পলাশ রহমান; ইতালি থেকে
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, একটি ছাত্র সংগঠন। ১৯৯১ সালের ২৩ আগস্ট এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামি (শাসনতন্ত্র) আন্দোলনের প্রতিষ্ঠতা আমির এবং চরমোনাইর পীর সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীমের রহ হাত ধরে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই পীর সাহেব ছিলেন একজন অত্যান্ত সম্মানী এবং শ্রদ্ধার মানুষ। তিনি পীরত্বের গণ্ডি ভেঙ্গে রাজনীতিতে এসেছিলেন। তার বহু দর্শন আছে, যা বাংলাদেশের প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে নতুনত্ব সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছিলেন, শুধু নেতার পরিবর্তন করে মানুষের ভাগ্য বদল করা যাবে না, নীতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তিনি বলেছিলেন, প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রেখে কেয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করলেও কোনো ফয়দা হবে না। বরং প্রচলিত শাসন ব্যবস্থায় যদি একজন আল্লাহর অলীকেও ক্ষমতার চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হয়, সে চোর হতে, দূর্নীতিবাজ হতে, জালিম শাসক হতে বাধ্য হবে। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার মূল অবস্থান ছিল প্রচলিত শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তিনি শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। মানব রচিত শাসনতন্ত্র সরিয়ে খোদা প্রদত্ত শাসনতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি যতোটা সম্মানী মানুষ ছিলেন ততটা জনপ্রিয় ছিলেন না। দেশের মানুষ তাকে একজন পীর বা আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবেই বেশি পছন্দ করতো। রাজনৈতিক নেতা হিসাবে মানতে খুব একটা প্রস্তুত ছিল না। এই অপ্রস্তুতি শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে নয়, তার হাজার হাজার মুরিদের মধ্যেও লক্ষ করা যেতো। তার অনেক মুরিদ ছিল বা আছে যারা আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে তাকে মানতে সব সময় প্রস্তুত ছিল। তারা পীর সাহেবের ওয়াজ শুনে ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিত। কবরের আজাব থেকে মুক্তি পথ খুঁজতে পাগলের মতো আচারণ করতো। দ্বীনের পথে অটল থাকতে, নিজেকে খোদাভীরু মুসলমান হিবাসে তৈরি করতে তারা নিয়মিত পীরের বাতিয়ে দেয়া পদ্ধুতিতে জিকির/আমল করতো। কিন্তু তারা রাজনীতিতে পীরকে নেতা হিসাবে মেনে নিতে রাজি ছিল না। যা পীর সাহেব নিজেও জানতেন। তিনি অসংখ্য বার বলেছেন, প্রকাশ্যেই বলেছেন, চরমোনাইর মাঠে বা জিকির আজগারের সময় আমি আপনাদের পীর, কিন্তু ভোট দেয়ার সময় বা রাজনীতির মাঠে আপনাদের পীর হয়ে যায় হাসিনা বা খালেদা, এমন মুরিদ আমার দরকার নেই। এমন মুরিদ পরকালে মুক্তি পাবে না। কারণ ইসলাম শুধু ধর্ম হিসাবে পালন করলে চলবে না, রাষ্ট্রীয় আদর্শ বা শাসনতন্ত্র হিসাবেও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে। এটাই আল্লাহর নবীর শিক্ষা।
সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীমের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দর্শন নিয়ে, তার বা তাদের তরিকার বাতিয়ে দেয়া আমল পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশের আলেম সমাজের মধ্যে তেমন কোনো দ্বিমত বা নালিশ ছিল বলে আমার জানা নেই। কাউকে প্রকাশ্যে কোনো দিন তার তরিকাকে ভুল, অশুদ্ধ বা বেদাতি তরিকা বলে প্রচার করতে শুনিনি। বরং শীর্ষ আলেমদের প্রায় সবাই তাদের তরিকাকে শুদ্ধ তরিকা বলে অভিমত দিয়েছেন। অনেকে আছে যারা শুদ্ধ বা অশুদ্ধ কোনো কথাই বলেন না। কেউ কেউ প্রকাশ্যে শুদ্ধ বললেও একান্তে চুপ থাকেন। প্রসঙ্গ এড়িয়ে কথা বলেন। আবার অনেকে আছেন প্রকাশ্যে চুপ থাকেন, ভেতরে ভেতরে বলেন, না ঠিক আছে। আমি মনে করি এগুলো হয় বা হতো তার জনপ্রিয়তা এবং মুরিদ সংখ্যার কারনে। কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে জেলাস ফিল করেন। আমি মনে করি এতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। বরং মানব চরিত্রের খুব সাধারণ একটা বৈশিষ্ট। যারা এই বৈশিষ্টকে যতো বেশি দমন করতে পারেন তারা হতে পারেন ততো বেশি সাধু মানুষ।
সৈয়দ ফজলুল করীম তার জীবনের বড় সময়টা জুড়ে অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করেছেন। বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েতের পথে ডেকেছেন। ইসলামি আন্দোলন প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত তিনি সরাসরি কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। অনেকটা আচমকা রাজনীতিতে আসা এই মানুষটা যে এত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন, তার রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা যে এত উর্বর ছিল তা হয়তো কেউ আন্দাজও করতে পারেনি। দেশের সাধারণ মানুষ তার রাজনৈতিক দর্শন বুঝে উঠার আগেই তিনি হারিয়ে যান। চিরতরে পাড়ি জমান পরপারে। এমন একজন নেতার হাত ধরেই ২৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই অধ্যাতিক এবং রাজনৈতিক নেতার যে কোনো সমালোচনা ছিল না তা কিন্তু নয়। কঠোর সমালোচনা ছিল এবং আছে। যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে শালীনতার সীমাও পেরিয়ে যায়। এক্ষেত্রে হয়তো একমাত্র বলা যাবে না, তবে প্রধান সমালোচক সংগঠন হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত শিবিরের নেতা কর্মীরা তার কড়া সমালোচনা করেন। তাদের তরিকার বিভিন্ন কিতাবাদির প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে তারা দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু জামায়াতের নেতারা সাধারণত প্রকাশ্যে তার কোনো সমালোচনা করেন না। ভেতরে ভেতরে বা নিজেদের কর্মী সমাবেশে যে কড়া সমালোচনা করেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় জামায়াত শিবিরের কর্মী সমর্থকদের কথা বার্তায়। মজার ব্যাপার হলো জামায়াত শিবির কর্মীরা তার যুৎসই কোনো রাজনৈতি বা ধর্মীয় সমালোচনা খুঁজে না পেয়ে যতো বিষ ঝাড়তেন এবং ঝাড়েন পীরত্বের প্রতি। পীর মুরিদি যে ইসলাম পার্মিট করে না এটা প্রমাণের জন্য তারা সর্ব শক্তি নিয়োগ করেন। এর পেছনে যৌক্তিক কারনও আছে- জামায়াত যদি তাদের কর্মী সমর্থকদের কাছে সৈয়দ ফজলুল করীমকে খারাপ মানুষ, ভুল চিন্তার মানুষ বলে উপস্থাপন না করতো তবে তাদের সাংগঠনিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার ঢের সম্ভবনা ছিল।
সমালোচনার ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধের সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাইদী ছিলেন একজন ব্যতিক্রম। তিনি বহুবার সৈয়দ ফজলুল করীমের সমালোচনা করেছেন প্রকাশ্যে। তিনি বলতেন, বাংলাদেশে একজন পীর আছে- যার বাইরটা যেমন কালো, ভেতরটাও তেমন কালো। উল্লেখ্য, সৈয়দ ফজলুল করীমের গাত্র বর্ণ কালো ছিল।
[caption id="attachment_12068" align="alignright" width="247"] মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করীম রহ.[/caption]
মাওলানা সাইদীর প্রকাশ্য সমালোচনার কারণ হতে পারে তিনি পীর সাহেবের সমালোচনা করে জামায়াতের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করতেন। আমার জানা মতে ইসলামী (শাসনতন্ত্র) আন্দোলন প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মাওলানা সাইদী। পরে জামায়াতের চাপ এবং কূটচালে তিনি সেখানে থেকে সরে গিয়েছিলেন। তিনি জামায়াতে আনুষ্ঠানিক যোগ দেয়ার পর প্রথমাবস্থায় হয়তো কিছুটা বিশ্বাস সংকটে ছিলেন। যা কাটিয়ে উঠতে পীর সাহেবকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন।
মজার ব্যাপার হলো চরমোনাইর পীর সৈয়দ ফজলুল করীম যতো দিন শুধুমাত্র পীর মুরিদি অর্থাৎ তার অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি নিয়ে ছিলেন ততোদিন তার বিরুদ্ধে জামায়াতের কোনো সমালোচনা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি যখন রাজনীতিতে এলেন, ভ্রান্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললেন, তখনই জামায়াত তার বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করে। সৈয়দ ফজলুল করীম তাদের দু'চোখের বিষে পরিণত হন। তারা তাকে ভারতের দালাল, আওয়ামীলীগের দালাল বলে প্রচার করতে শুরু করে।
মাওলানা ফজলুল করীম রহ. জামায়াতের কড়া সমালোচক ছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার মতো সাহসী এবং কড়া জামায়াত সমালোচক আর দেখা যায় না। অনেক আলেম ওলামা জামায়াত বিরোধী কথা বলেন, বলেছেন। অনেকে বই পত্রও লিখেছেন, কিন্তু সৈয়দ ফজলুল করীমের মতো সাহসী ভূমিকায় কেউ যেতে পারেননি।
একটা সময় পর্যন্ত আমি মনে করতাম, জামায়াত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত সব চেয়ে বড় ইসলামি দল, এদের বিরুদ্ধে নিজের দলকে প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি কড়া জামায়াত বিরোধিতার কৌশল গ্রহণ করে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তিতে তা আর মনে হয়নি। জামায়াত বিরোধিতার পেছনে যে তার অনেক বড় এবং দীর্ঘ উদ্দেশ্য ছিল তা প্রকাশ পেতে বেশি দিন সময় লাগেনি। তিনি জামায়াতকে লিখিত ভাবে চ্যালেঞ্জ দিয়ে ছিলেন, জামায়াত কোনো ইসলামি দল নয়, একথা যদি কোরান হাদিস দিয়ে প্রমান করতে না পারেন তবে জামায়াতে যোগ দেবেন। জামায়াত হয়তো তার এই দর্শন বুঝতে পারেনি, অথবা বুঝতে চায়নি।
সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম চেয়েছিলেন, অভ্যন্তরীন ভুল ভ্রান্তি শুধরে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের একক এবং শক্তিশালী প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে। যার প্রমাণ তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে দিয়ে গেছেন। এখন তার দলের নেতা সৈয়দ রেজাউল করীমও সম্ভবত অভিন্ন পথে হাঁটছেন।
সৈয়দ ফজলুল করীম সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিলেন। তিনি জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। শায়খুল হাসিদ মাওলানা অাজিজুল হকের নেতৃত্বে যখন ইসলামি ঐক্যজোট বিএনপির নেতৃত্বে জোট গঠন করে তখন তিনি সর্বোচ্চ বিরোধিতা করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ইসলামি ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে যান। তিনি বাংলাদেশের ইসলামি শক্তিকে কখনোই অন্য কারো ক্ষমতা সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করতে দিতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা হবে স্বতন্ত্র শক্তি। সে সময় তার এই দর্শন যদি দেশের ইসলামপন্থীরা বুঝতে পারতো, নিজেদের জাগতিক লালসা সংবরণ করতে পারতো, তবে এতদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় না থাকলেও প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় যেতে পারতো। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামি শক্তি হতে পারতো অনেক বড় ফ্যান্টর।
সৈয়দ ফজলুল করীম তার জীবনের বড় সময়টা জুড়ে অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করেছেন। বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েতের পথে ডেকেছেন। ইসলামি আন্দোলন প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত তিনি সরাসরি কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। অনেকটা আচমকা রাজনীতিতে আসা এই মানুষটা যে এত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন, তার রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা যে এত উর্বর ছিল তা হয়তো কেউ আন্দাজও করতে পারেনি। দেশের সাধারণ মানুষ তার রাজনৈতিক দর্শন বুঝে উঠার আগেই তিনি হারিয়ে যান। চিরতরে পাড়ি জমান পরপারে। এমন একজন নেতার হাত ধরেই ২৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন।
২.
২৫ বছর একদম কম সময় নয়। সিকি শতাব্দি। একজন মানুষের জন্ম থেকে পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত হতে ২৫ বছর যতেষ্ঠ সময়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একজন মানুষ ২০ বছর বয়সেই প্রথম শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হওয়ার কথা। সাথে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা যোগ করলে সময়টা কম নয়। এ বছরের আগষ্ট মাসে ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর উদযাপন করেছে। সেই হিসাবে সংগটনটি এখন যতেষ্ঠ পরিণত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? তারা কি আদৌ পরিণত হতে পেরেছে? সংগটনটিকে তারা একটি প্রথম শ্রেণির ছাত্র সংগঠনে পরিণত করতে পেরেছে? সর্ব সাধারণের কাছে নিয়ে যেতে পেরেছে তাদের সংগঠন?
ক'দিন আগে তারা ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল ছাত্র সমাবেশ করেছে। হাজার হাজার ছাত্র জনতার সমাগম হয়েছিল সেখানে। সমাবেশের চাকচিক্যও ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানে তাদের সাবেক প্রায় সব নেতা একত্রিত হয়েছিলেন। একজন ইন্ডিয়ানসহ দেশের বেশ ক'জন ভিন্ন মতের রাজনীতিককে তারা দাওয়াত করেছিলেন। দাওয়াতিদের একজন হলেন তারকা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকী। ছাত্র সমাবেশে কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য সংগঠনটির অনেক নেতাকর্মী পছন্দ করেননি। তার বক্তব্য নিয়ে অনেকেই সোস্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যারা একটু উদারপন্থী তারা বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিলেও অনেকে তা নিতে পারেননি। তাদের অভিযোগ হলো বঙ্গবীর ওই অনুষ্ঠানে বক্তৃতার নামে তাদের নেতা রেজাউল করীমকে সবক দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা বলার চেষ্টা করেছেন, কাদের সিদ্দিকী একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি ইসলামি আন্দোলনের নেতাকে যুক্তি পরামর্শ দিতেই পারেন, ইসলামি আন্দোলনের রাজনৈতিক গতিধারা নিয়ে কথা বলতেই পারেন, কিন্তু সে জন্য সময় কাল পাত্র বিবেচনা করা উচিৎ ছিল। সব জায়গায় সব কথা বলতে হয় না, মানানসই হয় না এ বিবেচনা ওনার করা উচিৎ ছিল। তাদের ক্ষোভের ক্ষত সারতে না সারতেই ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখে বসেন কাদের সিদ্দিকী। 'সবাইকে মুরিদ ভাবা উচিৎ নয়, মানুষ ভাবতে শিখুন' শিরনামের ওই কলামে কাদের সিদ্দিকী লিখেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধে চরমোনাই ছিল পাকিস্তান-ঘেঁষা। কিন্তু চরমোনাইর প্রধান সৈয়দ ফজলুল করিম ছিলেন একজন মুক্তমনা মানুষ। তাই তারা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকলেও যা নয় তা করেনি'।
আওয়ামীলীগ ছেড়ে মাথায় টুপি দিলেই যে তিনি আগের জায়গা থেকে সরে এসেছেন, আসতে পেরেছেন এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আমি যদ্দুর জানি- কাদের সিদ্দিকী মাইজভান্ডারী এবং ভারতের আজমিরি তরিকার অনুসারী। তিনি তার পীরের পরামর্শেই আওয়ামীলীগ ছেড়ে নিজে দল গঠন করেছিলেন। আওয়ামীলীগের রাজনীতি ছেড়ে ইসলামি মূল্যবোধের দিকে ঝুকেছেন। মাথায় টুপি পরে ইসলামের পক্ষে কিছু কিছু কথা বললেও তিনি তারা পুরনো রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরে আসতে পারেননি।
কাদের সিদ্দিকীর এই কথায় ঘোর আপত্তি উঠেছে দলটির ভেতরে। নেতাকর্মীরা সোস্যাল মিডিয়ায় আগের চেয়ে কয়েকগুন বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুস আহমদ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বঙ্গবীরের লেখার প্রতিবাদ করেছেন। তবে লেখাটির শিরনামসহ অন্যান্য সমালোচনার অংশ নিয়ে তারা বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং অনেকেই ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। তাদের এই উদারতা আমার ভালো লেগেছে। এক্ষেত্রে একটা বিষয় বুঝতে হবে- কাদের সিদ্দিকী ভিন্ন মতের, ভিন্ন পথের, ভিন্ন ধারার রাজনীতিক। তারা বস্তুবাদে বিশ্বাস করেন। আওয়ামীলীগ ছেড়ে মাথায় টুপি দিলেই যে তিনি আগের জায়গা থেকে সরে এসেছেন, আসতে পেরেছেন এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আমি যদ্দুর জানি- কাদের সিদ্দিকী মাইজভান্ডারী এবং ভারতের আজমিরি তরিকার অনুসারী। তিনি তার পীরের পরামর্শেই আওয়ামীলীগ ছেড়ে নিজে দল গঠন করেছিলেন। আওয়ামীলীগের রাজনীতি ছেড়ে ইসলামি মূল্যবোধের দিকে ঝুকেছেন। মাথায় টুপি পরে ইসলামের পক্ষে কিছু কিছু কথা বললেও তিনি তারা পুরনো রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরে আসতে পারেননি।
আমাদের দেশের ইসলামপন্থীদের আবেগের মাত্র বেশ অদ্ভুত। কেউ দু'লাইন ইসলামে পক্ষে কথা বললেই তারা গদগদ হয়ে যায়। তার অতীত বর্তমান বিবেচনা করে না। কাদের সিদ্দিকীর লেখায় খেয়াল করলে দেখা যাবে তিনি পুরো লেখাটাতেই নিজেকে গুরুত্বপূণ একজন মানুষ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাকে কে কতো ভালোবাসে, সম্মান করে, কতোজন তার সাথে হাত মেলালো এসব কথা জুড়ে আছে তার লেখার বড় একটা অংশে। তাছাড়া তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, তিনি চমরোনাই পীরের মুরিদ নন। তিনি মুরিদ হতে যাননি। গিয়েছেন একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক হিসাবে নসিহত করতে। অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি সে কথাই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কাদের সিদ্দিকী এবারই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিকবার ইসলামী আন্দোলনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার পীরের কাছে অথবা তার রাজনৈতিক মহলে হয়তো বিশ্বাস সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো ভাবতে শুরু করেছে কাদের সিদ্দিকী পীর পরিবর্তন করার চিন্তা করছেন। তিনি ইসলামী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। যা তিনি কোনো ভাবেই চাননি। আর তাই আগে ভাগেই পত্রিকায় কলাম লিখে নিজের অবস্থান পরিস্কার করার চেষ্টা করেছেন।
কাদের সিদ্দিকী লিখেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধে চরমোনাই ছিল পাকিস্তান-ঘেঁষা। কিন্তু চরমোনাইর প্রধান সৈয়দ ফজলুল করীম ছিলেন একজন মুক্তমনা মানুষ। তাই তারা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকলেও যা নয় তা করেনি'।
রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি স্তরের জন্য যোগ্য এবং দ্বীন মনস্ক মানুষ তৈরি হওয়া দরকার। গত ২৫ বছরে আপনারা ক'জন তৈরি করতে পেরেছেন? সচিবালয়ে ইসলামপন্থী ক'জন আছে? সেনাবাহিনীতে, বর্ডারগার্ডে ক'জন আছে? বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ক'জন আপনাদের শুভাকাঙ্খি জন্ম দিতে পেরেছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে কতোজন শুভাকাঙ্ক্ষি আছে আপনাদের? তাদের সাথে কী ধরনের সম্পর্ক রক্ষা করেন আপনারা? তাদের সাথে কি আপনাদের ওঠা-বসা হয়? অবসরে আড্ডা, আলোচনা হয়? আপনারা কি তাদের কথা শোনেন, নাকি শোনাতে বেশি পছন্দ করেন?
চরমোনাইর পীর সাহেব যে পাকিস্তান ঘেঁষা ছিলেন তা আগে কোনো দিন শুনিনি। তার ঘোর বিরোধীরাও কোনো দিন এমন অভিযোগ তোলেনি। কাদের সিদ্দিকীর এই অভিযোগের পক্ষে দলিল কি তা তিনি উল্লেখ করেননি। থামকো দু'লাইন লিখে দিয়েছেন। আমার মনে হয়েছে তিনি যে চরমোনাইপন্থী নন, তাদের নীতি আদর্শের সাথে একমত নন, ইসলামী আন্দোলনের দিকে তিনি ঝুঁকছেন না, বয়সে যুবক ইসলামী আন্দোলনের নেতাকে যে তিনি নেতা মানেন না এসব প্রমাণ করার জন্যই ওসব কথা লিখেছেন।
ইসলামী আন্দোলনের সাবেক নেতা সৈয়দ ফজলুল করীমের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ কোনো ভুমিকা ছিল না। সে সময় তিনি ছাত্র ছিলেন, ছাত্রত্ব নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। পীর সাহেবকে এমনটাই বলতে শুনেছি সংবাদ সম্মেলেনে। তবে তার বাবা মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক এবং দুলাভাই মাওলানা ইউসুফ আলী খান প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলীর লেখা ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’ বই থেকে জানা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় চরমোনাই পীর সাহেবের মাদরাসার একটি রুম মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রাগার হিসাবে ব্যবহার করা হতো। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করে থাকতেন। ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল ও ক্যাপ্টেন আবদুল লতিফ নিয়মিত পীর সাহেব মাওলানা এছহাক রহ এর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। তার পরামর্শে মাওলানা ইউসুফ আলী খানকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে মাওলানা ইউসুফ তার সমাধান করতেন। বরিশাল থানার অনেক কর্মকর্তা সে সময় সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন চরমোনাইর জামেয়া রাশিদীয়া আলিয়া মাদরাসায়।
কাদের সিদ্দিকী যে একেবারেই না জেনে কথাগুলো লিখেছেন তার প্রমাণ হলো তিনি মাওলানা ইসহাকের নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন মাওলানা ফজলুল করীমের নাম। পক্ষে বিপক্ষে যা ইচ্ছা তিনি লিখতে পারেন, তাই বলে এভাবে? এতটা আন্দাজে?
তবে নিজের অবস্থান প্রকাশ করার জন্য হোক বা যে কারণেই হোক আমি তার লেখাকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখতে চাই। তিনি না জেনে একটি ভুল তথ্য দিয়েছেন এবং প্রতিবাদ হয়েছে এতে যেমন তিনি নিজে সঠিকটা জানার সুযোগ পেয়েছেন তেমনি অনেক পাঠকও জানার সুযোগ পেয়েছে। যারা এসব বিষয়ে আগ্রহী তাদের মধ্যে একটা প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, যা মোটেও নেতিবাচক বলে আমার কাছে মনে হয়নি।
৩.
২৫ বছর বয়সী ছাত্র আন্দোলনের অর্জন কী? বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি তারা সংগঠনটি নিয়ে যেতে পেরেছে? কওমি ঘরানার মাদরাসাগুলোয় তাদের সংগঠনের বেশ জনপ্রিয়তা আছে, কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে? আলিয়া মাদরাসায়? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে? এখানে দু'জন, ওখানে পাঁচজন হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু আনুপাতিক হারে কি তারা এখনো গোণায় উঠতে পেরেছে? তাদের সংগঠনকে গোণায় তোলা সম্ভব হয়েছে? শুধুমাত্র কওমি ধারায়, দেওবন্দি ধারায় কাজ করে কি লক্ষে পৌছানো যাবে?
ইশা ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ উদ্দেশ্য কী, গন্তব্য কোথায় তা কি সবাই পরিষ্কার করে জানে? ছাত্র জনতার কাছে কি তা পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে? দেশের মানুষের মনে নাড়া দেয়ার মতো, ছাত্রদের দৃষ্টি কাড়ার মতো কোনো নেতা কি তারা তৈরি করতে পেরেছে? না পারলে কেনো পারেনি, এ নিয়ে কি তারা পর্যালোচনা করে, করেছে কখনো? সংগঠন পরিচালনার ধরণ কৌশল নিয়ে কি নতুন কিছু ভাবা হয়েছে, ভাবনায় এসেছে ? তাদের কর্মীরা সময়ের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক হতে পেরেছে? আধুনিকতা আর পশুবাদের পার্থক্য কি মানুষের মগজে ঢোকাতে পেরেছে? নাকি শুধুমাত্র চাকচিক্যে ভরপুর বিশাল বাজেটের অনুষ্ঠান করে, মেঠো বক্তব্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে?
গত ২৫ বছরে অন্তত ২৫ জন বিশ্বমানের নেতা তৈরি হওয়া উচিত ছিল এই সংগঠন থেকে, কিন্তু তা কি হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে কেনো হয়নি, তা নিয়ে কি কোনো গবেষণা হয়েছে? ইসলামী আন্দোলন বা ছাত্র আন্দোলনকে প্রায়ই একটা অভিযোগ করতে শোনা যায়, বাংলাদেশের সব মিডিয়া ইসলাম বিরোধীদের দখলে, তারা ইসলামের পক্ষের কোনো খবর গুরুত্ব দেয় না। মিডিয়ার মোড়লরা যে ইসলামের পক্ষের শক্তি না তা সবাই জানে, আপনাদের কাছ থেকে নতুন করে জানার কিছু নেই। এই ইসলাম বিরোধীদের মিডিয়া ইসলামের পক্ষে ব্যবহার করার জন্য কি কি কৌশল আপনারা গ্রহণ করেছেন? মিডিয়া কি চায়, কি ভাবে তাদের ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে ক'মিনিট গবেষণা করেছেন? আপনাদের কাভার দিতে তাদের বাধ্য করতে পারেন না কেনো? তাদের কাছ থেকে কাভার আদায় করে নিতে পারেন না কেনো? মিডিয়ায় যুগোপযগী রাজনৈতিক কথা বলার মতো ক'জন নেতা তৈরি করতে পেরেছেন আপনারা? ক'টা মিডিয়ার পেটের ভেতরে ইসলামের পক্ষের মানুষ জন্ম দিতে পেরেছেন? এসব করতে ২৫ বছর ধরে কি মেহেনত করেছেন আপনারা? নিজেদের কিভাবে তৈরি করেছেন? ক'জন মিডিয়ার মালিক, সম্পাদকের সাথে আপনাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে, বন্ধুত্ব আছে?
রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি স্তরের জন্য যোগ্য এবং দ্বীন মনস্ক মানুষ তৈরি হওয়া দরকার। গত ২৫ বছরে আপনারা ক'জন তৈরি করতে পেরেছেন? সচিবালয়ে ইসলামপন্থী ক'জন আছে? সেনাবাহিনীতে, বর্ডারগার্ডে ক'জন আছে? বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ক'জন আপনাদের শুভাকাঙ্খি জন্ম দিতে পেরেছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে কতোজন শুভাকাঙ্ক্ষি আছে আপনাদের? তাদের সাথে কী ধরনের সম্পর্ক রক্ষা করেন আপনারা? তাদের সাথে কি আপনাদের ওঠা-বসা হয়? অবসরে আড্ডা, আলোচনা হয়? আপনারা কি তাদের কথা শোনেন, নাকি শোনাতে বেশি পছন্দ করেন?
জাতীয় বুদ্ধিজীবী, টকশোজীবীদের মধ্যে কতো জনের সাথে আপনাদের সুসম্পর্ক আছে? আওয়ামীলীগ বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতাদের সাথে আপনাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব আছে ক'জনের? রাজনীতির মাঠে আপনাদের সাথে সুসম্পর্ক আছে কাদের সাথে? জামায়াতের মতো বিপদে পড়লে কে দাঁড়াবে আপনাদের পাশে? কাদের প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ সহযোগিতা পাবেন বলে আশা করেন?
অরাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক'টা সংগঠনের সাথে আপনাদের চেনা জানা আছে? তাদের কারো সাথে কি আপনাদের ব্যক্তিগত সখ্যতা আছে? ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের ক'জনকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন এবং আপনাদের চেনে? মাসে ক'বার তাদের সাথে কথা হয়, দেখা হয়? তারা কি জানে আপনারা কী চান, কেনো চান, কিভাবে চান? নাকি শুধু জানে আপনারা চাঁদা চান, আর্থিক সহযোগিতা চান!
বিদেশের ক'জন কূটনীতিকের সাথে আপনাদের সম্পর্ক আছে? তারা ক'জন আপনাদের ব্যক্তিগত ভাবে চেনে? ক'বার তাদের দাওয়াত করেছেন, তারা আপনাদের ক'বার করেছে? ক'বার আপনাদের দাওয়াতে সাড়া দিয়েছে?
আপনাদের ক'জন নেতা বিশ্ব ভ্রমণ করেছে? ইউরোপ আমেরিকা দেখেছে? দেশের রাজনীতিতে নাড়া দেয়ার মতো, বিশ্বের দৃষ্টি কাড়ার মতো ক'পাতা থিসিস তৈরি হয়েছে আপনাদের দ্বারা? দেশের অর্থনীতিতে আপনাদের অবদান কতোটুকু? শিক্ষানীতি, পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী? আপনারা কি চিন্তা করেন, আপনাদের চিন্তায় কতোটুকু নতুনত্ব আছে, তা কি দেশবাসী জানে? জানাতে পেরেছেন? জানানোর জন্য বুদ্ধিদৃপ্ত চেষ্টা করেছেন?
ইসলাম বিরোধীদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় ক'জন যোগ্য মানুষ আপনারা তৈরি করতে পেরেছেন? পরিবর্তন মূখর বিশ্ব নিয়ে আপনাদের চিন্তা কী? বিশ্ব জলবায়ূ নিয়ে আপনারা কি ভাবেন? ইসলাম এবং বিজ্ঞানে পারদর্শি ক'জন তৈরি করতে পেরেছেন গেল ২৫ বছরে?
দাওয়াতি কাজ আপনারা কিভাবে করেন? আপনাদের দাওয়াত পদ্ধতিতে নতুনত্ব কী? আধুনিকতা কী? চমক কী? কাউকে দাওয়াত দেয়ার আগে কি তার মন মানসিকতা, চিন্তা ভাবনা সম্পর্কে স্টাডি করেন, নাকি চেনা পথেই হাঁটছেন?
ছাত্র জনতার কাছে ইসলামের দাওয়াত, সংগঠনের দাওয়াত পৌঁছাতে আধুনিক কী কী কৌশল আছে আপনাদের? এসব কাজে কতোটুকু প্রযুক্তির ব্যবহার জানেন আপনারা? যা জানেন তা কি যতেষ্ঠ? দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংকটে নতুন কী দেখাতে পেরেছেন আপনারা? শ্রমিক শ্রেণি নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী? তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে আপনাদের কৌশল কী? বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে দাওয়াত দেয়ার পদ্ধতি কি একই রকম, নাকি ভিন্নতা আছে? দাওয়াতি কাজের জন্য মেধা যোগ্যতা যাচাই করে কর্মীদের আলাদা প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা কি আছে, নাকি সব গড়ে হরিবল?
ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থা কী, এর সুফল সম্পর্কে কি মানুষের মগজে কিছু ঢোকাতে পেরেছেন? ঢোকানোর জন্য কী কী কৌশল আছে আপনাদের? দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলাম নিয়ে কাজ করে এমন ক'টা সংগঠন সম্পর্কে আপনাদের স্বচ্ছ ধারণা আছে? তাদের কর্মকৌশল, দাওয়াতি কৌশল, প্রযুক্তির ব্যবহার, আধুনিকতা, তথ্যসূত্র এবং গতি নিয়ে কি আপনারা কখনো আলোচনা করেন? নিজেদের যোগ্যতা বা অযোগ্যতার সাথে মিলিয়ে দেখেন? নিজেদের সক্ষমতা যোগ্যতা বাড়াতে কি উপায়ে চেষ্টা করেন?
কথায় কথায় মুখরোচক গণবিপ্লবের কথা বলেন আপনারা, গণবিপ্লব ঘটাতে হলে যে গণমানুষকে জাগাতে হয়, গণমানুষের কানে মন্ত্র পড়ে ফু দিতে হয় তা কি আপনারা জানেন? যদি জেনে থাকেন তবে কি মন্ত্র আছে আপনাদের কাছে? আপনাদের মন্ত্র কোনো দিন যাচাই করে দেখেছেন? সন্তান ভূমিষ্টের জন্য যেমন মায়ের শরীরে প্রসব বেদনা হতে হয়, তেমনি বিপ্লব ঘটাতে হলে জাতীয় শরীরে প্রসব বেদনা সৃষ্টি করতে হয়, সে যোগ্যতা সক্ষমতা কি আছে আপনাদের?
আপনাদের আমীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, তার ভাই মুফতি ফয়জুল করীমের ওয়াজ মাহফিল, জনসভায় যে হাজার হাজার মানুষ দেখেন এগুলো কি তাদের অর্জন? তাদের যোগ্যতায় লাখ লাখ মানুষ চরমোনাইর মাহফিলে যায়? না, এগুলো ওনাদের যোগ্যতা বা অর্জন কোনোটাই না। এগুলো তাদের বাবা দাদাদের অর্জন, তাঁদের যোগ্যতা। এগুলো রক্ষা করার জন্য, এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে মূল লক্ষ্যে যাওয়ার জন্য যে যোগ্যতা থাকা দরকার তা কি বর্তমান নেতাদের মধ্যে আছে? তারা কি এখনো সেই মানের নেতা হয়ে উঠতে পেরেছেন? তারা কি খোঁজ রাখেন বিশ্বে এখন কতোজন বিশ্বমানের যুবক নেতা আছে? কতোজন তাদের বয়সের নেতা আছে? তারা কী চিন্তা করে? তাদের পরিকল্পনা কী, কৌশল কী? বাংলাদেশে যেসব যুবক নেতা আছেন তারা কোন ভাষায় কথা বলেন, কোন স্বরে বক্তৃতা করেন, কী চিন্তা চেতনা পোষণ করেন, তাদের কোন কথা মিডিয়ায় বেশি গুরুত্ব পায় তা কি আপনাদের নেতারা খোঁজ রাখেন? তাদের সাথে কি চেনা জানা আছে? বর্তমান সময়ের মানুষ কী চায়, কোন ভাষায় কথা শুনতে চায়, তাদের সাইক্লোজি কী, তা কি বুঝে আপনাদের নেতারা কথা বলেন? তাদের সাথে দেশের মূলধারা রাজনীতিকদের সম্পর্ক কতোটুুকু? তারা রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী নাকি পীর মুরিদিতে বেশি আগ্রহী তা কী আপনারা জানেন? তারা কি প্রতিদিন নিয়ম করে রাজনৈতিক অফিসে বসেন? রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করেন? দেশের প্রতিদিনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা করেন, নাকি ওয়াজ মাহফিল করতেই বেশি পছন্দ করেন?
তারা কি নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়েন, টেলিভিশন দেখেন, ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, কলাম লেখকদের লেখা নিয়ে আলোচনা করেন? এসব নিয়ে কি কখনো তাদের সাথে আপনারা খোলাখুলি কথা বলেছেন? তাদের কোনো ভুলত্রুটি কি আপনাদের চোখে পড়েছে? তাদের কোনো ভুল ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা কি কখনো করেছেন?
সারা বছর ধরেই চরমোনাইর মাঠের বক্তৃতার জন্য প্রস্তুতি নেয়া দরকার। বিষয় ভিত্তিক স্ক্রিপ্ট বানানো দরকার। স্ক্রিপ্ট নিয়ে অভিজ্ঞজনদের সাথে পর্যালোচনা করা দরকার। নিজের গলার রগে চাপ না দিয়ে মানুষের মগজে চাপ দেয়া দরকার। হৈ চৈ করে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি না করে মানুষের মনে ছোট ছোট প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেয়া দরকার। যা তাকে প্রতিনিয়ত কাঠ ঠোকরার মতো ঠোকাতে থাকবে।
আপনাদের জন্য সবচেয়ে উর্বর মাটি হলো চরমোনাইর ময়দান। এ পর্যন্ত আপনারা যতোটুকু আগাতে পেরেছেন তার ৯৮ ভাগের সূচনা হয়েছে ওই মাটি থেকে। চরমোনার মাঠ হলো মানুষের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ পাকের কবুল করা (সম্ভবত) একটা মাঠ। ওই মাঠের একটা নিজস্বতা আছে, ভাব-গাম্ভির্য আছে। ওখানের পরিবেশ আর সোহরাওয়ার্দীর পরিবেশ, প্রতিবেশ এক নয়। আপনারা যখন ছাত্র সমাবেশ করেন তখন কি এই দুই মাঠের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য করতে পেরেছেন? পার্থক্য করার চেষ্টা করেছেন? আপনাদের সাবেক নেতারা যা করেছে আপনারাও তাই করছেন! ওই মাঠের পরিবেশ, প্রভাবের গুরুত্ব নিয়ে আপনারা কোনো দিন গবেষণা করেছেন, নাকি লাখ লাখ মানুষ দেখেই আত্মতৃপ্তিতে থাকেন? ছাত্র সমাবেশের নামে আপনারা এবং ওলামা সম্মেলনের নামে গরম বক্তৃতা ওই মাঠের পরিবেশ প্রভাবকে যে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, কখনো কি এমন চিন্তা মাথায় এসেছে? কখনো কি ভেবেছেন, ওটা সোহরাওয়ার্দীর মাঠ না। ওখানে কথা বলার ঢং, বক্তৃতা করার ঢং আর সাধারণ রাজনৈতিক মাঠের ঢং এক হওয়া উচিৎ না। ওখানে ৩০ জন লাইন দিয়ে গতানুগতির বক্তৃতা না দিয়ে ৩ জন ঠাণ্ডা মাথায় গঠনমূল, তথ্যমূলক, বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তৃতা দেয়াই কি বেশি যুক্তিযুক্ত নয়? ওই মাঠের আদব লেহাজের সাথে সামজস্যপূর্ণ সমাবেশ করাই তো বুদ্ধিমানের কাজ হওয়া উচিৎ। ৩/৪ ঘন্টা ধরে কষ্ট না করে ১০ মিনিট কথা বলুন। তথ্যমূলক বুদ্ধিদৃপ্ত কথা বলুন। যা মানুষের মনের মধ্যে, মগজের মধ্যে গেঁথে থাকবে। ওখানে যেসব অভিভাবকআপনাদের কথা শুনবে তাদের মনের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হবে। তারা আপনাদের জায়গায় নিজের সন্তানকে ভাবতে শুরু করবে। আপনারা তাদের চোখে হয়ে উঠবেন সন্তানতুল্য হিরো। আমি মনে করি এতটুকু করতে পারলেই আপনাদের কাজ করা হাজারগুণ সহজ হয়ে যাবে। কারো হাতে পায়ে ধরতে হবে না। মুজাহিদদের ছেলেরা ছাত্র আন্দোলন করে না, এমন ক্ষোভ প্রকাশ করার দরকার হবে না। অভিভাবকদের সামনে প্রমাণ করুন এই সংগঠন করে আপনারা জ্ঞান বিজ্ঞান এবং আধুনিকতায় যোগ্য হয়ে উঠেছেন। আপনাদের ভবিষ্যৎ কোনো অনিশ্চয়তার পথে ধাবিত না।
এর জন্য ব্যাপক পড়াশুনা এবং গবেণষা হওয়া দরকার। সারা বছর ধরেই চরমোনাইর মাঠের বক্তৃতার জন্য প্রস্তুতি নেয়া দরকার। বিষয় ভিত্তিক স্ক্রিপ্ট বানানো দরকার। স্ক্রিপ্ট নিয়ে অভিজ্ঞজনদের সাথে পর্যালোচনা করা দরকার। নিজের গলার রগে চাপ না দিয়ে মানুষের মগজে চাপ দেয়া দরকার। হৈ চৈ করে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি না করে মানুষের মনে ছোট ছোট প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেয়া দরকার। যা তাকে প্রতিনিয়ত কাঠ ঠোকরার মতো ঠোকাতে থাকবে। যেমন আপনাদের পীর সাহেবরা, তারা কি করেন? সুর নরম করে, কাঁদো কাঁদো গলায় ওয়াজ করে মানুষের মনে কিছু প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেন, কিছু ভয় ঢুকিয়ে দেন, তাতেই কাজ হয়ে যায়। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ হেদায়েতের সন্ধানে দৌড়াতে শুরু করে, আর তখনি তাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষণ শুরু হয়। আপনারাও মানুষের মনের মধ্যে এমন দৌড় সৃষ্টি করার চেষ্ট করুন। শুধু চরমোনাইর মাঠে নয়, সর্বক্ষেত্রে আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ শুরু করুন। টার্গেট করে কাজ করুন। ভিন্ন মতের ছাত্র নেতাদের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব তৈরি করুন। তাদের সাইক্লোজি বোঝার চেষ্টা করুন।
দলে ভেড়ানোর দরকার নেই, টুপি পরানোর দরকার নেই, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে, শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে কিছু বন্ধু, কিছু সুভাকাঙ্ক্ষি তৈরি করুন। মিডিয়ায়, টকশোয়, বুদ্ধিজীবি মহলে, লেখক সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের মধ্যে, শিক্ষক প্রফেসরদের মধ্যে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিবদের মধ্যে আপনাদের বন্ধু, সুভাকাঙ্ক্ষি তৈরির কাজ শুরু করুন। তাদের মানসিকতা বুঝে, আধুনিকতা বুঝে, বিজ্ঞান প্রযুক্তি, বিশ্ব রাজনীতি, সংস্কৃতি, শ্রমপদ্ধতি বুঝে তাদের সাথে মিশুন। সব স্তরের মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নিজেদের মধ্যে যোগ্য কর্মী বাহিনী তৈরি করুন। নিজ দলের কর্মীদের মেধা যাচাই করুন, তাদের মেধা অনুযায়ী কাজে লাগান। এসাইনমেন্ট দিন। সফলতা বিফলতা নিয়ে সরাসরি কথা বলুন। যা বলেন তা চিন্তা করে বলুন। বুকের গভীর থেকে বলুন। ঠাণ্ডা এবং দৃড়তার সাথে বলুন। শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলুন। পরিমিত হাস্যরস মিশিয়ে কথা বলুন। কথা কাজে মিল রাখুন। বিশেষ করে সময়ের প্রতি সচেতন হোন। আপনারা যে ব্যতিক্রম তা বোঝার সুযোগ সৃষ্টি করে দিন। আপনাদের নিয়ে চিন্তা করতে মানুষকে বাধ্য করুন। কম কথা বলুন, কিন্তু এমন কিছু বলুন যা নিয়ে মানুষ চিন্তা করতে বাধ্য হয়। আলোচনা, সমালোচনা করতে বাধ্য হয়।
সাংবাদিক লেখকরা যেনো আপনাদের নিয়ে লিখতে বাধ্য হয়। হোক সে সমালোচনা, তাতে কোনো সমস্যা হবে না। কারো বিরুদ্ধে কথা বলার দরকার হলে, সমালোচনা করার দরকার হলে তথ্য ভিত্তিক, বুদ্ধিদৃপ্ত কথা বলুন। তার শিক্ষা যোগ্যতা জনপ্রিয়তা বুঝে কথা বলুন। কম বলুন, কিন্তু কাজের কথা বলুন। সংগঠনের উপর নিয়ন্ত্রণ শক্ত করুন। নেতাকর্মীরা যেনো যত্রতত্র বাহাস না করে। যার তার সাথে, যেখানে সেখানে, বুঝে না বুঝে, অর্ধেক বুঝে যেনো তর্কে না জড়ায়। তাদের বলুন ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন চা খানার সংগঠন নয়। ফেসবুকের সংগঠন নয়। এর ভিত্তি আছে, ঠিকানা আছে, গন্তব্য আছে। দেখবেন আগামী ২৫ বছর পরের মিলনমেলার চেহারা আর আজকের মিলনমেলার চেহারায় যে যোজন যোজনের ব্যবধান সৃষ্টি হবে তা নিজেরাই বুঝতে পারবেন।
আরআর