পাওয়া যাবে না যাদের আইন-ব্যবস্থায় এ ধরনের ইজতিহাদী মতপার্থক্য নেই।
অতএব বাস্তবতা এই যে, এ ধরনের মতভেদ না হওয়াই অসম্ভব। কেননা একদিকে যেমন নুসূসে শরয়ী অনেক ক্ষেত্রে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রাখে অন্যদিকে শরয়ী নস সম্ভাব্য সকল সমস্যাকে সুস্পষ্টভাবে বেষ্টন করতে পারে না। কারণ নুসূস হল সীমাবদ্ধ আর নিত্য-নতুন সমস্যার তো কোনে সীমা নেই।
অতএব কিয়াসের আশ্রয় নেওয়া এবং আহকাম ও বিধানের ইল্লত, বিধানদাতার মাকসাদ; শরীয়তের সাধারণ মাকসাদসমূহ বোঝার জন্য চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং এর মাধ্যমে নিত্যনতুন সমস্যার সমাধান গ্রহণ করতে হবে।
এখানে এসেই উলামায়ে কেরামের চিন্তার বিভিন্নতা দেখা দেয় এবং সম্ভাব্য বিভিন্ন দিকের কোনো একটিকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হয়। ফলে একই বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আসে। অথচ প্রত্যেকের উদ্দেশ্য হক্ব ও সত্যের অনুসন্ধান। কাজেই যার ইজতিহাদ সঠিক হবে তিনি দুটি বিনিময় পাবেন এবং যার ইজতিহাদ ভুল হবে তিনি একটি বিনিময় পাবেন। আর এভাবেই সংকীর্ণতা দূর হয়ে প্রশস্ততা সৃষ্টি হয়।
সুতরাং যে মতপার্থক্য কল্যাণ ও রহমতের ধারক তা বিদ্যমান থাকলে দোষ কেন হবে? বরং এ তো মুমিন বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার রহমত ও অনুগ্রহ। বরং মুসলিম উম্মাহর গর্ব ও গৌরবের বিষয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, কিছু মুসলমান তরুণ, বিশেষত যারা বাইরে লেখাপড়া করতে যায় তাদের ইসলামী জ্ঞানের দুর্বলতার সুযোগে কিছু গোমরাহকারী লোক তাদের সামনে ফিকহী মাসআলার এজাতীয় মতপার্থক্যকে আকীদার মতভেদের মতো করে তুলে ধরে। অথচ এ দু’য়ের মাঝে আকাশ-পাতালের ব্যবধান!
দ্বিতীয়ত যে শ্রেণীর লোকেরা মানুষকে মাযহাব বর্জনের আহবান করে এবং ফিকহের মাযহাব ও তার ইমামগণের সমালোচনা করে এবং মানুষকে নতুন ইজতিহাদের মধ্যে নিয়ে আসতে চায় তাদের কর্তব্য, এই নিকৃষ্ট পন্থা পরিহার করা, যা দ্বারা তারা মানুষকে গোমরাহ করছে এবং ঐক্যকে বিনষ্ট করছে। অথচ এখন প্রয়োজন ইসলামের দুশমনদের ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করা।”-মাজাল্লাতুল মাজমাইল ফিকহী, রাবিতাতুল আলামিল ইসলামী, মক্কা মুকাররমা, বর্ষ ১, সংখ্যা ২, পৃষ্ঠা : ৫৯,২১৯
উপরোক্ত রেজুলেশনে যাদের স্বাক্ষর রয়েছে : ‘আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে বায, রঈস; ড. আব্দুল্লাহ উমর নাসিফ, নায়েবে রঈস; মুহাম্মাদ আশশাযিলী আননাইফার, সদস্য; মুহাম্মাদ আলহাবীব ইবনুল খাওজা,সদস্য; মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সুবায়্যিল, সদস্য; আবুল হাসান আলী নদবী, সদস্য; আবু বকর জুমী,সদস্য; মুহাম্মাদ ইবনে জুবাইর, সদস্য; সালেহ ইবনে ফাওযান আলফাওযান, সদস্য; মুহাম্মাদ মাহমুদ আসসাওয়াফ, সদস্য; আব্দুল্লাহ আবদুর রহমান আলবাসসাম, সদস্য; মুস্তফা আহমাদ আযযারকা, সদস্য;মুহাম্মাদ রশীদ রাগেব কাবানী, সদস্য; ড. আহমাদ ফাহমী আবু সুন্নাহ, সদস্য; মুহাম্মাদ সালেম ইবনে আবদুল ওয়াদূদ, সদস্য।”
মোটকথা সৌদি আরবের মূল ধারার আলেমগণ মুজতাহিদ ইমামও তাদের সংকলিত ফিকহী মাযহাবসমূহের ব্যাপারে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। তারা কখনোই মাযহাবের অনুসারীদের ব্যাপারে অশালীন মন্তব্য করেন না। যারা এই ধরনের কাজে ব্যতিব্যস্ত তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে সেখানে গিয়েছে। সুতরাং যেই জিনিস হেজাযের বাইরে থেকে হেজাযের ভিতরে প্রবেশ করেছে সেটাকে আরবের মনে করে এই দেশে নিয়ে আসা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।
সূত্র: মাসিক আল কাউসার